প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ১২:৪৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২০, ২০২২

নর্ডিক আর্যদের আগমনের আগে বাংলায় সমাজ-সংস্কৃতির একটি স্বকীয় ধারা বিদ্যমান ছিল। এটাই বাংলার সমাজ সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। পন্ডিতদের মতে, বৃহত্তর বাংলার আদিম অধিবাসীরা হাজার হাজার বছর ধরে একটি প্রভাবশালী জাতি হিসেবে নিজেদের ইতিহাস নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এরা নৃতত্ত্বের ভাষায় আদি অস্ট্রাল নামে পরিচিত। এদের ভাষার নাম ছিল ‘অষ্ট্রিক’। তবে আর্যরা এদেশে আসার পূর্বে অস্ট্রিকগোত্রের লোকের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল দ্রাবিড় জাতির লোকের রক্ত আর সংস্কৃতি। বহিরাগত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রাবিড়রাই বাংলায় প্রথম অনুপ্রবেশ করে। এরপর আসে আলপীয় আর্যরা এবং সব মেষে নর্ডিক আর্যরা।

আর্যপূর্ব বাংলা ও বাঙালির পরিচয় :
ভূ-তাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে বাঙলাদেশ গঠিত হয়েছিল প্লাওসিন যুগে (প্রায় ১০ থেকে ২৫ লক্ষ বৎসর পূর্বে)। নৃবিজ্ঞানীরা জানান এই প্লাওসীন যুগেই পৃথিবীতে নরাকার জীবেরও বিবর্তন ঘটে। এর পরের যুগকে বলা হয়ে প্লাইস্টোনিক যুগ। এই যুগেই মানুষের আবির্ভাব ঘটে। যদিও প্লাইস্টোনিক যুগের মানুষের কোন নরকঙ্কাল ভারতে পাওয়া যায়নি তবুও সেই প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ যে বাঙলাদেশে বাস করে এসেছে, তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশে পাওয়া সে সময়ের ব্যবহৃত আয়ুধসমূহ (হাতিয়ার/অস্ত্র) থেকে।( বাঙলা ও বাঙালির বিবর্তন, পৃ: ৫৬) এ আয়ুধগুলো হচ্ছে প্লাইস্টোনিক যুগের পাথরের তৈরি হাতিয়ার, যা দিয়ে সে যুগের মানুষ আত্মরক্ষা ও পশু শিকার করত। বাংলার বাঁকুড়া, বর্ধমান ও মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার নানা স্থান এই আয়ুধগুলো পাওয়া গেছে। এগুলোকে প্রত্ন-প্রস্তর যুগের আয়ুধ বলা হয়। প্রত্নপলীয় যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল আনুমানিক ১০ হাজার বছর আগে। এরপর শুরু হয় নবপ্রস্তর বা নবপলীয় যুগের। প্রাগ আর্য যুগ থেকে উনবিংশ শতকপর্যন্ত বাঙালির সভত্যা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক।( নীহার, পৃ: ৫৩) কারণ বাংলার কৌম জনগোষ্ঠীগুলি কৃষি ও গ্রামীন সভ্যতাকে অবলম্বন করে তাদের বংশধারা টিকিয়ে রেখেছে। এই গ্রামীন সভত্যা নবপলীয় যুগেই প্রথম আরম্ভ হয় বলে জানান অতুল সুর।

তিনি জানান, ‘মধ্য প্রাচীতে এবং থাইল্যান্ডে যেমন স্বতন্ত্রভাবে নবোপলীয় সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটেছিল, সেরূপ ভারতেও নবোপলীয় সভ্যতা স্বতন্ত্রভাবেই উদ্ভ’ত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রত্নপলীয় যুগ থেকে নবপলীয় যুগ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতা আমরা ভারতেও লক্ষ্য করি। এ ধারাবাহিকতা আমরা বাঙলাদেশেও লক্ষ্য করি।’(পৃ:৭০)

এই যুগে মানুষ কৃষি কাজ করতে শুর করে এবং পশু পালন করতে শুরু করে। এই সময়কার মানুষের সমাজ জীবন ও ধর্মীয় আচার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়ন না। তবে তারা ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে বিশ্বাস করত, মৃত ব্রক্তির সমাধিতে একটা লম্বা পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দিত এগুলোকে ‘বীরকাঁড়’ বলা হয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই স্মৃতিফলক দেখতে পাওয়া যায়।( অতুল সুর: পৃ:৫৭) সাহসী বীরদের কবরে এই স্মৃতিফলক পুঁতে দেওয়া হতো। নৃ বিজ্ঞানীরা একে প্রটো অস্ট্রালয়েড জাতির অবদান বলে মনে করেন। ‘বাংলাদেশে মানুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর গ্রামের বাইরে যে ‘বৃষকাষ্ঠ’ স্থাপন করা হয়, সেগুলি এরূপ প্রস্তর ফলকেরই কাষ্ঠ-নির্মিত উত্তর সংস্করণ’।( অতুল সুর: পৃ, ৫৮) তবে নবোপলীয় যুগের টেকনোলজি অনুযায়ী তৈরি বাঙালির ব্যবহৃত তৈষস হচ্ছে, ধামা, চুবড়ি,কুলা, ঝাপি, বাটনা বাটবার জন্য শিল নোরা ও শস্য পেষার জাঁতা ইত্যাদি।

এরপরেই আসে তামারযুগ। বাঙলায় তাম্রাশ্মযুগের ব্যাপক বিস্তৃতি ছিল মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলায়। এই যুগের সভ্যতার প্রতীক হলো সিন্ধু সভ্যতা।

সিন্ধুর হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতাই আর্য-পূর্ব যুগ বলে পরিগণিত হয়। আনুমানিক ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মেহেরগড় সভ্যতার মধ্যে পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলের সিন্ধু নদ উপত্যকায় ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ সিন্ধু সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দু’টি শহর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো গড়ে ওঠে। ১৯২০-র দশকে পাকিস্তানের সিন্ধুর লারকানায় মহেঞ্জোদারো এবং পাঞ্জাবের রাভী নদী তীরবর্তীস্থানে হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন মেলে। সাধারণত সিন্ধু, পাঞ্জাব ও বালুচিস্তানের মতো এলাকায় এ সভ্যতাটি গড়ে ওঠেছিল। প্রাক্-দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতিই এ সভ্যতার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এটি ছিল একটি নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা। কৃষি ও বাণিজ্য এই সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তারা গৃহ ও দুর্গ উভয়ই নির্মান করতে পারত। এই সময় শুকনো ও পোড়া মাটির পোড়া মাটির ইট দিয়ে তৈরি ঘরবাড়ি-দালান-কোঠা, পাকা রাস্তা-ঘাট, নগর, দুর্গ, জল নিকাশী পয়ঃপ্রণালী, শস্যাগার, বৃহৎ ¯স্নানাগার (দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উ‪চ্চতায় ৩৯/২৩/৮আকৃতির) ও শস্যমাড়াইয়ের নিদর্শন পাওয়া যায়। তারা  গম, যব, বার্লি, কলাই, তেজবীজ, খেজুর ও তরিতরকারির উৎপাদন করত। মহিষ, ভেড়া, শূকর, উট, হাঁস-মুরগি ও পাখি পালন করার পাশাপাশি তারা কুম্ভকারের কাজও করত। এরা পশুর মাংস খেতো। তারা  কার্পাস তুলা ও পশম দিয়ে বস্ত্র উৎপাদন করতে পারতো। এ সময় কৃষি ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। তিলমুন, মাগান, মেলুহা, কালিবঙ্গান ও লোথালের মতো ব্যস্ত বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্য বিনিময় হতো। বাণিজ্য দ্রব্য হিসেবে সোনা,রূপা, তামা, সিসা, ব্রোঞ্জ, ময়ূরের পালক, উন্নত মানের কাঁচ, মুক্তা, হাতির দাঁতের চিরুনি ও চুনাপাথর ছিল প্রাধান। এই সময় কামার, কুমার, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, স্বর্ণকার, ভাস্কর, বণিক ও কৃষকেরা তাদের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রেখেছিল। ঘর-গৃহস্থালিতে কালো ও লাল রঙের নানা মৃৎপাত্র ব্যবহৃত হতো। মেয়েরা নানা রকম অলংকার ব্যবহার করতো। তারা লিঙ্গপূজা ও মাতৃদেবীর পূজা করত। মৃত্যুর পর মৃতদেহ সৎকার বা কবরস্থ করার সময় শবদেহকে পুব পশ্চিম দিকে শয়ন করাতো।( অতুল সুর, বাংলা ও বাঙালির, পৃ: ৫৯) এই সময়ই বাঙালিরা ক্রিট দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করে। ক্রিট দেশের অধিবাসীরাও তামা সংগ্রহের জন্য  বাংলাদেশে আসে। এরা সুবর্ণ বণিক বলে পরিচিত। এদের সঙ্গে বাঙালিদের বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হতে থাকে। এদের অনুসরণ করে আসে আলপীয় গোষ্ঠীর বণিক। তারাও ছিল আর্যভাষী। তবে আলপীয় আর্যভাষীদের সঙ্গে পরবর্তী কালে আসা নর্ডিক আর্যদের বিরোধ ছিল। নর্ডিক  আর্যরা আলপীয় আর্যদের অসুর বলে অভিহিত করে। আলপীয় আর্যদের বিস্তার ছিল অঙ্গদেশ পর্যন্ত। এরা ছিল বিস্তৃত মাথার জাতি।( বাঙলা ও বাঙালির বিবর্তন, পৃ:৬১-৬২) এদের সঙ্গে অস্ট্রিক- দ্রাবিড়দের মিশ্রণ ঘটেছিল বাণিজ্যিক বন্ধুতার মাধ্যমে এবং বিবাহের মাধ্যমে।  এরপর আসে নর্ডিক আর্যরা। তারা এসেছিল ধর্মধ্বজী যোদ্ধা হিসেবে যেখানে তারা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে সেখানেই তারা প্রতিরোধকারী জাতির প্রতি উগরে দিয়েছে ঘোরতর ঘৃণা আর বিদ্বেষ। একারণে তাদের সাহিত্যে দ্রাবিড়া জাতি পরিচিত হয়েছে দস্যু নামে, অস্ট্রিকরা পরিচিত হয়েছে নিষাদ নামে আর আলপীয় আর্যরা পরিচত হয়েছে অসুর নামে। শেষে বাংলাদেশও পরিচিতি হয়েছে অসুরদের দেশ হিসেবে।(অতুল সুর, পৃ: ৬১)