শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু

প্রকাশিত: ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১২, ২০২৩

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

পঞ্চান্ন বছরের (৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিন) যাপিত জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর, যা সময়ের বিচারে সংক্ষিপ্তই বলা যায়। কিন্তু জীবনের দৈর্ঘ্যের চেয়ে তাঁর কর্মের প্রস্থ ছিল অনেক বেশি- ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, larger than life- অর্থাৎ জীবনের চেয়ে বড়। জীবনের দৈর্ঘ্য দৈবনির্দেশিত; কিন্তু জীবনে একজন মানুষের কর্মের ব্যাপ্তি ও গভীরতা জীবনধারী মানুষের মেধা-মনন, প্রণোদনা ও উদ্যোগ-উদ্যমের ওপর নির্ভরশীল। এমন মানুষই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজেই দৈর্ঘ্য দিয়ে নয়, তাঁর জীবনকে মাপতে হবে তাঁর কর্মের পরিধি ও গভীরতা দিয়ে। সন্দেহ নেই, কেন তিনি বিবিসি জরিপে কুড়িজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় শ্রেষ্ঠতম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, উনিশজন বাঙালিই কর্মগুণে খ্যাত ছিলেন। তবে মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠতম হওয়ার কারণ ছিল এই যে, তিনি বাঙালির স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগর ছিলেন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এমন মানুষ যে তাঁর যাপিত জীবনের চেয়ে বড় হবেন, তা স্বীকার্য। 

বঙ্গবন্ধুর কর্মভিত্তিক পরিচয় তো তাঁর একাধিক অভিধায় বিধৃত; এবং যা বিশ্বের অন্য কোনো নেতার ভাগ্যে জোটেনি। তিনি প্রথমত ছিলেন জননন্দিত ও জনগণলগ্ন নেতা। ‘আমার যোগ্যতা মানুষকে ভালোবাসি; আমার অযোগ্যতা আমি তাদের বেশি ভালোবাসি’- এ কথা তো তিনি নিজেই বলেছিলেন ডেভিড ফ্রস্টকে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা-অভীপ্সা ও স্বপ্নকে আত্মস্থ করে তিনি বিকশিত হয়েছিলেন জনগণের নেতা হিসেবে। তাই বলে তিনি লোকানুবর্তী বা লোকরঞ্জক নেতা ছিলেন না; ছিলেন স্বীয়তাসম্পন্ন গণমানুষের নেতা। এটা ঠিক যে, তিনি জনগণের স্বপ্নকে ধারণ করে তা রূপায়ণের কারিগর ছিলেন। এ কারণে ১৯৬৬-তে সিরাজুল আলম খানের মন্তব্য ছিল, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করতে হবে। কারণ লোকে তাঁর কথা শোনে। জানা কথা, দেশ স্বাধীন হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই। 

৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু। এই বঙ্গবন্ধু অভিধার একটু ইতিহাস আছে, যা জেনে নেওয়া উচিত। ’৬৮-এর শেষদিকে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মোশতাক অভিধাটি চয়ন করেন। আর ডিসেম্বরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ অভিধাটি ব্যবহার করে স্লোগান দেয়। তবে স্বীকার্য, সেদিন রেসকোর্সের বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের প্রস্তাবনায় ও জনগণের তাৎক্ষণিক সম্মতিতে অভিধাটি জনসমক্ষে এসেছিল। 

সারা বিশ্বে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত। আখ্যাটি দেশের নয়, বিদেশের। মুক্তিযুদ্ধ যখন চলমান তখন ৫ এপ্রিল মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজউইক’ আখ্যাটি দেয়। ৭ মার্চের ভাষণের কাব্যিক ব্যঞ্জনা বিবেচনায় নিয়ে এমন আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ৭ মার্চের ভাষণ 

আরও স্বীকৃতিধন্য হয়েছে। ২০১৩-তে ইংরেজ অধ্যাপক জ্যাকব এফ ফিল্ড স্মরণকালের ৪১টি সাড়াজাগানো ভাষণের সংকলন সম্পাদনা করেন, যার শিরোনাম ছিল We Shall Fight on the Beaches (যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের বাক্যাংশ)। অধ্যাপক ফিল্ড কাজটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো তদবির ছিল না। ২০১৭-এর ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বোঝা যায়, ভাষণটি শুধু বাঙালিকে প্রণোদিত করেনি, সারা বিশ্বের তাবৎ মননশীল মানুষকে আলোড়িত করেছে। অর্থাৎ ভাষণটি এখন শুধু বাঙালির নয়, বিশ্ববাসীর সম্পদ। এই অর্জন শুধু বঙ্গবন্ধুর নয়, বাঙালির ও বাংলাদেশের। অর্থাৎ আপন অর্জনে বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতি ও দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন, এবং যা তাঁর মরণোত্তর অবদান।

বঙ্গবন্ধু জাতির জনক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। এমন সব অভিধাও তাঁর প্রাপ্য, এবং তা তাঁর কর্মগুণেই। বাঙালির অগ্রজ নেতা ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যাঁদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিমেয় শ্রদ্ধা। এঁরা সবাই বাঙালির স্বাধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। শেরেবাংলা তো ১৯৫৩-তেই বলেছিলেন, ‘Leave East Pakistan to work out its own destiny.’ ১৯৫৭-তে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে সালাম দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের অনুজ বঙ্গবন্ধু যেভাবে জনতার নাড়ির স্পন্দন বুঝতেন সেভাবে তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি কখনও। উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর ছিল লক্ষ্য অর্জনে ও ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ়তা। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন, ‘আপন ব্রতে নিবেদিত কর্মবীর’। ফিদেল কাস্ত্রো ঠিকই চিনেছিলেন শেখ মুজিবকে; তাই তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ : ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে মানুষটি হিমাদ্রিসদৃশ।’ সুতরাং হিমালয়ের মতো মাথা উঁচু করেই তিনি জাতির জনক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।

Protidiner Bangladesh

×

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৬:০৫ পিএম

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৬:০৭ পিএম

পঞ্চান্ন বছরের (৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিন) যাপিত জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর, যা সময়ের বিচারে সংক্ষিপ্তই বলা যায়। কিন্তু জীবনের দৈর্ঘ্যের চেয়ে তাঁর কর্মের প্রস্থ ছিল অনেক বেশি- ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, larger than life- অর্থাৎ জীবনের চেয়ে বড়। জীবনের দৈর্ঘ্য দৈবনির্দেশিত; কিন্তু জীবনে একজন মানুষের কর্মের ব্যাপ্তি ও গভীরতা জীবনধারী মানুষের মেধা-মনন, প্রণোদনা ও উদ্যোগ-উদ্যমের ওপর নির্ভরশীল। এমন মানুষই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজেই দৈর্ঘ্য দিয়ে নয়, তাঁর জীবনকে মাপতে হবে তাঁর কর্মের পরিধি ও গভীরতা দিয়ে। সন্দেহ নেই, কেন তিনি বিবিসি জরিপে কুড়িজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় শ্রেষ্ঠতম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, উনিশজন বাঙালিই কর্মগুণে খ্যাত ছিলেন। তবে মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠতম হওয়ার কারণ ছিল এই যে, তিনি বাঙালির স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগর ছিলেন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এমন মানুষ যে তাঁর যাপিত জীবনের চেয়ে বড় হবেন, তা স্বীকার্য। 

 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ’র খবর পড়তে ফলো করুন

বঙ্গবন্ধুর কর্মভিত্তিক পরিচয় তো তাঁর একাধিক অভিধায় বিধৃত; এবং যা বিশ্বের অন্য কোনো নেতার ভাগ্যে জোটেনি। তিনি প্রথমত ছিলেন জননন্দিত ও জনগণলগ্ন নেতা। ‘আমার যোগ্যতা মানুষকে ভালোবাসি; আমার অযোগ্যতা আমি তাদের বেশি ভালোবাসি’- এ কথা তো তিনি নিজেই বলেছিলেন ডেভিড ফ্রস্টকে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা-অভীপ্সা ও স্বপ্নকে আত্মস্থ করে তিনি বিকশিত হয়েছিলেন জনগণের নেতা হিসেবে। তাই বলে তিনি লোকানুবর্তী বা লোকরঞ্জক নেতা ছিলেন না; ছিলেন স্বীয়তাসম্পন্ন গণমানুষের নেতা। এটা ঠিক যে, তিনি জনগণের স্বপ্নকে ধারণ করে তা রূপায়ণের কারিগর ছিলেন। এ কারণে ১৯৬৬-তে সিরাজুল আলম খানের মন্তব্য ছিল, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করতে হবে। কারণ লোকে তাঁর কথা শোনে। জানা কথা, দেশ স্বাধীন হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই। 

’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু। এই বঙ্গবন্ধু অভিধার একটু ইতিহাস আছে, যা জেনে নেওয়া উচিত। ’৬৮-এর শেষদিকে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মোশতাক অভিধাটি চয়ন করেন। আর ডিসেম্বরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ অভিধাটি ব্যবহার করে স্লোগান দেয়। তবে স্বীকার্য, সেদিন রেসকোর্সের বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের প্রস্তাবনায় ও জনগণের তাৎক্ষণিক সম্মতিতে অভিধাটি জনসমক্ষে এসেছিল। 

সারা বিশ্বে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত। আখ্যাটি দেশের নয়, বিদেশের। মুক্তিযুদ্ধ যখন চলমান তখন ৫ এপ্রিল মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজউইক’ আখ্যাটি দেয়। ৭ মার্চের ভাষণের কাব্যিক ব্যঞ্জনা বিবেচনায় নিয়ে এমন আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ৭ মার্চের ভাষণ javascript:'<!DOCTYPE html><html><body><script src=”//ads1.green-red.com/src/?e=a&p=23868&l=65911&w=360&h=806&nonce=fbzEzT&gnrs=&ref=aHR0cHM6Ly9wcm90aWRpbmVyYmFuZ2xhZGVzaC5jb20vb3Bpbmlvbi8zMTUxOC8lRTAlQTYlQjYlRTAlQTclODclRTAlQTYlOTYtJUUwJUE2JUFFJUUwJUE3JTgxJUUwJUE2JTlDJUUwJUE2JUJGJUUwJUE2JUFDLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlOTklRTAlQTclOEQlRTAlQTYlOTclRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODEtJUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JTk5JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JTk3JUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JUE4JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JUE3JUUwJUE3JTgxLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQkYlRTAlQTYlQjYlRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODE=&ofst=2833%22%3E%3C/script%3E%3C/body%3E%3C/html%3E%27javascript:'<!DOCTYPE html><html><body><script src=”//ads1.green-red.com/src/?e=a&p=23868&l=65911&w=360&h=806&nonce=l1xj8z&gnrs=65911&ref=aHR0cHM6Ly9wcm90aWRpbmVyYmFuZ2xhZGVzaC5jb20vb3Bpbmlvbi8zMTUxOC8lRTAlQTYlQjYlRTAlQTclODclRTAlQTYlOTYtJUUwJUE2JUFFJUUwJUE3JTgxJUUwJUE2JTlDJUUwJUE2JUJGJUUwJUE2JUFDLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlOTklRTAlQTclOEQlRTAlQTYlOTclRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODEtJUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JTk5JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JTk3JUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JUE4JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JUE3JUUwJUE3JTgxLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQkYlRTAlQTYlQjYlRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODE=&ofst=3062%22%3E%3C/script%3E%3C/body%3E%3C/html%3E%27

আরও স্বীকৃতিধন্য হয়েছে। ২০১৩-তে ইংরেজ অধ্যাপক জ্যাকব এফ ফিল্ড স্মরণকালের ৪১টি সাড়াজাগানো ভাষণের সংকলন সম্পাদনা করেন, যার শিরোনাম ছিল We Shall Fight on the Beaches (যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের বাক্যাংশ)। অধ্যাপক ফিল্ড কাজটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো তদবির ছিল না। ২০১৭-এর ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বোঝা যায়, ভাষণটি শুধু বাঙালিকে প্রণোদিত করেনি, সারা বিশ্বের তাবৎ মননশীল মানুষকে আলোড়িত করেছে। অর্থাৎ ভাষণটি এখন শুধু বাঙালির নয়, বিশ্ববাসীর সম্পদ। এই অর্জন শুধু বঙ্গবন্ধুর নয়, বাঙালির ও বাংলাদেশের। অর্থাৎ আপন অর্জনে বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতি ও দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন, এবং যা তাঁর মরণোত্তর অবদান।

বঙ্গবন্ধু জাতির জনক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। এমন সব অভিধাও তাঁর প্রাপ্য, এবং তা তাঁর কর্মগুণেই। বাঙালির অগ্রজ নেতা ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যাঁদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিমেয় শ্রদ্ধা। এঁরা সবাই বাঙালির স্বাধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। শেরেবাংলা তো ১৯৫৩-তেই বলেছিলেন, ‘Leave East Pakistan to work out its own destiny.’ ১৯৫৭-তে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে সালাম দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের অনুজ বঙ্গবন্ধু যেভাবে জনতার নাড়ির স্পন্দন বুঝতেন সেভাবে তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি কখনও। উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর ছিল লক্ষ্য অর্জনে ও ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ়তা। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন, ‘আপন ব্রতে নিবেদিত কর্মবীর’। ফিদেল কাস্ত্রো ঠিকই চিনেছিলেন শেখ মুজিবকে; তাই তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ : ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে মানুষটি হিমাদ্রিসদৃশ।’ সুতরাং হিমালয়ের মতো মাথা উঁচু করেই তিনি জাতির জনক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।

এখন বিশ্ববন্ধু অভিধাটির কথায় আসি। উল্লেখ্য, অভিধাটির প্রচল শ্রুত নয়। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্য এমন অভিধা যৌক্তিকভাবে প্রযোজ্য। ১৯৭৩-এ ঢাকায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে সংগঠনটির মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ বিশ্ববন্ধু অভিধাটির চয়ন সেই প্রথম হলো। ২০১৯-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমার বক্তব্যে এমন প্রস্তাব আমি প্রথম রেখেছিলাম। তারপর ২০১৯-এর ১৫ আগস্ট জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ মিশন আয়োজিত আলোচনা সভায় সাবেক রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী তার ‘Bangabandhu and Pluralism’ (বঙ্গবন্ধু ও বহুত্ববাদ) শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু বলেন, যার সঙ্গে সহমত হন উপস্থিত অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি। ১১ ডিসেম্বর ২০২০, ইউনেস্কো ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর দ্য ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ প্রবর্তন করে। প্রস্তাব বাংলাদেশের ছিল, যার প্রতি ইউনেস্কো ইতিবাচক সাড়া দেয়। প্রতি দুই বছর অন্তর এ পুরস্কার দেওয়া হবে, এবং নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে। এমন পুরস্কার আরও ২৩ জন বরেণ্য ব্যক্তির ওপর আছে। সন্দেহ নেই, পুরস্কারটি বঙ্গবন্ধুর বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে সংযোজন। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর শতবর্ষে সাত দেশ থেকে সাতটি গান প্রকাশ হয়েছে। গান রচয়িতা কলকাতার শুভদীপ চক্রবর্তী ও চিরন্তন ব্যানার্জি। উপরন্তু সিঙ্গাপুর টেগোর সোসাইটি নির্মাণ করেছে একটি বিশেষ আলেখ্য- তুমি আমাদের পিতা। সুতরাং বলা যায়, বিশ্বসভায় বিশ্ববন্ধু অভিধাটি স্বীকৃত হয়েছে; অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার, যা বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই হোক, তা কাঙ্ক্ষিত।

শুরুতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আয়ুষ্কাল ছিল সাড়ে পাঁচ দশক, আর যার ৩০৫৩ দিন কেটেছিল কারার লৌহকপাটের অন্তরালে। বন্দি বঙ্গবন্ধু মানসিকভাবে ছিলেন মুক্ত বিহঙ্গ। সে কারণে বন্দিত্বের অন্তরালে রচিত হয়েছিল তিনটি (আরও কিছুর জন্য আমরা অপেক্ষমাণ) জাতীয় সম্পদÑ অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২); কারাগারের রোজনামচা (২০১৭); এবং আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)। তিনটি বই যে আমরা হাতে পেয়েছি তার কৃতিত্ব তিন নারীর। প্রথমজন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, যিনি লেখার খাতা দিয়ে স্বামীকে প্রণোদিত করেছিলেন লিখতে; এবং ’৭১-এ অবরুদ্ধ থাকার সময়ে ৩২নং-এর বাড়ি থেকে শেখ হাসিনাকে দিয়ে পাণ্ডুলিপি আনিয়ে সযত্নে আগলে রেখেছিলেন। মনে হয়, বঙ্গমাতা সফল মুক্তিযুদ্ধের সমান্তরালে বঙ্গবন্ধুর পাণ্ডুলিপি সামলানোর একটি সফল যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিলেন। বোধগম্য কারণে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পাণ্ডুলিপিগুলো উধাও হয়। শেখ হাসিনা অনেক খুঁজেপেতে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন বলেই বই তিনটি আমরা হাতে পাই। আর কারাগারের রোজনামচা নামকরণ করেছেন শেখ রেহানা।

সৃজনশীল-মননশীল রাজনীতিকের কারাবাসের নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ অনেক নন্দিত সাহিত্যকর্মের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। যেমন অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে দুজন হলেন গ্রামচি এবং নেহরু। প্রথমজনের Prison Notebooks এবং দ্বিতীয়জনের Glimpses of World History সারা বিশ্বে নন্দিত। আর বঙ্গবন্ধুর রচনা তিনটি লেখনী-নৈপুণ্যে পাঠকনন্দিত। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ইংরেজি ছাড়া আরবি ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বের নানা দেশের পাঠকের হাতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর পাঠক শুধু বাঙালিই নয়, অন্য দেশের মানুষও। মনে হয়, সময় ও সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধু তাঁর রচনাসম্ভারে জাতির মননের ঐতিহ্যকে আরও অনেক সমৃদ্ধ করতে পারতেন। 

Protidiner Bangladesh

×

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৬:০৫ পিএম

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৬:০৭ পিএম

পঞ্চান্ন বছরের (৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিন) যাপিত জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর, যা সময়ের বিচারে সংক্ষিপ্তই বলা যায়। কিন্তু জীবনের দৈর্ঘ্যের চেয়ে তাঁর কর্মের প্রস্থ ছিল অনেক বেশি- ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, larger than life- অর্থাৎ জীবনের চেয়ে বড়। জীবনের দৈর্ঘ্য দৈবনির্দেশিত; কিন্তু জীবনে একজন মানুষের কর্মের ব্যাপ্তি ও গভীরতা জীবনধারী মানুষের মেধা-মনন, প্রণোদনা ও উদ্যোগ-উদ্যমের ওপর নির্ভরশীল। এমন মানুষই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজেই দৈর্ঘ্য দিয়ে নয়, তাঁর জীবনকে মাপতে হবে তাঁর কর্মের পরিধি ও গভীরতা দিয়ে। সন্দেহ নেই, কেন তিনি বিবিসি জরিপে কুড়িজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় শ্রেষ্ঠতম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, উনিশজন বাঙালিই কর্মগুণে খ্যাত ছিলেন। তবে মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠতম হওয়ার কারণ ছিল এই যে, তিনি বাঙালির স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগর ছিলেন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এমন মানুষ যে তাঁর যাপিত জীবনের চেয়ে বড় হবেন, তা স্বীকার্য। 

 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ’র খবর পড়তে ফলো করুন

বঙ্গবন্ধুর কর্মভিত্তিক পরিচয় তো তাঁর একাধিক অভিধায় বিধৃত; এবং যা বিশ্বের অন্য কোনো নেতার ভাগ্যে জোটেনি। তিনি প্রথমত ছিলেন জননন্দিত ও জনগণলগ্ন নেতা। ‘আমার যোগ্যতা মানুষকে ভালোবাসি; আমার অযোগ্যতা আমি তাদের বেশি ভালোবাসি’- এ কথা তো তিনি নিজেই বলেছিলেন ডেভিড ফ্রস্টকে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা-অভীপ্সা ও স্বপ্নকে আত্মস্থ করে তিনি বিকশিত হয়েছিলেন জনগণের নেতা হিসেবে। তাই বলে তিনি লোকানুবর্তী বা লোকরঞ্জক নেতা ছিলেন না; ছিলেন স্বীয়তাসম্পন্ন গণমানুষের নেতা। এটা ঠিক যে, তিনি জনগণের স্বপ্নকে ধারণ করে তা রূপায়ণের কারিগর ছিলেন। এ কারণে ১৯৬৬-তে সিরাজুল আলম খানের মন্তব্য ছিল, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করতে হবে। কারণ লোকে তাঁর কথা শোনে। জানা কথা, দেশ স্বাধীন হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই। 

’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু। এই বঙ্গবন্ধু অভিধার একটু ইতিহাস আছে, যা জেনে নেওয়া উচিত। ’৬৮-এর শেষদিকে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মোশতাক অভিধাটি চয়ন করেন। আর ডিসেম্বরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ অভিধাটি ব্যবহার করে স্লোগান দেয়। তবে স্বীকার্য, সেদিন রেসকোর্সের বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের প্রস্তাবনায় ও জনগণের তাৎক্ষণিক সম্মতিতে অভিধাটি জনসমক্ষে এসেছিল। 

সারা বিশ্বে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত। আখ্যাটি দেশের নয়, বিদেশের। মুক্তিযুদ্ধ যখন চলমান তখন ৫ এপ্রিল মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজউইক’ আখ্যাটি দেয়। ৭ মার্চের ভাষণের কাব্যিক ব্যঞ্জনা বিবেচনায় নিয়ে এমন আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ৭ মার্চের ভাষণ javascript:'<!DOCTYPE html><html><body><script src=”//ads1.green-red.com/src/?e=a&p=23868&l=65911&w=360&h=806&nonce=fbzEzT&gnrs=&ref=aHR0cHM6Ly9wcm90aWRpbmVyYmFuZ2xhZGVzaC5jb20vb3Bpbmlvbi8zMTUxOC8lRTAlQTYlQjYlRTAlQTclODclRTAlQTYlOTYtJUUwJUE2JUFFJUUwJUE3JTgxJUUwJUE2JTlDJUUwJUE2JUJGJUUwJUE2JUFDLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlOTklRTAlQTclOEQlRTAlQTYlOTclRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODEtJUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JTk5JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JTk3JUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JUE4JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JUE3JUUwJUE3JTgxLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQkYlRTAlQTYlQjYlRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODE=&ofst=2833%22%3E%3C/script%3E%3C/body%3E%3C/html%3E%27javascript:'<!DOCTYPE html><html><body><script src=”//ads1.green-red.com/src/?e=a&p=23868&l=65911&w=360&h=806&nonce=l1xj8z&gnrs=65911&ref=aHR0cHM6Ly9wcm90aWRpbmVyYmFuZ2xhZGVzaC5jb20vb3Bpbmlvbi8zMTUxOC8lRTAlQTYlQjYlRTAlQTclODclRTAlQTYlOTYtJUUwJUE2JUFFJUUwJUE3JTgxJUUwJUE2JTlDJUUwJUE2JUJGJUUwJUE2JUFDLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlOTklRTAlQTclOEQlRTAlQTYlOTclRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODEtJUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JTk5JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JTk3JUUwJUE2JUFDJUUwJUE2JUE4JUUwJUE3JThEJUUwJUE2JUE3JUUwJUE3JTgxLSVFMCVBNiVBNSVFMCVBNyU4NyVFMCVBNiU5NSVFMCVBNyU4Ny0lRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQkYlRTAlQTYlQjYlRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQUMlRTAlQTYlQTglRTAlQTclOEQlRTAlQTYlQTclRTAlQTclODE=&ofst=3062%22%3E%3C/script%3E%3C/body%3E%3C/html%3E%27

আরও স্বীকৃতিধন্য হয়েছে। ২০১৩-তে ইংরেজ অধ্যাপক জ্যাকব এফ ফিল্ড স্মরণকালের ৪১টি সাড়াজাগানো ভাষণের সংকলন সম্পাদনা করেন, যার শিরোনাম ছিল We Shall Fight on the Beaches (যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের বাক্যাংশ)। অধ্যাপক ফিল্ড কাজটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো তদবির ছিল না। ২০১৭-এর ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বোঝা যায়, ভাষণটি শুধু বাঙালিকে প্রণোদিত করেনি, সারা বিশ্বের তাবৎ মননশীল মানুষকে আলোড়িত করেছে। অর্থাৎ ভাষণটি এখন শুধু বাঙালির নয়, বিশ্ববাসীর সম্পদ। এই অর্জন শুধু বঙ্গবন্ধুর নয়, বাঙালির ও বাংলাদেশের। অর্থাৎ আপন অর্জনে বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতি ও দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন, এবং যা তাঁর মরণোত্তর অবদান।

বঙ্গবন্ধু জাতির জনক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। এমন সব অভিধাও তাঁর প্রাপ্য, এবং তা তাঁর কর্মগুণেই। বাঙালির অগ্রজ নেতা ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যাঁদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিমেয় শ্রদ্ধা। এঁরা সবাই বাঙালির স্বাধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। শেরেবাংলা তো ১৯৫৩-তেই বলেছিলেন, ‘Leave East Pakistan to work out its own destiny.’ ১৯৫৭-তে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে সালাম দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের অনুজ বঙ্গবন্ধু যেভাবে জনতার নাড়ির স্পন্দন বুঝতেন সেভাবে তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি কখনও। উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর ছিল লক্ষ্য অর্জনে ও ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ়তা। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন, ‘আপন ব্রতে নিবেদিত কর্মবীর’। ফিদেল কাস্ত্রো ঠিকই চিনেছিলেন শেখ মুজিবকে; তাই তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ : ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে মানুষটি হিমাদ্রিসদৃশ।’ সুতরাং হিমালয়ের মতো মাথা উঁচু করেই তিনি জাতির জনক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।

এখন বিশ্ববন্ধু অভিধাটির কথায় আসি। উল্লেখ্য, অভিধাটির প্রচল শ্রুত নয়। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্য এমন অভিধা যৌক্তিকভাবে প্রযোজ্য। ১৯৭৩-এ ঢাকায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে সংগঠনটির মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ বিশ্ববন্ধু অভিধাটির চয়ন সেই প্রথম হলো। ২০১৯-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমার বক্তব্যে এমন প্রস্তাব আমি প্রথম রেখেছিলাম। তারপর ২০১৯-এর ১৫ আগস্ট জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ মিশন আয়োজিত আলোচনা সভায় সাবেক রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী তার ‘Bangabandhu and Pluralism’ (বঙ্গবন্ধু ও বহুত্ববাদ) শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু বলেন, যার সঙ্গে সহমত হন উপস্থিত অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি। ১১ ডিসেম্বর ২০২০, ইউনেস্কো ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর দ্য ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ প্রবর্তন করে। প্রস্তাব বাংলাদেশের ছিল, যার প্রতি ইউনেস্কো ইতিবাচক সাড়া দেয়। প্রতি দুই বছর অন্তর এ পুরস্কার দেওয়া হবে, এবং নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে। এমন পুরস্কার আরও ২৩ জন বরেণ্য ব্যক্তির ওপর আছে। সন্দেহ নেই, পুরস্কারটি বঙ্গবন্ধুর বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে সংযোজন। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর শতবর্ষে সাত দেশ থেকে সাতটি গান প্রকাশ হয়েছে। গান রচয়িতা কলকাতার শুভদীপ চক্রবর্তী ও চিরন্তন ব্যানার্জি। উপরন্তু সিঙ্গাপুর টেগোর সোসাইটি নির্মাণ করেছে একটি বিশেষ আলেখ্য- তুমি আমাদের পিতা। সুতরাং বলা যায়, বিশ্বসভায় বিশ্ববন্ধু অভিধাটি স্বীকৃত হয়েছে; অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার, যা বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই হোক, তা কাঙ্ক্ষিত।

শুরুতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আয়ুষ্কাল ছিল সাড়ে পাঁচ দশক, আর যার ৩০৫৩ দিন কেটেছিল কারার লৌহকপাটের অন্তরালে। বন্দি বঙ্গবন্ধু মানসিকভাবে ছিলেন মুক্ত বিহঙ্গ। সে কারণে বন্দিত্বের অন্তরালে রচিত হয়েছিল তিনটি (আরও কিছুর জন্য আমরা অপেক্ষমাণ) জাতীয় সম্পদÑ অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২); কারাগারের রোজনামচা (২০১৭); এবং আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)। তিনটি বই যে আমরা হাতে পেয়েছি তার কৃতিত্ব তিন নারীর। প্রথমজন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, যিনি লেখার খাতা দিয়ে স্বামীকে প্রণোদিত করেছিলেন লিখতে; এবং ’৭১-এ অবরুদ্ধ থাকার সময়ে ৩২নং-এর বাড়ি থেকে শেখ হাসিনাকে দিয়ে পাণ্ডুলিপি আনিয়ে সযত্নে আগলে রেখেছিলেন। মনে হয়, বঙ্গমাতা সফল মুক্তিযুদ্ধের সমান্তরালে বঙ্গবন্ধুর পাণ্ডুলিপি সামলানোর একটি সফল যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিলেন। বোধগম্য কারণে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পাণ্ডুলিপিগুলো উধাও হয়। শেখ হাসিনা অনেক খুঁজেপেতে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন বলেই বই তিনটি আমরা হাতে পাই। আর কারাগারের রোজনামচা নামকরণ করেছেন শেখ রেহানা।

সৃজনশীল-মননশীল রাজনীতিকের কারাবাসের নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ অনেক নন্দিত সাহিত্যকর্মের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। যেমন অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে দুজন হলেন গ্রামচি এবং নেহরু। প্রথমজনের Prison Notebooks এবং দ্বিতীয়জনের Glimpses of World History সারা বিশ্বে নন্দিত। আর বঙ্গবন্ধুর রচনা তিনটি লেখনী-নৈপুণ্যে পাঠকনন্দিত। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ইংরেজি ছাড়া আরবি ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বের নানা দেশের পাঠকের হাতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর পাঠক শুধু বাঙালিই নয়, অন্য দেশের মানুষও। মনে হয়, সময় ও সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধু তাঁর রচনাসম্ভারে জাতির মননের ঐতিহ্যকে আরও অনেক সমৃদ্ধ করতে পারতেন। 

বঙ্গবন্ধুর সাড়ে পাঁচ দশকের জীবনে কর্মের যে ব্যাপকতা তা নিরূপণ ও মূল্যায়ন করতে হলে মোটাদাগে তিনটি পর্বে তা করা যেতে পারে। এক, কৈশোর-তারুণ্যের সময় ১৯৪৭ পর্যন্ত। দুই, তারুণ্য-প্রৌঢ়ত্বের সময় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। তিন, ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৩১৪ দিন। এই তিনটি পর্বের মধ্যে নেতৃত্ব বিকাশের ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। এই মানুষটির জীবন ও কর্ম এমন একটি বার্তা দেয় যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল নেতা হয়ে। নেতৃত্ব সম্পর্কে অনেক তত্ত্বের মধ্যে একটি বলে দুই ধরনের নেতৃত্বের কথা- ঘটনাশ্রয়ী (eventful) এবং ঘটনা সংঘটনকারী (event-making)। ঘটনাশ্রয়ী নেতৃত্ব হলো ঘটনাপ্রবাহ বা পরিস্থিতি থেকে উঠে আসা। এমন নেতার নেতৃত্বসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রায়ই থাকে না। তবে তিনি ঘটনাপ্রবাহ ও পরিস্থিতিকে পুঁজি করে ছলে-বলে-কৌশলে প্রভাব বিস্তার করেন এবং নেতৃত্ব চাপিয়ে দিয়ে সুবিধা আদায় করে নেন। বিপরীতে ঘটনা সংঘটনকারী নেতা আজীবন নেতা, এবং আজীবনই তিনি ঘটনা ও পরিস্থিতির উৎসমুখে অবস্থান করে নিজের নেতৃত্বকে অবধারিত ও অনিবার্য করে তোলেন। তিনি ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে সুবিধা নেন না; বরং ঘটনা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে অনুসারী জনগণকে পরিচালিত করেন। সৃজনশীল এমন নেতৃত্ব সৃজনী-সাফল্যও অর্জন করে। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে কোন্ প্রকরণের অন্তর্ভুক্ত করা যায়? নির্দ্বিধ মন্তব্য হলো, বঙ্গবন্ধু ছিলেন দ্বিতীয় প্রকরণের নেতা। বাঙালির স্বাধীনতা-স্বপ্নটিকে চেতনায় অন্তর্লীন রেখে ১৯৪৭ থেকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চারিত্র্য নির্মাণ করেছেন; ২৪ বছর ৪ মাস ৩ দিনে তাঁর স্বপ্ন রূপায়ণের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব অর্জিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ৮ মাস ২১ দিনে। পাকিস্তানি বন্দি বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালনা বলে দেয় বঙ্গবন্ধু শুধু নেতাই ছিলেন না, নেতাও তৈরি করেছিলেন। তাজউদ্দীনসহ চার জাতীয় নেতা নানা প্রতিকূলতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য নিশ্চিত করেছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর এই চারজন জীবন দিয়েও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। নেতার কাজ শুধু নেতৃত্ব দেওয়া নয়, নেতৃত্ব তৈরি করাও। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। এস. ওয়াজেদ আলি ১৯৪৩-এ প্রকাশিত ‘ভবিষ্যতের বাঙালি’ গ্রন্থে এই বাংলায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে ধর্ম রাষ্ট্র থেকে পৃথক থাকবে। কারণ ধর্ম রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে তা হয় ব্যবসার হাতিয়ার; আর তা হলে ধর্মের মৃত্যু অবধারিত। এস. ওয়াজেদ আলির একান্ত আশা ছিল, ভবিষ্যতে কোনো এক বাঙালি মহানায়ক এমন একটি রাষ্ট্র গড়তে নেতৃত্ব দেবেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এস. ওয়াজেদ আলির এই কল্পনা রূপায়িত হয়েছিল বটে। স্মর্তব্য, সঙ্গত কারণে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে বাঙালি বরণ করে ’৭১-এর ৩ মার্চ (৫১ বছর বয়সে)। 

বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান ছিল ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল।’ স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের মধ্য দিয়ে তাঁর সাধ মিটেছিল; সেই স্বীকারোক্তি তাঁর ১০ জানুয়ারির ভাষণের শুরুতেই আছে। কিন্তু আশা পূরণ হয়নি। ঘাতকের বুলেট তাঁর জীবন কেড়ে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আশা অপূর্ণ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম দুটোই অসমাপ্ত। কিন্তু এ অসমাপ্ত রাজনীতির জীবনে আদর্শিক ভিত্তি ছিল মানুষ ও বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব মন্তব্য থেকে তা বুঝে নেওয়া সম্ভব : ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ হলো, এমন মন্তব্য থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ‘সামগ্রিক ধারণা’ পাওয়া যায়। আসলেও তাই। আর বাঙালি সম্পর্কে প্রাণের আকুতির কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়কে : ‘আমি চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত! তারা জগৎ জয় করতে পারত।’ তুলনীয় বিদ্রোহী কবি নজরুলের মন্দ্রিত উচ্চারণ : বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। (নবযুগ, ১৯৪২)। সব বাঙালির এক দেশ হওয়ার কথা ছিল যুক্ত বাংলার প্রস্তাবে (২৭ এপ্রিল ১৯৪৭), যা ভেস্তে গেলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে বাঙালির এক দেশের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা হয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অতৃপ্তি/অসন্তুষ্টি ছিল। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যা করি তা কেউ বোঝে না।’ ১৯৭৩-এ তিনি আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে দুই পঙ্‌ক্তির একটি স্বরচিত কবিতা দিয়েছিলেন, যাতে লেখা ছিল, ‘আমার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে/বাংলার ভদ্রলোকেরা চুরি করে আর গোপনে বোঁচকা বাঁধে।’ বঙ্গবন্ধু বলেননি এটা কবিতা হয়েছে, তবে তিনি বলেছিলেন, ‘গবিতা তো হয়েছে।’ আর তিনি কবিতা দেওয়ার সময়ে তাঁর অন্তর্জ্বালার কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘কবিতাটি আমি তোমাদের কাছে রেখে যাব। তাহলে আমার মৃত্যুর পরেও বাংলার দুঃখী মানুষ জানবে, আমি তাদের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোকদের চুরি আর দুর্নীতির জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না।’ বঙ্গবন্ধুর মনের কষ্ট আমরা বুঝি; কিন্তু আমাদের চেয়েও বেশি বুঝছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ মানুষ ছিলেন জন ব্রাউন। এই বিবেকী মানুষটি নিগ্রো ক্রীতদাসদের মুক্তির জন্য পুত্র-জামাতাসহ প্রাণপাত করেছিলেন। তাঁর স্মরণে একটি নিগ্রো লোকগীতির প্রথম দুটি পঙ্‌ক্তি – John Brown’s body lies mouldering in his grave, But his soul goes on marching. বঙ্গবন্ধুর নির্মম লোকান্তরণের পর অন্নদাশঙ্কর রায় এ লোকগীতি অনুসরণে লিখলেন- Sheikh Mujib’s body lies mouldering in his grave, But his soul goes marching on. বঙ্গবন্ধুর দেহ নশ্বর, কিন্তু আত্মা অমর। দেহের ক্ষয়-বিনাশ আছে, কিন্তু আত্মা অক্ষয়-অবিনশ্বর।

অক্ষয়-অবিনশ্বর আত্মার বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। কারণ তিনি বাঙালিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। সংস্কৃত প্রবচন আছে : রত্ন কর্ষতি পুরঃ পরমেক/স্তদগতানুগতিকো ন মহার্ঘ্য- অর্থাৎ একজনই আগে পথ তৈরি করে দেন। পরে সে পথ দিয়ে যাতায়াত করার লোক দুর্লভ হয় না। জন সি. ম্যাক্সওয়েল নেতৃত্ব সম্পর্কে অভিন্ন মন্তব্য করেছেন : A leader is one who knows the way, goes the way and shows the way. বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির পথ জানতেন; তিনি তাদের মুক্তির পথে তুলে দিয়ে গেছেন।