শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ২:২৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২২

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি বাংলা জনপদের একজন অন্যতম সূর্যসন্তান। তার এই অবদানের জন্য তাকে রাষ্ট্রীয় বিশেষ খেতাবে ভূষিত করা উচিত।

শুরু হলো ভাষার মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু এই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল, পিকেটিং আন্দোলন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তৎকালীন তরুণ রাজনীতিবিদ, বাংলা জনপদের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে সেই সময়কার প্রবীণ যে ক’জন রাজনীতিবিদ অংশ নেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন সেই সময়কার পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য। ১৯৪৭ সালে তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। এই বিভক্তিতে বাংলা দ্বিখ-িত হয়। খণ্ডিত বাংলার দুটি অংশের একটি পড়ে পাকিস্তান অংশে, অপরটি ভারতে। পূর্ব বাংলা পড়ে পাকিস্তান অংশে, ১৯৫৩ সালে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তানিরা নামকরণ করে পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির ঠিক ৬ মাস পর পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের গণপরিষদের ব্যবহার্য ভাষা হবে উর্দু এবং ইংরেজি, তা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এবং এই অধিবেশনের ব্যবহার্য ভাষা হিসেবে উর্দু এবং ইংরেজিতে শুরু হলে তার প্রতিবাদ করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। অধিবেশনের শুরুতে আলোচনার সূত্রপাত করেন কংগ্রেস দলীয় গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদের শুরুর প্রথম ভাষণে বলেন, গণপরিষদের যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি এবং উর্দু ভাষায়। অথচ সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাই ইংরেজি এবং উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে গণপরিষদে ব্যবহার করার প্রস্তাব রাখছি। গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, দেশের ৬ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাহলে আপনিই বলুন মাননীয় সভাপতি রাষ্ট্র ভাষা কী হওয়া উচিত। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বানের নোটিস জারি হলে ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার একটি সংশোধনী প্রস্তাব দাখিল করেন, তার মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ২৯নং বিধির ১নং উপবিধিতে উর্দু এবং ইংরেজির পর বাংলা শব্দটি সংযুক্ত করার। ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জমা দেয়া প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন মাত্র তিনজন গণপরিষদের সদস্যর। তারা হলেন প্রেমহরি বর্মা, ভুপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তী তার প্রস্তাবকে সমর্থন করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন গণপরিষদের অধিবেশনে। কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তী তার বক্তব্যে বলেছিলেন, উর্দু পাকিস্তানের পাঁচ প্রদেশের কোনো একটিরও ভাষা নয়, বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য চাপ দিচ্ছি না, শুধু সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি চাই। গণপরিষদে এই প্রস্তাব বিল উপস্থাপন করা জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানি শাসকের রোষানলে পড়েন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপস্থাপিত প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে সেই দিন গণপরিষদে বক্তব্য রাখেন তখনকার পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, মোহাজের ও পুনর্বাসনমন্ত্রী গজনফর আলী খান, পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং গণপরিষদের সহসভাপতি তমিজউদ্দিন খান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথাটি গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বিলের মাধ্যমে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, যা বুঝা যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর দেয়া গণপরিষদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। লিয়াকত আলীর বক্তৃতার সারমর্মটা ছিল এমন বাংলা একটি সাধারণ ভাষা, এটা দিয়ে নাকি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। কুমিল্লা শহরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে একটি সড়ক আছে, জগন্নাথ হলে একটি গ্রন্থাগার, জাদুঘরে আছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের একটি ছবি। এগুলোর মাধ্যমে আগামীর প্রজন্ম শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে কতটুকু জানতে পারবে? অথচ এই ব্যক্তিটি হলো বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। করাচির মাটিতে সিএপি অর্থাৎ ‘কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি অব পাকিস্তান’, যার বাংলা অর্থ পাকিস্তানের গণপরিষদ। সেখানে দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের সামনে দীপ্ত কণ্ঠে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি উপস্থাপন করেছিলেন। সেই সময় পূর্ব বাংলার অনেক জনপ্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, কেউ কিন্তু তা করতে সাহস পাননি, যা পেরেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে তিনি সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে গর্ভনর শাসনের বিরুদ্ধে ছাঁটাই বিল উপস্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার প্রতি ছিল মারমুখী ক্ষিপ্ত। কারণ তিনি পূর্ব বাংলার ন্যায্যতার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সংসদে লড়েছেন। পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করেননি। তার এই আপসহীনতা এবং সংগ্রামী মনোভাবকে পাকিস্তানি শাসকরা ভয় পেত, তাই তারা নানা কৌশল খুঁজছিল কীভাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে দমন করা যায়। পাকিস্তানি সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকরা একটি আইন পাস করে। আইনটির নাম এবডো (Elective Bodies Disqualification order)। এই এবডোর প্রয়োগ করা হয় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর, কারণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। এবডোর ফলে তিনি সব নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষিত হন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। ’৬৯সহ বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি নেপথ্যে থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শুরু করলে, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হায়েনার দল ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার পুত্র দিলীপ কুমার দত্তকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর পিতা ও পুত্রকে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসের টর্চার সেলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছেলে দিলীপ কুমারের ওপর পাকিস্তানি হায়েনার দল অমানবিক নির্যাতন চালায়। অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তানি পশুরা পিতা ও পুত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করে