বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত : ইতিহাসের স্মৃতি-বিস্মৃতি বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ১০:২৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৬, ২০২৩ ১৬১২ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পশ্চিম উপকূলের সুরাটে কুঠি স্থাপন করতে দিয়েছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারেননি যে তাঁর ঔদার্যের সুযোগ নিয়ে বেনিয়া, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশ লুট করতে, এসেছে রক্তচোষার মতো দেহের প্রতিটি রক্তবিন্দু শুষে নিয়ে এ সমৃদ্ধ অঞ্চল ধ্বংস করতে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজ শক্তি জয়ী হলে এক সুদীর্ঘ দুর্ভাগ্যের সূচনা হয়। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা চলে গেলেও তছনছ করে দিয়ে যায় উপমহাদেশের মানচিত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সভ্যতা, শিক্ষা, কৃষি সবকিছু। এ দীর্ঘ পরাধীনতায় ভারতবর্ষের অনেক সূর্যসন্তান সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার গৌরবময় পথ বেছে নিয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, সূর্যসেন, হাজী শরিয়তউল্লাহ, তিতুমীর- বীর সন্তানদের তালিকা কম লম্বা নয়। এ স্বর্ণোজ্জ্বল মাহেন্দ্র অধ্যায় রচয়িতাদের কারও কারও স্মৃতি আমাদের মন ও মস্তিষ্কে সজীব হলেও অনেকের কথা আমাদের মনে নেই কিংবা আমরা তাদের স্মরণ করার সময়-সুযোগ পাই না। এমনই একজন বিস্মৃতপ্রায় বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। ১৯৬৫ সালের ১৭ মে এ স্বাধীনতাযোদ্ধা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাই তাঁকে আজ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে কাঁচপুর ব্রিজ দিয়ে নরসিংদী, ভৈরববাজার পার হলেই মেঘনা নদী। মেঘনার অভিভাবকত্বে জীবন্ত তিতাস নদী যার তীরবর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মেঘনা পাড়ি দিয়ে আশুগঞ্জ, বিশ্বরোড হয়ে বাঁদিকে সোজা উত্তরে যে রাস্তাটি চলে গেছে তার সব কোলাহল গিয়ে মিশেছে কালীবাজারে। বাজার ঘিরে স্ব-স্ব মহিমায আলোকোজ্জ্বল দুটি গ্রাম- কালীকচ্ছ ও নোয়াগাঁও; যেন দুই ভাই। কালীকচ্ছ গ্রামের পশ্চিমদিকে দত্তপাড়ায় ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল (ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য) জন্মগ্রহণ করেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। অবশ্য এ গ্রামের সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. কালিপদ সেন তাঁর ‘একদা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বর্ণশিখরে থাকা কালীকচ্ছ ডিরেকটরির রূপরেখা; গৌরবোজ্জ্বল অতীত, স্বর্ণোজ্জ্বল বর্তমান আর স্বপ্নোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’ এবং শিক্ষাগবেষক শেখ শাহবাজ রিয়াদ তার ‘কালীকচ্ছের বিশ্বময়তা কালীকচ্ছ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন’ শীর্ষক নিবন্ধদ্বয়ে উল্লাসকর দত্তর জন্মসাল উল্লেখ করেছেন ১৮৮৪। আট দশকের জীবনে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়গুলো ‘ব্রিটিশ হটাও’ সংগ্রামে ব্যয় করে ভয়াবহ অত্যাচার, নির্যাতন ভোগ করে বিপ্লবী উল্লাসকর সৃষ্টি করেছেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের গৌরবময় নজির। মহান বিপ্লবীর রাজনৈতিক জীবনের আলোচনায় যাওয়ার আগে তাঁর গ্রাম কালীকচ্ছ সম্পর্কে জানা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক কর্ম-আদেশ পেয়ে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত সিঙ্গারবিল এলাকায় বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল ‘পি চক্রবর্তী এন্ড কোং’ নামের একটি কোম্পানি যার সদর অফিস ছিল এ গ্রামে। ঘাঁটিনির্মাতা কোম্পানির মালিক শ্রী প্রবোধ চক্রবর্তীর ছেলে, বর্তমানে আগরতলা-নিবাসী শিল্পপতি শান্তিব্রত চক্রবর্তী ‘অঞ্জলী লহ মোর মাতৃভূমি’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখেছেন- “কিছু পুরনো পুঁথি থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে গ্রামটি যে অনেক প্রাচীন এবং ৫০০ বছর অধিককাল ধরে এর নাগরিকীকরণ, বিবর্তন ও সভ্যতার বিকাশ একটি সুশৃঙ্খল ধারা অনুযায়ী অগ্রসর হয়েছিল সে সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। পাঠানদের বাঙ্গালা শাসনকালে ঠাকুর রঘু প্রসাদ সিংহ রায় রাঢ় দেশে বাস করতেন। খ্রিস্ট পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজবিপ্লবে সর্বস্বান্ত হয়ে তিনি চন্দ্রদ্বীপে চলে আসেন। চন্দ্রদ্বীপ অধিপতি তাকে সম্মানের সহিত আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে জলপ্লাবনে চন্দ্রদ্বীপের অধিকাংশ স্থান বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাতে ঠাকুর রঘু প্রসাদ সিংহের পৌত্র ঠাকুর শিব প্রসাদ সিংহ রায় বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রন্থ হয়ে রাজ্যে ফিরে যান। তার পুত্র সুন্দররাম রাজ সরকার হতে কানুনগু পদলাভ করে ত্রিপুরা আগমন করেন। এখানে আসার পর লালা দিবাকর রায়ের কন্যার পানি গ্রহণ করে এ অঞ্চলেই থেকে যান এবং কালীকচ্ছ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তিনি লালা সুন্দররাম নামে পরিচিত ছিলেন।” কালীকচ্ছর উর্বর মাটি ও বাতাস জন্ম দিয়েছে বহু প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের, যারা শুধু ভারতবর্ষ নয়, পশ্চিমা বিশ্বেও নানাক্ষেত্রে তাদের স্বীয় কর্মে বিশেষ স্থান অর্জন করেছেন। কৃষি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ‘ইউনিভারসিটি অব লন্ডন’ থেকে বিশেষ ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ ড. দ্বিজদাস দত্ত, (১৮৪৯-১৯৩৫) ইস্টার্ন জার্নাল ও দি পিলগ্রিম পত্রিকা দুটির সম্পাদক কৈলাস নন্দী, বাংলা ভাষায় প্রথম ইতিহাস লেখক এবং ভারতের ত্রিপুরার রাজাদের ঐতিহাসিক কাহিনী ‘রাজমালা’র রচয়িতা কৈলাস সিংহ, বাংলার টলস্টয় খ্যাত ডা. মহেন্দ্র চন্দ্র নন্দী (১৮৫৪-১৯৩২) সহ আরও অনেক বিশেষ যোগ্যতার মানুষ কালীকচ্ছে জন্ম নিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, The Autobiography of an unknown Indian গ্রন্থের লেখক ড. নীরদ সি চৌধুরীর মাতুলালয় কালীকচ্ছ। এ গ্রামের ছেলে বিশ্বখ্যাত প্রকৌশলী তপব্রত চক্রবর্তীর নামে আমেরিকার বাল্টিমোর শহরে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে ‘তপব্রত স্ট্রিট’। উল্লাসকর দত্ত ১৯০৩ সালে এন্ট্রান্স পাশ করার পর ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগে। বিত্তশালী, শিক্ষিত, অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও প্রেসিডেন্সি কলেজের বনেদী আলো-বাতাসে গা ভাসিয়ে দেননি তিনি। নিজ দেশে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে পারতেন না। কলেজের এক শিক্ষক প্রফেসর রাসেল বাঙালি জাতি সম্পর্কে অপমানসূচক কথাবার্তা বলতেন। একদিন সহ্য করতে না পেরে ওই প্রফেসরের ‘গায়ে হাত তুলেন’ (উইকিপিডিয়া) উল্লাসকর দত্ত। ফলশ্রুতিতে তাঁকে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি ঘটলে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। এ প্রতিবাদী পুরুষ তৎকালীন সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী ‘যুগান্তর’-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর হয়ে বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতেন। ত্রিপুরা বিধানসভার বর্তমান উপাধ্যক্ষ বাবু পবিত্র কর গত মার্চে তাঁর সংসদ অফিসে আমাকে বলেছিলেন যে, উল্লাসকর দত্ত ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য ছিলেন। উল্লেখ্য, গণমানুষের নেতা কমরেড পবিত্র কর কালীকচ্ছেরই সন্তান। প্রফেসর কালীপদ সেনও তাঁর লেখায় বলেছেন- “মহাবিপ্লবী দত্ত কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্সের ছাত্র থাকাকালীন ‘অনুশীলন সমিতি’তে যোগদান করেন।” কিন্তু উইকিপিডিয়াতে লেখা আছে উল্লাসকর দত্ত ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। এ সামান্য তথ্যভিন্নতায় সৃষ্ট দ্বিধা দূর হওয়া উচিত। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিস্ফোরণলগ্নে বাংলা হয়ে উঠে সশস্ত্র বিট্রিশবিরোধী আন্দোলনের ইপিসেন্টার। বিংশ শতাব্দীর একবারে শুরুতে ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র (১৮৫৩-১৯১০) নামের এক বাঙালি আইনজীবী সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে ‘অনুশীলন সমিতি’ নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯০২ সালের মধ্যেই কমপক্ষে তিনটি পৃথক ‘অনুশীলন সমিতি’ নামের সংগঠন সৃষ্টি হয়। প্রমথনাথ মিত্রের সংগঠনটি ছাড়াও বাকি দুটির একটি ছিল সরলা দেবীর, অন্যটি বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের অনুশীলন সমিতি। অরবিন্দ ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি (বাঘা যতীন), ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের ভাই) এবং বারিন্দ্র ঘোষ প্রমুখ মিলে যে অনুশীলন সমিতি গঠন করেন সেটিই মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯০৬ সালের মধ্যেই অনুশীলন সমিতির কর্মকাণ্ড পশ্চিম ও পূর্ব উভয় বাংলার প্রান্ত থেকে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৭ সালে বারিন ঘোষ তার সহযোগীকে হেম চন্দ্র কানুনগো নাম দিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রেরণ করেন সেখানে নির্বাসিত রাশিয়ান বিপ্লবী নিকোলাস সাফরান্সকির কাছে বোমা বানানোর কলাকৌশল শিখতে। ১৯০৮ সালের এপ্রিলে অনুশীলন সমিতির তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকীকে মোজাফফরপুরে পাঠানো হয় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডি. এইচ কিংফোর্ডকে হত্যার মিশনে। ভুলক্রমে মারা যায় দুই ইংরেজ নারী। এই হামলায় ব্যবহৃত বোমা বানানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন উল্লাসকর দত্ত। এ ঘটনায় ক্ষুদিরামকে পরবর্তীতে গ্রেফতার করে ফাঁসি দেওয়া হয়। প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসে এ ঘটনার বিচার ‘আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে আখ্যায়িত। ইংরেজ পুলিশ ও সৈন্যদের সঙ্গে পেরে না উঠায় অনুশীলন সমিতি ভেঙে যায়। বিলুপ্ত হয়ে যায় অনুশীলন সমিতির প্রাথমিক রূপ। যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি আলীপুর মামলায় গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। সৃষ্টি হয় দুটি গ্রুপ- যুগান্তর পার্টি এবং ঢাকা অনুশীলন সমিতি। যতীন্দ্রনাথ দায়িত্ব নেন যুগান্তরের। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশরাজ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিপ্লবীদের দমনে অভিযান শুরু করে। ১৯০৮ সালের ২ মে উল্লাসকর দত্ত ধরা পড়েন। ১৯০৯ সালে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার রায় দেয় আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত ফাঁসির রায়ের পরিবর্তে অভিরামকে যাবজ্জীবন দেয়। তবে কারাবাসে উল্লাসকর দত্তকে যে পরিমাণ অত্যাচার ভোগ করতে হয়েছে তাতে সবসময় মনে হয় ফাঁসির রায়ই শ্রেয়তর ছিল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যারাই সশস্ত্র আন্দোলন করেছে শাসকশ্রেণি তাদের চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছে। সশস্ত্র বিপ্লবীদের ইংরেজ শোষকরা সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে হয় হত্যা করত অথবা ভয়ঙ্কর কারাবাস দিয়ে জীবনের তরে শেষ করে দিতে চাইত। ইংরেজদের এ ভয়াল প্রয়াসের অংশ হিসেবে আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে তৈরি করে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে লোমহর্ষক কারাগারগুলোর অন্যতম ‘সেলুলার’ জেল। উল্লাসকর দত্তকে আরওে অনেক বন্দীর সঙ্গে পাঠানো হয় সেলুলার জেলে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই এরা এ সুদূর দ্বীপপুঞ্জকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। আর কারাগার কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয় ১৮৯৬-১৯০৬ এর মধ্যকার সময়ে। ভীতিকর পরিবেশ, রহস্য, নানামুখী নির্যাতনের ভীতিপ্রদ কাহিনী-গল্পের হাত ধরে এ সেলুলার জেলের নামকরণ হয় ‘কালাপানি’। সেলুলার বলা হয় কারণ সেখানে বন্দীদের পৃথক পৃথক সেল বা কক্ষে বন্দী রাখা হত। মোট ৬৯৩টি সেল ছিল। ৪.৫ বাই ২.৭ মিটার অথবা ১৩.৫ বাই ৭.৫ ফুট আকারের প্রতিটি সেলের উচ্চতা ৩ মিটার। বাতাস আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে প্রতিটি সেলে আছে ক্ষুদ্র ভেন্টিলেটর। শতভাগ নিঃসঙ্গতায় অসহ্য শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দিন কাটত বন্দীদের। মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্যান্য বন্দীদের মতো ভয়ানক কষ্ট সহ্য করেছেন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। অন্যান্য অঞ্চল যেমন করাচী কিংবা বার্মার কয়েদীরাও আসত। কিন্তু বাঙালি বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বর্বরতা দেখাত কর্তৃপক্ষ। আন্দামানের নরক থেকে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ঠিক কবে মুক্তি পেয়েছিলেন তা নিয়েও আমি দুরকম তথ্য পেয়েছি। তবে মুক্তির আগে নির্মম নির্যাতনে উল্লাসকর দত্ত মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উইকিপিডিয়াতে দেখা যায়, তিনি ১৯২০ সালে আন্দামান থেকে ছাড়া পেয়ে কোলকাতা চলে আসেন। আবার www.indianetzone.com এ বিধৃত এক লেখায় উল্লেখ আছে, উল্লাসকর দত্ত মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে জেলের সুপারিনটেনডেন্ট তাকে আন্দামানের মানসিক হাসপাতালে ও পরে ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে মাদ্রাজ লুনেটিক এসাইলাম (মানসিক হাসাপাতাল)-এ পাঠায়, যেখানে তাঁকে ১২ বছর আটকে রাখা হয়। জানা যায়, মাদ্রাজে উল্লাসকর স্বাভাবিকত্ব ফিরে পেতে শুরু করেন। তিনি সেখানে অবস্থানকালীন আন্দামানে তাঁর দু:সহ অভিজ্ঞতার স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। এর নাম ‘আমার কারাজীবন’। এটি এখন দুষ্পাপ্য। নারকেল, তিল বা সরিষার দানা থেকে তেল বের করার জন্য আধুনিককালে ইঞ্জিনচালিত যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ইঞ্জিনচালিত যন্ত্র আসার আগে গরু বা মহিষের সাহায্যে তেলের মিল চালানো হত। আন্দামানে এরকম তেলের মিল ছিল; সে তেলের মিলে ক্রাশিং চাকা ঘোরাতে গরু বা মহিষ কিংবা যন্ত্রের বদলে বন্দীদের ব্যবহার করা হত। একটা মিল চালাতে তিনজন বন্দী ব্যবহার করা হত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত এ তেল বের করার কাজ। এ অমানুষিক কাজে কোনো বন্দী সামান্যতম ক্লান্তি প্রদর্শন করলে উপস্থিত জমাদার মোটা লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করত। লাঠির আঘাত পর্যাপ্ত মনে না হলে আরও কঠোর ব্যবস্থাও ছিল। মিলের ঘূর্ণায়মান চাকা সদৃশ অংশের হ্যান্ডেলের সঙ্গে বন্দীকে বেঁধে বাকিদের বলা হত পূর্ণ গতিতে ঘোরানোর জন্য। কল্পনা করে দেখুন। মেঝের সঙ্গে মাথা ক্রমাগত বাড়ি খেত, পাশাপাশি পুরো শরীরে পড়ত প্রচণ্ড চাপ। রাতভর ওই খুপড়ি সেলে বন্দী থাকা, দিনের বেলায় উপরে বর্ণিত নারকীয় অত্যাচার এসবের ধকল সইতে না পেরে বিপ্লবী উল্লাসকর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে ১৯১২ সালের ১০ জুন লোহার শিকলে হাত-পা বেঁধে তাঁকে তাঁর সেলে এক সপ্তাহ ফেলে রাখা হয়। তাঁর বেদনা-উৎসারিত চিৎকারে সেলুলার জেলের পরিবেশ ভারী হয়ে থাকত। এ ঘটনার পরপরই এ বিপ্লবীকে প্রথমে আন্দামান মানসিক হাসপাতালে ও পরে মাদ্রাজ লুনেটিক এসাইলামে নেওয়া হয়। তবে জানা যায়, হাসপাতালে চিকিৎসার নামে তার উপর ইলেকট্রিক শক্ দিয়ে অত্যাচারই চলমান ছিল। সেলুলার জেল ও হাসপাতালে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগের পর কারাজীবন শেষে কোলকাতায় ফিরে আসেন উল্লাসকর। তরুণ বয়সে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আর পরে সাম্পদায়িক কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত বিনায়ক দামোদর সাভারকার তার “কালে পানি” (কালাপানি) বইতে শুনেছি উল্লাসকর দত্তের বিষয়ে অনেক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। কোলকাতায় ফিরে এসে কর্মকাণ্ড আগের মতো চালিয়ে নিতে না পারলেও একবারে বন্ধ করেননি বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। ১৯৩১ সালে আবারও গ্রেফতার হন তিনি। পুনরায় কারাগারে প্রেরণ, এবার মেয়াদ ১৮ মাসের। দুশ বছরের হত্যা, লুণ্ঠন, অত্যাচার আর বাণিজ্যের ইতিহাস শেষ করে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে ধর্মের নামে ভাগ করে ব্রিটিশরা চলে গেলে উল্লাসকর দত্ত তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কালীকচ্ছে চলে আসেন। কালীকচ্ছে বছর দশক থেকে পুনরায় কোলকাতায় ফিরেন ১৯৫৭ সালে। বিখ্যাত বিপ্লবী বিপিন চন্দ্র পালের মেয়েকে বিয়ে করে পরে আসামের শিলচরে চলে যান। জীবনের শেষ দিনগুলো শিলচরে কাটিয়ে ১৯৬৫ সালের ১৭ মে পরপারে পাড়ি দেন। সাম্প্রতিককালে কোলকাতা ও শিলচরে দুটি রাস্তা বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তর নামে নামকরণ হযেছে। কালীকচ্ছে দত্ত পরিবারের বাড়িটি এখনও আছে। তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তাটিও ‘উল্লাসকর দত্ত সড়ক’ নামকরণ করা হয়েছে। স্থানীয় এক শিক্ষিত মুসলিম পরিবার বাড়িটি কিনে সেখানে বসবাস করছে। যে বাড়িতে ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সশস্ত্র যোদ্ধা জন্ম নিয়েছিলেন সেটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শুধুমাত্র ওই পরিবারটির নয়, রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। উল্লাসকরদের চর্চা না করলে পুঁজিবাদ আর করপোরেট আসক্তির চোরাবালিতে ডুবে যাবে আমাদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত। সুএ সহযোগিতায় : শেখ শাহবাজ রিয়াদ। শেখ আদনান ফাহাদ : লেকচারার, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। Related posts:ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন জিয়াউল হক মৃধা।পবিত্র ঈদুল আযহা মৃনাল চৌধুরী লিটনের শুভেচ্ছাব্রাহ্মনবাড়ীয়া কোন ধরনের দোকানপাট ১০ই মে খুলছে না Post Views: ২১ SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: