যে ভাষণ এক অমর কাব্য

প্রকাশিত: ৫:৪৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ৬, ২০২৩

১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ ৭ই মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ৷ ১৮ মিনিটের সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি৷
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে৷ গবেষণা হয়েছে৷ পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পেয়েছে৷ ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো৷ গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা৷ যে-কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী৷ এই ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে৷ ফলে এই ভাষণ দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন হয়েছে৷ আর একজন মানুষ একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে স্বল্প সময়ে কোনো পুনরুক্তি ছাড়াই একটি জাতির স্বপ্ন , সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন৷ তিনি বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথা বলেছেন৷ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলেছেন৷ সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে পেরেছেন৷ তাঁরা যা চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তা-ই তাঁদের কাছে তুলে ধরেছেন৷ ফলে এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হয়৷ এই ভাষণই একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই ভাষণ প্রেরণা জুগিয়েছে৷ আর এতবছর পরও মানুষ তাঁর ভাষণ তন্ময় হয়ে শোনেন৷

১৯৭১ সালের এই দিনে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শোনান৷ এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷” তিনি বলেন, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআলাহ!”

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শব্দয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো’

কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে৷ আর বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন কবি হিসেবে৷ তিনি তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার শেষাংশে লিখেছেন, ‘‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি;/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’৷”

কবি নির্মলেন্দু গুণ বিজয়নগর নিউজ কে বলেন, ‘‘একটি অমর কবিতার সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে৷ এরমধ্যে রয়েছে কাব্য এবং কাব্যিক ঢং৷ কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ বলতে পারে৷ অন্য কোনো ভাষণ এভাবে স্কুল- কলেজের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে মুখস্থ বলতে পারে বলে আমার জানা নাই৷ কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু আমিই যে বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছি, তা কিন্তু নয়৷ পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে বলেছে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’৷ তাঁর ভাষণ শুনে নিউজ উইক তাঁকে পোয়েট অব পলিটিক্স বলেছে, কারণ, তাঁর ভাষণে শব্দয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো৷”

নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘‘একজন কবি মানুষের মনের কথা বললেন কিনা তা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ তিনি কিভাবে বলেন, কোন ঢংয়ে বলেন, তা অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ৷ মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র মেঘনাধবধ কাব্য মানুষের মনের কথা নয়, তবে বলার ঢংয়ে তা মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে৷ আর বঙ্গবন্ধু’র ভাষণে তাঁর নাটকীয়তা এবং সম্মোহনী কথা বলার স্টাইল ছাড়াও যুক্ত হয়েছে মানুষের মনের কথা বলার বিষয়টি৷ তিনি ৭ মার্চের বক্তৃতায় মানুষের মনের কথা বলেছেন৷ আশার কথা বলেছেন৷ আর সে কারণে এখনো তাঁর সেই বক্তৃতা মানুষকে উজ্জীবিত করে৷ পৃথিবীর কোনো নেতা ১০ লাখ মানুষের মাঝে এরকম উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই৷ আজো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে তাঁর ভাষণ বেঁচে আছে৷ থাকবে৷ তাই এটা অমর কবিতা৷ আর সেই কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷”