একটা ব্যর্থ বিপ্লবী অভিযানের কাহিনী :

প্রকাশিত: ৩:০০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২২

একটা ব্যর্থ বিপ্লবী অভিযানের কাহিনী :

২৯ আশ্বিন বুধবার ১৩১৪ বঙ্গাব্দ । ইংরাজি ১৯০৭ সালের ১৬ অক্টোবর । আজকের দিনটি বাঙালিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ । কেননা আজ বিজয়াদশমী । চন্দননগর রানির ঘাটে দুপুর থেকেই প্রতিমা বিসর্জন শুরু হবে । তারই প্রস্তুতি তুঙ্গে । এমন সময় একটা ভাউলিয়া নৌকা এসে রানির ঘাটে ভিড়লো । জটাজুটধারী , ব্যাঘ্রচর্মপরিহিত ত্রিশূলধারী এক সন্ন্যাসী নৌকা থেকে নামলেন । ঘাটে নেমেই হুঙ্কার দিলেন — হর হর মহাদেব । নৌকা থেকে নেমে আশপাশের লোককে চারুবাবুর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করায় বাড়ি খুঁজে পেতে সন্ন্যাসীকে কোন বেগ পেতে হল না | কেননা চন্দননগরের কে না চারুবাবুকে চেনেন ? ডুপ্লে কলেজের অধ্যাপক চারুবাবু থাকেন রানির ঘাটের অদূরে । এ যে সন্ন্যাসীর ভেকধারী বারীণ ঘোষ তা কে বলবে ? বারীণের পরনে লাল কৌপিন , খালি গা , একহাতে কমন্ডুল , অন্য হাতে ত্রিশূল | তা বারীণ কৌতুহলীদের কাছে নিজের পরিচয় দিল চোস্ত হিন্দিতে | সে জানালো , হরিদ্বার থেকে আসছে সে | চারু তার পেয়ারের চ্যালা | তার সাথে দেখা করতে এসেছে | অতি সমাদরে একজন চারুবাবুর বাড়ি পৌঁছে দিল বারীণকে | চারুবাবুর বাড়িতে সবসময় ছেলে-ছোকরাদের ভীড় | বারীণ চারুবাবুর সামনে এসেই হুঙ্কার ছাড়লো , হর হর মহাদেব | চারুবাবু এক ঝলক বারীণকে দেখেই চিনতে পারলো | না চেনার কোন কারণ নেই | কলকাতায় অরবিন্দবাবুর সাথে যখনই দেখা করতে গেছেন তখনই বারীণের সাথে নানা গোপন কথাবার্তা হয়েছে | চারুবাবু বারীণকে বরাবর বলে এসেছে , ইংরেজদের এ দেশ থেকে তাড়াতে তিনি সব রকমের সাহায্য করবেন | একদিন কলকাতায় সুবোধ মল্লিকের বাড়িতে একজন চারুবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিল , আপনি তো ফরাসি প্রজা | তা ইংরেজ তাড়ানোর ব্যাপারে আপনার এতো মাথাব্যথা কেন | চারুবাবু উত্তর দিয়েছিলেন , তা ঠিক | আমি ফরাসি প্রজা হতে পারি কিন্তু এটা জানবেন যে — চন্দননগর আমার মাতৃভূমি নয় , আপনার মতন আমারও মাতৃভূমি ভারতবর্ষ | আর এটাও জানবেন যে , ইংরেজদের একবার এ দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে পারলে , ফরাসিদের তাড়াতে ২৪ ঘন্টা সময়ও লাগবে না | তা যাই হোক , চারুবাবু বারীণকে দেখে সবার সামনে ঢিপ করে মাটিতে শুয়ে প্রণাম করলো | বারীণ চারুবাবুর মাথায় হাত রেখে বললো , জিতে রহো বেটা | চারুবাবু ছেলেদের বললেন , তোমরা আজ বাড়ি যাও | আজ গুরুদেবের সেবা করবো | কাল এসো | শুধু গোঁদলপাড়ার নরেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন , নরু , তুই যাস নে | গুরুদেবের সেবার কাজে তোকে দরকার হতে পারে । নরু চারুবাবুর ইঙ্গিতটা বুঝে গেলো এক নিমেষে । সে দুই হাত জড়ো করে বারীণের পায়ের সামনে বসে গাইতে লাগলো —-

                     জয় জয় শংকর 
                     প্রভু তুমি দয়া কর 
                     আমি তব দাসানুদাস ।    
                     তোমারি চরণদ্বয়
                     শির-পরে যদি রয়  ---
                     ডরাইনা আমি কোন ত্রাস ।।

ছেলেরা একে একে বিদায় নিলে চারুবাবু বারীণকে হাত ধরে টেনে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে বললো , কী ব্যাপার , বারীণ ? নিশ্চয় কোন জরুরী খবর এনেছো তুমি ?

বারীণ বললো , আপনি গুরুজন হয়ে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন । এতে আমার পাপ হবে । আগে আপনার চরণদুটিতে মাথা ছোঁওয়াতে দিন ।
এই বলে বারীণ চারুবাবুর সামনে শুয়ে পড়ে ঢিপঢিপ করে তার পায়ে প্রণাম করে বললো , খুব বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছি , কালীপুজোর দিন কিংবা তার পরের দিন রাতে ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার পাটনা থেকে স্পেশাল ট্রেনে কলকাতায় ফিরবে | এমন মোক্ষম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না | আমরা লাটসাহেবের ট্রেন বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে চাই | উল্লাসকর নিজে হাতে টাইম বোমা তৈরী করেছে | আপনার সাহায্য পেলে আমরা একশানে নামতে পারি | চারুবাবু বারীণের দিকে তাকিয়ে বললো , অরবিন্দবাবু জানেন ? বারীণ বললো , ছোড়দার মতামত চাইতেই উনি বললেন , চারুবাবুর মতামত নিয়ে যা করার তা করবে |

চারুবাবু বারীণকে বললো , আমাদের চন্দননগর ইউনিটকে কী করতে হবে ? বারীণ বললো , একজন কর্মী দিতে হবে যে এই এলাকার সব পথঘাট চেনে | আর একটা রাত এখানে কোথাও গোপনে আমাদের থাকতে দিতে হবে | চারুবাবু কিছুক্ষণ ভাবলেন | তারপর বললেন , সব সাহায্য পাবে | কিন্তু চন্দননগরে কোন একশান করো না | তাতে আমার ওপর ফরাসি সরকারের সন্দেহ বাড়বে | একশানটা কর ভদ্রেশ্বর আর মানকুন্ডুর কাছাকাছি কোথাও | বারীণ চারুবাবুর প্রস্তাবে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল | এবারে নরেনকে ঘরে ডাকলেন চারুবাবু | নরেনকে দেখিয়ে বারীণকে বললেন , এর নাম নরু | এ আমার কলেজে কিছুদিন আগেও ছাত্র ছিল | এখন আমাদের দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ওর ঘাড়ে | ও তোমাদের সাথে থাকবে | সাহায্য করবে | তবে তোমরা হাওড়া হয়ে মানকুন্ডু এসো না | তাতে লোকজনের সন্দেহ হতে পারে | খুব ছোট স্টেশন মানকুন্ডু |সারাদিনে বিশ পঁচিশজনের বেশি লোক যাতায়াত করে না | কোন অপরিচিত মুখ দেখলেই লোকের সন্দেহ হবে | তোমরা বরং শ্যামনগর হয়ে এসো | নরু স্টেশনে তোমাদের আনতে যাবে |

নির্দিষ্ট দিনে নরু শ্যামনগর স্টেশনে গিয়ে বারীণ , উল্লাস , বিভূতিকে নিয়ে এলো | ওরা শিয়ালদা থেকে শ্যামনগর হয়ে মানকুন্ডু এলো | আর নরেন গোঁসাই এলো শ্রীরামপুর থেকে | মানকুন্ডু স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে একটা বেলগাছের তলায় এসে বসলো সকলে | নরু বারীনকে বললো , আমি লোক্যাল ছেলে | আমায় সকলে চেনে | আমি আগে স্টেশন চত্বরটা নিজে গিয়ে দেখে আসি | নরেন দেখলো , স্টেশনের এমাথা আর ওমাথায় দুজন করে অচেনা লোক অন্ধকারে বসে গল্প করছে | নরেন বুঝলো , এগুলো খোচর বা শাদা পোষাকে পুলিশের লোক | সে এসে বারীণকে বললো সে কথা | সকলে মিলে শলাপরামর্শ করে ঠিক করলো স্টেশনের উত্তরের মাথায় বারীণ আর নরেন গোঁসাই জঙ্গলের আড়াল থেকে লোক দুজনের উপরে নজর রাখবে আর দক্ষিণের মাথার লোক দুজনের উপর নজর রাখবে নরু আর বিভূতি | কিছু বেচাল দেখলেই বাঁশি বাজিয়ে বাকিদের সতর্ক করে দেবে | স্টেশনের পূর্ব দিকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে রাস্তা আছে সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে মানকুন্ডু স্টেশনের দক্ষিণে কিছুটা গিয়ে রেললাইনের উপরে মাইন পেতে আসবে উল্লাসকর | একটা চটের ব্যাগে সে মাইন নিয়ে এসেছে | তার হাতে একটা ছোট টর্চ |

উল্লাসকর একা একা হাঁটছে ঘন জঙ্গল আর কলাবনের ভেতর দিয়ে | কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে রেললাইনের উপর এসে দাঁড়ালো | তার হাতের ব্যাগে রয়েছে মাইন | লাইনে রেখে ফিউজ জুড়ে দিলে ১০ মিনিট পরে ফাটবে | তাছাড়া রয়েছে খানকয়েক বোমা যা সে নিজে হাতে তৈরি করেছে গোয়া বাগানের মেস বাড়িতে | মাইন ফাটলে সেগুলোও ফাটবে | বোমাগুলো পিকরিক এসিড আর ক্লোরেট অব পটাশ দিয়ে তৈরি। এতগুলো বোমা ফাটলে ট্রেনের বগি ছিটকে পরবে বোমার অভিঘাতে | কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে বোমা রাখতে যাবে উল্লাস এমন সময় সে স্পষ্ট দেখতে পেলো , একটা লিকলিকে ছায়ামূর্তি দাড়িয়ে। সাদা কাপড় সর্বাঙ্গে জড়ানো | সে যেন উল্লাসকে ইশারায় হাত নেড়ে ডাকছে | তার দেঁতো হাসি দেখা যাচ্ছে | উল্লাস রেল লাইন থেকে একটা পাথর তুলে লোকটাকে মারতে গেলো | লোকটার আশ্চর্য ক্ষমতা | যতবারই উল্লাস পাথর ছোঁড়ে ততবারই লোকটা অবলীলায় পাথরটা দুহাতে লুফে নেয় | কিছুতেই উল্লাস লোকটাকে ঘায়েল করতে বা তাড়াতে পারলো না | শেষে প্রচন্ড রেগে গিয়ে তার দিকে উল্লাস ছুটতে লাগলো | লোকটাকে যেভাবেই হোক তাড়াতে হবে | এসব কাজ কোন প্রমাণ রেখে করতে নেই | এসব করতে করতে উল্লাসের আর বোমা-পোতা হল না | মিনিট কুড়ি পরে ছোটলাটের স্পেশাল ট্রেন সশব্দে চলে গেল উল্লাসের পাশ দিয়ে | এই ঘটনার কিছুদিন পরে আরো একবার উল্লাসের মানকুন্ডুতে একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল | বাংলায় প্রথম বৈপ্লবিক অভিযানের সূচনা এবং তার দুর্ভাগ্যজনক ব্যর্থতা এভাবেই ঘটেছিল এই মানকুন্ডুতে | এফ সি ড্যালি এবং স্নিড হাচিনসন নামে পুলিশি গোয়েন্দাদের রিপোর্ট ঘাঁটলে এ সব জানা যায় | তবে মানকুন্ডুর ভূতেদের বিরোধীতার জন্য যে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের স্বপ্ন সফল হল না এটা পুলিশের কোন রিপোর্টে লেখা নেই | থাকবে কী করে ? বিদেশী ভূতেরা কি আর দেশী ভূতেদের কখনো ভয় পায় ? তাই বিদেশী ভূতেদের দেশ থেকে তাড়াতে বিপ্লবীদের অনেক রক্ত ঘাম ও কান্না ঝরাতে হয়েছে । তবে নরেন গোঁসাইয়ের মতন দেশী ভূতকে মারতে বিপ্লবী কানাইলাল কী করেছিল সেটাও এখানে বলা দরকার । জেলের ভিতরে সে কোথা থেকে রিভলবার জোটালো আলিপুর আদালতে বিচারক কানাইলালকে এ কথা জিজ্ঞেস করলে কানাই মোক্ষম জবাব দিয়েছিল । কানাই বলেছিল , The spirit of Kshudiram has supplied me the revolver .