আজ ৭ মে আর পি সাহা অপহরণ দিবস। বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৯:০৪ পূর্বাহ্ণ, মে ৮, ২০২৩ আজ ৭ মে আর পি সাহা অপহরণ দিবস। ১৯৭১ এর ২৯ এপ্রিল ঢাকা গভর্নর ভবনে ডেকে নিয়ে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদের পর ৫ মে তাঁদের মুক্তি দেয়। মুক্তির একদিন পরই ৭ মে রাত সাড়ে ১১টায় নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অবস্থিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রধান কর্যালয় থেকে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা (আর পি সাহা) ও ভবানী প্রসাদ সাহা (রবি)কে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা অপহরণ করে। শত চেষ্টায়ও তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাঁরা হারিয়ে গেলেন চিরতরে। এ ভাবেই জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠসন্তান রণদা প্রসাদ সাহাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলি। একইসাথে আমরা পিতার নিরন্তর চলমান মানবিক কর্মকাণ্ডের যুথবদ্ধ এক মহান সেবক ভবানী প্রসাদ সাহাকেও হারিয়ে ফেলি। এই শূন্যতার গভীরতা অপরিমেয়। যুবক ভবানী প্রসাদ সাহার স্মৃতি পিতার মহান স্মৃতিতে লীন হয়ে আছে। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো ভবানী প্রসাদ সাহার অবিস্মরনীয় আত্মত্যাগের কথা বিস্মৃত হয়ে যাবে। এই কর্মবীর যুবকের কর্মজীবন মাত্র ছয় বছরের। এই জন্যই হয়তো মানবতার কর্মকাণ্ডকে প্রাণে ধারণ করে ছাত্র অবস্থাতেই তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন, অল্প দিনের জীবনকে মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। সেনা হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। এরপরও স্ত্রী-শিশুপুত্রের কথা না ভেবে অকুতোভয় এ যুবক পিতার তীর্থসম প্রতিষ্ঠানগুলো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর রোগী, ছাত্রী এবং কর্মীদের জীবন জীবিকা রক্ষার জন্য সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কুভাকাঙ্খীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় বিদেশে না গিয়ে পিতাসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। এ এক বিরল মহিমান্বিত আত্মত্যাগ। পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান ভবানী প্রসাদ সাহা (রবি)। ১৯৪৪ সনের ১ জানুয়ারিতে কলকাতার শোভাবাজারের ৮নং রশিক ঘোষ লেনের পিত্রালয়ে মা কিরণ বালা দেবীর কোল আলো কওে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর শৈশব শিক্ষা শুরু হয় শোভাবাজারের উপেন্দ্র বিদ্যা মন্দিরে। ৭ বছর বয়সে দার্জিলিং-এর সেন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। অতঃপর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নটরডেম কলেজ ভর্তি থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা তাঁর পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহার জন্মের বেশ আগেই মা, মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজস্ব সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সমন্বয়ে মায়ের নামে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট গঠন করেন। ট্রাস্ট তখন রনদা প্রসাদ সাহার পিতৃভূমি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী কুমুদিনী হাসপাতাল, নারী শিক্ষা স্বাবলম্বনের জন্য ভারতেশ্বরী হোমস , টাঙ্গাইল জেলা শহরে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করছে, দেশে বিদেশে অনেক সামাজিক-সাস্কৃতিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁর আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানে ট্রাস্টের রোজগারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ চলছে। সব জায়গায় মহা কর্মযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ভবানী প্রসাদ সাহা এমন অবস্থায় পিতার কাজে সাহায্য করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। দিনের বেলায় পিতাকে সাহায্য করবেন এমন আশায় পিতার কাছে তোলারাম কলেজে নাইট শিফটে পড়ার অনুমতি চাইলেন। নাছোড়বান্দা ছেলের দাবি পিতা মেনে নিলেন। ১৯৬৫ সনে তিনি তোলারাম কলেজের নাইট শিফটে ভর্তি হলেন। ১৯৬৭ সনে তিনি স্নাতক পাশ করলেন। ১৯৬৭ সনেই তিনি শ্রীমতী সাহার সঙ্গে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন। সিলেট শহরের শেখঘাট এলাকায় পিত্রালয় অভিজাত লাল ব্রাদার্স হাউজে শ্রীমতী সাহা জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বিমলেনদু দাস সিলেটের সর্বজনশ্রদ্ধেয় জনদরদী সমাজ হিতৈষী ব্যক্তিত্ব সিলেট পৌরসভার এক সময়ের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মা অরুনিমা দাস। সকলের ভালোবাসা ও আশীর্বাদে তাঁদের স্বপ্নের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। ১৯৬৮ সনের ২৬ মার্চ তাঁদের একমাত্র পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় রাজীব প্রসাদ সাহা। বর্তমানে রাজীব প্রসাদ সাহা কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ভবানী প্রসাদ সাহা স্বয়ং শিক্ষিত হওয়ার মন্ত্রণা পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এই প্রেরণায় তিনি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের জাহাজ শিল্প তত্ত্বাবধানের স্বার্থে কর্মরত দক্ষ স্কটিস প্রকৌশলীদের কাছ থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজটি হাতে কলমে রপ্ত করেছিলেন। তিনি নিজ হাতে শ্রমিকের ভারী হাতুড়ি ধরতেন, জাহাজের স্টিলের পাতে রিপিট মারতেন। স্কটিস প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে তাঁর নিজের নকশায় এক ডজনের বেশি নতুন জাহাজ গড়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জে ট্রাস্টের ডকইয়ার্ডে তখন মেরামত ও নতুন জাহাজ তৈরির কাজ হতো। ডক ইয়ার্ডটি এখনও সেই স্মৃতি বহন করে টিকে আছে। এই ভাবেই তিনি পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের সকল ক্ষেত্রে নিজেকে স্বয়ং শিক্ষিত করেছিলেন। খেলাধূলা তিনি ভালোবাসতেন, নিজে ফুটবল খেলতেন, অপরকে উত্সাহ দিতেন। ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। পিতা শহিদ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার স্বাস্থ্য-নারীশিক্ষা-স্বাবলম্বন ও মানবতার সেবায় নিবেদিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডের নীতি নির্ধারণ, ব্যবস্থাপনা, অব্যাহত উন্নয়ণ পরিকল্পনা প্রনয়ণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সার্বক্ষণিক সহযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর স্মৃতিময় মানবিক কর্মযজ্ঞের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে স্বাধীনতাপদক প্রাপ্ত নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারতেশ্বরী হোমস, ঐতিহ্যবাহী কুমুদিনী হাসপাতাল, টাঙ্গাইল জেলা শহরে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, মানিকগঞ্জ জেলা শহরে দেবেন্দ্র কলেজ ও দেশে বিদেশে বহু শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক-সাস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা সময়ে টাঙ্গাইলের প্রতিরোধ যুদ্ধ কুরু হয় ১৯৭১ এর ৩ এপ্রিল, শনিবার। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরূদ্ধে শক্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় মির্জাপুরের গোড়ান—সাটিয়াচূড়ায়। মির্জাপুর তথা দেশবাসী তখন স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার শপথে বলিয়ান। তখন মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম প্রয়োজন জরুরি চিকিৎসা সেবা। ভবানী প্রসাদ সাহা স্বপ্রণোদিত হয়ে এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। এর আলোকে জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী ও ওষুধের ছোট ছোট প্যাকেট করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট গোপনে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতালে গোপনে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাঁর নির্দেশে কুমুদিনী হাসপাতালের নার্সবোনেরা ভারতেশ্বরী হোমসে অবস্থানরত ছাত্রীরা সংগোপনে প্যাকেটগুলো তৈরি করতেন এবং এ ব্যাপারে ডাক্তার, শিক্ষক, কর্মকর্তাগণ স্ব স্ব দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন চূড়ান্ত বিজয়ের দিন পর্যন্ত। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও ভবানী প্রসাদ সাহা ছিলেন না কিন্তু তাঁদের মানবতার পতাকা ছিল উড্ডীণ। এটাই মানবতার জয়গাথা। পিতা-পুত্রের এই যূথবদ্ধ মানবতাবাদী জীবন সংগ্রাম এই স্বাধীন জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অখণ্ড অংশ। তাঁদের আত্মদান সাহসী, দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ নতুন প্রজন্মকে আবাহন করে। Related posts:লুৎফুল হাই সাচ্চুর ছোট বোন অধ্যাপিকা মমতাজ বেগমের ইন্তেকালবঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদী কন্ঠস্বর শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছানো যেতে পারে যেভাবে Post Views: ১২৭ SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: