ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্মদিন

প্রকাশিত: ৬:৩১ অপরাহ্ণ, মে ৫, ২০২৩

প্রীতিলতা ভারতের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রথম শহীদ বিপ্লবী নারী। পুরো নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

স্বাধীনতাকামী এই বিপ্লবীর ১১২ তম জন্মবার্ষিকী আজ। তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে ১৯১১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের প্রধান কেরানি, মা ছিলেন প্রতিভাদেবী। ছয় সন্তানের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। মা আদর করে তাকে রাণী ডাকতেন।

তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ১৯১৮ সালে। শিল্প সাহিত্য সর্বোপরী মেধায় সর্বসেরা থাকায় শিক্ষকদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয়। ১৯২৬ সালে মেধাতালিকায় বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে লেটার মার্কসসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পড়াশোনা শেষ করে, তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। তিনি দূরশিক্ষার সঙ্গে দর্শনে স্নাতক হন, এবং পরবর্তীতে একজন স্কুলশিক্ষক হন।

১৯৩২ সালে স্নাতক পাস করা প্রীতিলতার সনদ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে বাতিল করে দেওয়া হয়। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

ঢাকায় পড়ার সময় বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হন। স্নাতক পরীক্ষার পর ১৯৩২ সালের ১৩ জুন ধলঘাটে বিপ্লবীদের প্রধান ঘাঁটিতে মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে দেখা করেন। বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার কারণে প্রীতিলতা পুলিশের নজরদারিতে পড়েন। ফলে প্রীতিলতা আত্মগোপনে যান। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুলাই কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রীতিলতার আত্মগোপনের খবর প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ সরকার তাকে ধরতে ছবিসহ নোটিশ প্রকাশ করে।

১৯৩২ সালের ২৩  সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামে পাহাড়তলীর ব্রিটিশ প্রমোদকেন্দ্র ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমনের সিদ্ধান্ত হয়। মাস্টার দা সূর্যসেন প্রীতিলতাকে এই অভিযানের দায়িত্ব দেন।  রাতে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ করেন। গুলি আর  বোমার আঘাতে পুরো ইউরোপিয়ান ক্লাব কেঁপে উঠে। ক্লাবে একজন আর্মি অফিসারের রিভলবারের গুলি প্রীতিলতার দেহের বাম পাশে বিদ্ধ হয়।

সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি তার রিভলবারটা দিয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে সহযোদ্ধা কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে  ঢেলে দেন। তার মৃতদেহের পোশাকে নিজ হাতে লেখা বিবৃতিতে লেখা ছিল- ‘আমরা  দেশের মুক্তির জন্য এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ।’

ক্লাব আক্রমণে অংশ  নেওয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবীরা শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে প্রীতিলতাকে শনাক্ত করা হয়। ময়নাতদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না এবং পটাশিয়াম সায়ানাইডই ছিল তার মৃত্যুর কারণ।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বীরোচিত ভূমিকার কারণে কীর্তিমান মহিয়ষী বাঙালি নারী হিসেবে তিনি বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ১৯১১ সালে চট্টগ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জগবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার হেড ক্লার্ক। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মাস্টারদা সূর্যসেন-এর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রামে প্রীতিলতাকে প্রথম আত্মোৎসর্গকারী নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রীতিলতা চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করেছিলেন। এই ফলের জন্য মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি নিয়ে কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়তে যান। প্রীতিলতা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়লেও দর্শন বিষয়ে অনার্স করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে অনার্স পরীক্ষা তার আর দেয়া হয়নি।

১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বিএ পাস করেন। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি ও তার সঙ্গী বীণা দাশগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে তাদেরকে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটক শুরু হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে বিপ্লবীদের অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হতো। প্রীতিলতার নিকটাত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন প্রীতিলতা দশম শ্রেণির ছাত্রী। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়েন ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’। এই বইগুলো প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে এবং তখন তিনি দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার গভীর ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।

১৯২৯ সালে প্রীতিলতা দীপালি সংঘের সদস্য হন এবং লাঠি খেলা, ছোরা খেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে কলকাতার বেথুন কলেজে পড়ার সময় প্রীতিলতা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। গড়ে তোলেন এক বিপ্লবী চক্র, যেখানে অনেক মেয়ে সদস্য যোগ দেয়। তখনও গোয়েন্দা বিভাগ মেয়েদের সন্দেহ করত না বলে মাস্টারদার অনুমতি পাওয়ার পর নারীদের বিপ্লবের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করা হয়।

বিএ পরীক্ষা শেষে মাস্টারদার নির্দেশে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম অপর্ণাচরণ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৩২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে এক গোপন বৈঠকে মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। এটা সেই ক্লাব, যেখানে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল- কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। পুরুষের বেশে ইউরোপিয়ান ক্লাব পরিদর্শনে গেলে পথে পাহাড়তলীতে কল্পনা দত্ত ধরা পড়েন। তখন প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়।

বীরকন্যা প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি বিপ্লবী দল ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হয়। আক্রমণ শেষে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে প্রীতিলতা দেশবাসীর কাছে আত্মত্যাগের আহ্বান রেখে পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।