শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দও ও আমার মায়ের ভাষা

প্রকাশিত: ৬:৪৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১

মৃনাল চৌধুরী লিটন।। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন আদালতের সেরেস্তাদার। তিনি ১৯০৪ সালে নবীনগর হাই স্কুল হতে প্রবেশিকা পাস করেন। তিনি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯০৬ সালে কুমিল্লা কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৯০৮ সালে কোলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। রিপন কলেজ থেকেই ১৯১০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে আইন পাস করেন। ১৯০৬ সালে কোলকাতার রিপন কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় সুরবালা দাসকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় ধীরেন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২১ বছর এবং স্ত্রী সুরবালার বয়স ছিল ১৪ বছর। তাদের সংসারে সাত মেয়ে ও দুই ছেলে জন্মগ্রহণ করে।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯১১ সালে। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর বাঙ্গুরা উমালোচন হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২১ সালের বিট্রিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে তিনি অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান। ইংরেজদের রোষানলে পড়ে তাকে এ সময় কারাবরণ করতে হয়। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশ সেবার মহান ব্রত নিয়ে তিনি রাজনীতিতে এক অহিংস বৈশিষ্ট্যে আবির্ভূত হন।ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, বঙ্গীয় কৃষি ঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনী আইন পাসের আন্দোলনের সাথে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ গ্রহণের কারণে বিভিন্ন কারাগারে বিনাশ্রম ও সশ্রম দণ্ড ভোগ করেন।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দেশভাগ হয়। দেশভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করেন ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। করাচিতে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি অব পাকিস্থান’ অর্থাৎপাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে তৎকালীন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেন –” Out of six crores and ninty lakhs people inhabiting this state, 4 crores and 40 lakhs of people speak Bengali language. So, sir, what should be the State language of the state? The state language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the state. I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our State and for that,I consider that Bengali language is a lingua franca of our state. So, Sir Bengalee should not be treated as a Provincial Language. It should be treated as the language of the State.”

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে সেদিন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটির ওপর দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল এবং উত্থাপিত এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় গণপরিষদে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান শুধু এ প্রস্তাবটির বিরোধিতাই করেননি প্রস্তাবকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আদর্শ ও সততাকে কটাক্ষ করেন। সেদিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা কেবল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই করেননি, বিরোধীতা করেছিলেন পূর্ব বাংলার গণপরিষদের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও।১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আবার আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ অনুরোধে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন এবং ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি আতাউর রহমান খানের মন্ত্রীসভায় ছিলেন।

পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং তখন থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। এতদসত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এ্যাডভোকেট আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।