জেনারেল বাজওয়ার ভুল বয়ান ও পাকিস্তানিদের ক্ষমা চাওয়া বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৫:২৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৫, ২০২২ পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া তাঁর বিদায়ী ভাষণে সেনাসদস্যদের উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি কেবল অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না। তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এ হস্তক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ অব্যাহত ছিল মন্তব্য করে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সামরিক বাহিনী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভবিষ্যতেও সেনাবাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। বাজওয়ার এই ভবিষ্যদ্বাণী কাজে দেবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে অর্ধেকের বেশি সময় সেনাশাসনের অধীন ছিল। নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, তঁার ক্ষমতা হারানোর পেছনে সেনাপ্রধান বাজওয়া ও আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছিল। আইএসআই–প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছিলেন তিনি। এসব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু পাকিস্তানের অতীত রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি টেনে এনেছেন, তা আমাদের জন্য কৌতূহলের বিষয়। বাজওয়া বলেছেন, এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান, যা পাকিস্তানের মানুষ সাধারণত এড়িয়ে যান। আর তা হলো ১৯৭১ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) সেনাদের (পশ্চিম পাকিস্তানের) আত্মসমর্পণ। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) হাতছাড়া হওয়া সামরিক নয়, ছিল রাজনৈতিক ব্যর্থতা। সাবেক সেনাপ্রধানের দাবি, ‘একাত্তরে বাংলাদেশে লড়াইরত পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা ৯২ হাজার ছিল না, ছিল ৩৪ হাজার। বাকিরা ছিলেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের লোকজন। এই ৩৪ হাজার সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর আড়াই লাখ সেনা ও মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষিত দু লাখ যোদ্ধার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁরা (পাকিস্তানি সেনারা) সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং নজিরবিহীন ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।’ পাকিস্তানি সেনারা সাহস ও ত্যাগ কোথায় দেখলেন? যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছে। যুদ্ধ করে কোনো সেনাপতি কিংবা কোনো বাহিনী পরাজিত হতেই পারে। ১৯৬৫ ও ১৯৪৮ সালেও পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। কিন্তু একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা তো বাংলাদেশে যুদ্ধ করেনি। ৯ মাসজুড়ে তারা এখানে গণহত্যা চালিয়েছে। তাদের হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং ২ লাখের বেশি নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে; মানুষের সহায়-সম্পদ ও অর্থ লুট করেছে। জেনারেল নিয়াজি নামের যে সেনা কর্মকর্তাকে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পাঠানো হয়েছিল, তিনি বাঙালির চেহারা বদল করে দেওয়ার দম্ভ দেখিয়েছিলেন। আরেক সেনা কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সবুজ জমি লাল করে দেওয়া হবে।’ পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরুই করেছিল গণহত্যা দিয়ে। ডিসেম্বরে যখন দেখল পরাজয় অনিবার্য, তখন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বাজওয়ার এসব আত্মসমালোচনামূলক বক্তব্যের উদ্দেশ্য সেনাসদস্যদের উজ্জীবিত রাখা নয়, অন্য কিছু। তার ইতিহাস পুনঃপাঠের আগে ১৪ অক্টোবর পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্ন পরিষদে আরেক ঘটনা ঘটে। রিপাবলিকান পার্টির স্টিভ শ্যাবট ও ডেমোক্রেটিক দলের রো খান্না ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে একটি প্রস্তাব আনেন। স্টিভ শ্যাবট কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের ভাইস চেয়ার ও ফরেন রিলেশন্স কমিটির এশিয়া ও প্যাসিফিক সাবকমিটির সদস্য। ‘১৯৭১ বাংলাদেশ গণহত্যা স্বীকৃতি’ শীর্ষক প্রস্তাবে পাকিস্তানকে ঘটনা স্বীকার করে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার এবং অপরাধী যারা এখনো জীবিত, তাদের আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর নৃশংসতাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই দুই আইনপ্রণেতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পাকিস্তানিদের ‘গণহত্যা’ ও ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, মার্কিন কংগ্রেসে দেড় লাখ আর্মেনিয়ার গণহত্যা (২০১৫) স্বীকৃতি পায় ২-১৯ সালের ২৯ অক্টোবর। স্টিভ শ্যাবট টুইটে লেখেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার ঘটনা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার ওহাইও অঙ্গরাজ্যের সহকর্মীর সহযোগিতায় বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর চালানো নৃশংসতা, বিশেষ করে যার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’ রো খান্না টুইটে লেখেন, ১৯৭১ সালে বাঙালি গণহত্যার স্মরণে প্রথম প্রস্তাব তোলেন স্টিভ শ্যাবট। এ প্রস্তাবে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিস্মৃত গণহত্যার গণহত্যা (২০১৫) স্বীকৃতি পায় ২-১৯ সালের ২৯ অক্টোবর। স্টিভ শ্যাবট টুইটে লেখেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার ঘটনা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার ওহাইও অঙ্গরাজ্যের সহকর্মীর সহযোগিতায় বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর চালানো নৃশংসতা, বিশেষ করে যার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’ রো খান্না টুইটে লেখেন, ১৯৭১ সালে বাঙালি গণহত্যার স্মরণে প্রথম প্রস্তাব তোলেন স্টিভ শ্যাবট। এ প্রস্তাবে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিস্মৃত গণহত্যার শিকার লাখো জাতিগত বাঙালি এবং হিন্দু নিহত কিংবা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এদিকে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধানের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। তিনি বলেছেন, একাত্তরের বিপর্যয়ের জন্য সেনানেতৃত্বই দায়ী। সে সময় রাজনীতিকেরা দেশ শাসন করেননি। শাসন করেছিল সেনাবাহিনী। যুদ্ধ শুরু ও শেষও করেছে সেনাবাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের শাসনভার নেন এবং দেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলওয়ালের নানা। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক সেনাপ্রধান—দুজনই অর্ধসত্য বলেছেন এবং বিপর্যয়ের জন্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে দায়ী করেছে। প্রকৃত সত্য হলো, একাত্তরে পাকিস্তানের বিপর্যয়ের জন্য সেনা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব উভয়ই দায়ী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনানেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে, যাতে বিজয়ী দলকে ক্ষমতা না দেওয়া হয়। ৩ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। এরপরও বঙ্গবন্ধু আলোচনার দরজা খোলা রাখেন। দুই পক্ষে কয়েক দফা আলোচনাও হয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বাঙালির ওপর গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের মানুষ এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ, যার অনিবার্য পরিণতি ছিল পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশের বিজয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কত সেনা এখানে যুদ্ধ করেছিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা যুদ্ধের নীতি মেনে চলেছে কি না। তারা সেটি মানেনি। নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। যার স্বীকৃতি আছে পাকিস্তান সরকার গঠিত হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও। বাংলাদেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানিদের গণহত্যার স্বীকৃতি দাবি করে এসেছে। ২০১৩ সাল থেকে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব পেশের পর পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিষয়টি ফের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে। এর আগেও পাকিস্তানের একাধিক রাজনীতিক ও সেনা কর্মকর্তা একাত্তরের ঘটনা ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁরা যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তা ভুলে যাওয়া যায় না। একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতেই হবে। লেখক, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি Related posts:বিজয়নগর মুকুন্দপুর মুক্ত দিবসে আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিতআজ বিজয়নগর মুক্ত দিবসব্রাহ্মণবাড়িয়া তান্ডবের জন্য সাজিদুর-মোবারকউল্লাহসহ সহযোগীদের গ্রেফতার চান মোকতাদির চৌধুরী Post Views: ৭৭ SHARES অর্থনৈতিক বিষয়: