বিএনপি ছাত্রদল কি আবারও পুরনো লাইনেই যেতে চায়?

প্রকাশিত: ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ, জুন ২, ২০২২

||মৃনাল চৌধুরী লিটন||

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলের ফেসবুকে দেওয়া স্লোগান– ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’কে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য চলছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও এ নিয়ে তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ছাত্রদল এমন কোনও স্লোগান দেয়নি। আবার একটি টিভি চ্যানেলে টকশোতে ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ারের’ অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন এমন স্লোগান ছাত্রদল দিয়েছে। কিন্তু বড় কথা হচ্ছে, ছাত্রদল সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলের নিজ ফেসবুক আইডিতে স্পষ্টই স্লোগানটি পোস্ট করেছেন। গণমাধ্যমে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও অস্পষ্টতা লক্ষণীয়। এদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, ছাত্রদলের এই স্লোগান উচ্চারণের পরিপ্রেক্ষিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন মহল প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, ছাত্রদলের সদস্যদের বিএনপিই শিখিয়ে দিয়েছে এমন স্লোগান দেওয়ার জন্য।

পঁচাত্তরের হাতিয়ারের অর্থ কী, বোধকরি এটা নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। যদিও বিএনপির একটি পক্ষ ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনে আনতে চাইছেন। তারা এই স্লোগানকে সমর্থনের প্রসঙ্গে বলতে চাইছেন, ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার’ প্রতীকী অর্থে ৭ নভেম্বরের হাতিয়ার ব্যবহারকেই বোঝানো হয়ে থাকে।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত আছেন। বিএনপি বরাবরই জিয়ার সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু যে মুহূর্তে পঁচাত্তরের হাতিয়ারের স্লোগান দেওয়া হয়, তখন কি এটাই প্রমাণ হয় না যে তারা বঙ্গবন্ধুর খুনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে? এক্ষেত্রে তারা যে ৭ নভেম্বরের কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে, সেটাও কি ধোপে টিকে? ৭ নভেম্বর যে অস্ত্রবাজি হয়েছিল সেটা কি জনসম্পৃক্ত কোনও বিষয় ছিল? সেই সময় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহীদের একটি গ্রুপ সেনানিবাসে বিদ্রোহ করেছিল। জিয়াউর রহমান ছিলেন তখন বন্দি। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকেই মুক্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান সেই বিদ্রোহের নেতা কর্নেল তাহেরকে কারাগারে পাঠান। প্রমাণ হয়, জিয়াউর রহমান বিদ্রোহকে সরাসরি ক্ষতিকর মনে করেছেন। শুধু তাই নয়, কর্নেল তাহেরকে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই বিদ্রোহকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এখন কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে যে সেনা বিদ্রোহ বা তাদের ভাষ্য অনুযায়ী বিপ্লব হয়েছিল সেই বিপ্লবকে কি তারা অন্যায় বলে স্বীকার করছে না? আজকে ৭ নভেম্বরের প্রসঙ্গ এনে কি অবৈধ ইতিহাসকেই ধারণ করছেন না? ৭ নভেম্বরের আগে সেনাবাহিনীর একটি অংশের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়। অসংখ্য সেনা সদস্যকে প্রাণ হারাতে হয় সেই সময়। শুধু তা-ই নয়, জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল নভেম্বরেই। এখন তারা যদি পঁচাত্তরের হাতিয়ার বলতে নভেম্বরের অস্ত্রবাজিকে বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে কি জাতীয় চার নেতা হত্যা, কর্নেল তাহের হত্যার দায়কেই তারা স্বীকার করতে চাইছেন না? এই হত্যাগুলোর সূত্র ধরেই তো জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের চূড়ান্ত মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।

সুতরাং বিএনপির দাবি অনুযায়ী ৭৫-এর হাতিয়ার নভেম্বরের বিদ্রোহ ঘটনাও যদি হয়ে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং সূর্যসন্তানদের হত্যার দায়ও তারা নিয়ে নিচ্ছেন।

অন্যদিকে ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমাদের চোখে পড়ে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি এবং ফ্রিডম পার্টি গঠনে বিএনপির সহযোগিতা এবং একইসঙ্গে জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদা জিয়া পর্যন্ত বিএনপি সরকারের প্রতিটি আমলেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষাই শুধু নয়, তাদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তারা।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে বিএনপি পঁচাত্তরের খুনিদের পক্ষাবলম্বনের প্রথম আইনি প্রমাণ রাখে। তারপর মেজর খায়রুজ্জামান, কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক গংকে রক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বারবার প্রমাণ করেছে তারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনের ঘটনায় খুনিদেরই পক্ষ। শুধু তাই নয়, ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সংসদ অর্জন হয়েছে বলে আমরা যে গর্ব বোধ করি, সেই সংসদেও খুনি রশীদকে বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়ে বসিয়েছে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সেটা করেছিলেন ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে।

এই মুহূর্তে তাদের অঙ্গসংগঠন কিংবা সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে সেই বার্তাই কি দিচ্ছেন না যে তারা আরেকটি ৭৫ ঘটাতে চান? কোন অর্থে তারা নিজেদের এই দায় থেকে সরিয়ে আনবেন? যদি মনে করা হয় তারা ৭৫-এর নভেম্বরের গোলাগুলির কথা বলছেন, তাহলেও যে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহের সর্বোপরি জাতীয় চার নেতার হত্যার দায়ও তাদের নিতে হবে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, আসলে বিএনপি এই মুহূর্তে ক্ষমতায় আসার জন্য যে আশাবাদ ব্যক্ত করছে তার সূত্র কি এই হাতিয়ার? যে হাতিয়ার ৭৫-এ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল? যে অস্ত্র বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার, তার সহযোগী ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ত্যাগী মানুষগুলোকে হত্যা করেছিল?জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মিছিল থেকে এই স্লোগান দেওয়া হয়েছিল বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটা তারা অস্বীকার করলেও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ফেসবুক বিষয়ে স্পষ্ট কোনও বক্তব্য দিয়েছেন এমনটা শোনা যায়নি।

সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায় একটি সমাবেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে গিয়ে বলেছিলেন ‘খালেদা জিয়ার চামচারা হুঁশিয়ার সাবধান’। তার এই স্লোগানও ব্যাপক ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তবে নিপুণের এই স্লোগানকে মনে করি সবাই এনজয় করেছেন। কারণ, তিনি যে ভুল করে নিজ দলের বিরুদ্ধে স্লোগানটি উচ্চারণ করেছিলেন তা সবাই বুঝতে পেরেছেন। যেমনি বিএনপি জোটের অন্যতম নেতা শফিউল আলম প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই খালেদা জিয়ার পতন চেয়েছিলেন। সেটা এখনও ফেসবুকে চালাচালি হয়। সেই বক্তব্যকেও অসচেতনভাবে ভুল হিসেবেই মানুষ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের স্লোগানকে ভুলে দেওয়া বলে মনে করার সুযোগ নেই। তিনি পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার যেখানে লিখেছেন, তার আগে আরেকটি স্লোগানও দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে- ভারতের দালালরা হুঁশিয়ার সাবধান। অবশ্য এই স্লোগানকে মানুষ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে অনেকেই মনে করতে পারেন। তবে এটাও খুনি ফারুক গং উচ্চারণ করতেন। তাদেরও স্লোগান ছিল।

বিএনপি আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করে এমন অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে এখনও। এক আন্দোলনে গাড়ি ভাঙচুর থেকে শুরু করে মানুষ পুড়িয়ে মারার যে বদনাম তাদের জুটেছে, সেই রেশ তাদের এখনও কাটেনি। এমন পরিস্থিতিতে পঁচাত্তরের হাতিয়ার উঁচিয়ে ধরার যে ডাক ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দিলেন, এটা তার সঙ্গে যুক্ত হলো আবার। তাই অনেকেরই সন্দেহ তারা কি আবারও পুরনো লাইনেই যেতে চায়?