ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-২০২১ ও কিছু ব্যক্তিগত উপলদ্ধি বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৩:৫৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২১ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যোগদানের দিন থেকেই বুঝেছি এই জেলা বাংলাদেশের বাকি ৬৩ জেলার থেকে পুরোপুরি আলাদা। জয়েনিং এর দিন জেলা প্রশাসক স্যার সেটি আবারো মনে করিয়ে দেন। আস্তে আস্তে কাজ করতে করতে আবিষ্কার করেছি এই এলাকার মানুষের ভাবনা যা প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তনশীল। এখনো হয়তো জানার বা বুঝার অনেক পথ বাকি, কিন্তু বিধিবাম। যোগদান করার ২ মাসের মাথায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এর তফসিল ঘোষিত হলো। পুরো উপজেলা তখনও ঘুরে দেখা হয়নি। কর্মব্যস্ততায় অনেক ইউনিয়নে যাওয়া পর্যন্ত হয়নি। এই অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু সুন্দরভাবে করা ছিলো বিশাল চ্যালেঞ্জ। আবার নামটি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন সেই চ্যালেঞ্জের ওজন আরো বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাচন শুরু হয়। সেখান থেকে উপলদ্ধি করি নির্বাচন সুন্দরভাবে করার জন্য আপনাকে আগে নিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মস্থল সম্পর্কে আগাগোড়া জানতে হবে। সেই উপলদ্ধি থেকে সমগ্র উপজেলার সকল ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন ও স্টাডি করা শুরু করি। সাপ্তাহিক দিনগুলোতে অন্যান্য দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকায় শুক্র শনিবার গুলো ছিলো আমার ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনের দিন। শুক্র শনিবার আমি এবং আমার সাথে সহযোগিতার জন্য পরিদর্শনে যাওয়া লোকগুলোর দুপুরের খাবার ছিলো শুকনা খাবার। কারণ খাবার খেতে দুপুরে বাসায় আসলে সব সেন্টার পরিদর্শন করা ও সেন্টার সম্পর্কে জানা সম্ভব হতো না। অত্যন্ত চমৎকার সেই মানুষগুলো রুটি, কলা, কেক, পানি, বিস্কিটকেই তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনের খাবার বানিয়ে ফেললো হাসিমুখে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনিঃশেষ। ৪ টি সপ্তাহের শুক্র শনিবার ঘুরে উপজেলার সকল সেন্টার অর্থাৎ ১০৫ টি সেন্টার পরিদর্শন করতে সক্ষম হই। রাতের অন্ধকারে প্রায় ২ কিলোমিটার হেঁটে কেন্দ্র দেখতে গিয়েছি। নৌকা দিয়ে, এক বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে গিয়েছি এক সেন্টার থেকে অন্য সেন্টারে। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে কথা বলে জেনেছি কোথায় কোন সমস্যা পূর্বে হয়েছিলো। কোন চেয়ারম্যান/মেম্বার প্রার্থীর বাড়ি কোথায়। কে কি করে। প্রতিটা জিনিস লিখিত নোট নিয়েছি। বাসায় ফিরে এসে ছক করে নোট করে রেখেছি। পুরো ১০৫ টি সেন্টার সম্পর্কে, ৪০০ এর অধিক প্রার্থী সম্পর্কে আমার সমৃদ্ধ নোট ছিলো। ছিলো প্রতিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য আলাদা রোড ম্যাপ, হাত নকশা, উপজেলা থেকে দূরত্ব ও যাতায়াতের বিস্তারিত। পরবর্তীতে দায়িত্ব পালন করতে আসা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটদের অনেক অনেক সহযোগিতা করেছে এই উপাদানগুলো।এর মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্যার জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে উপজেলায় এসে বিশেষ আইন শৃঙ্খলা মিটিং করে যান। রিটার্নিং অফিসারদের আন্তরিকতায় সেই মিটিং এ ৪৯৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪৯৪ জন উপস্থিত ছিল যা ইতিহাসের বিরল সাক্ষী হয়ে থাকবে। সবাইকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয় জেলা/উপজেলা প্রশাসনের একমাত্র লক্ষ্য সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া। সেদিন থেকেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের নির্দেশনায় নির্বাচন আচরণ বিধির জন্য নিয়োজিত ম্যাজিস্টেট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত ১৫ লক্ষ টাকার অধিক জরিমানা করা হয় পুরো উপজেলায়। সবাইকে সমান অধিকার দেয়া হয় ভোটে অংশগ্রহণের জন্য। উক্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মো: সালেক মূহিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ থাকবে।যতো দিন ঘনিয়ে আসে তত প্রচারণা বৃদ্ধি পায়। বিচ্ছিন্ন গোলযোগের আওয়াজ কানে আসতে থাকে তাই প্রতিদিন দাপ্তরিক কাজের পরে এলাকা পরিদর্শনে বের হওয়া শুরু করি। অফিসার ইনচার্জ, বিজয়নগর এর আন্তরিকতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারেনি কখনোই। এর মধ্যে সকল চেয়ারম্যান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিয়ে মত বিনিময় সভা করি। বারবার সতর্ক করে দেয়া হয় প্রশাসনের শক্ত অবস্থান সম্পর্কে। ব্যালট দখল তো পরের কথা নূন্যতম বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়।প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। এক ইউনিয়নের অফিসারকে সেই ইউনিয়ন থেকে কমপক্ষে ৩ ইউনিয়ন পরে/দূরত্বে ডিউটি দেয়া হয় যেন স্থানীয় লোকজন তাকে প্রভাবিত করতে না পারে। প্রিজাইডিং অফিসারদের ট্রেনিং এ ঘণ্টাব্যাপী ক্লাস নিয়ে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেয়া হয় নির্বাচনের আগের দিন ও পরের দিনের দায়িত্ব/কর্তব্য সম্পর্কে।দেখতে দেখতে নির্বাচন চলে আসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে অনুরোধ করলে এবং বুঝিয়ে বললে স্যার ক্লাস্টার অনুযায়ী ১০ টি ইউনিয়নের জন্য ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেন। এছাড়া বিজিবির সাথে আরো ৩ জন আলাদা ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করেন। নির্বাচন সমন্বয়ের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) স্যারকে উপজেলার দায়িত্ব দিয়ে একদিন আগেই উপজেলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি আমি ছিলাম ব্যাক আপ হিসেবে। সেই ব্যাক আপ নির্বাচনের দিন ৩ টি ইউনিয়নে একযোগে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট যাতায়াতের অসুবিধার কারণে সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে পৌঁছানোর স্বার্থে একটি স্কুলে রাত্রিযাপন করেছেন। এইসকল অবদান স্থানীয় জনগন কখনো ভুলবে না বলে আমার বিশ্বাস। চলে আসে প্রতীক্ষিত ২৬ ডিসেম্বর। নির্বাচনের দিন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্যার নিজেই নির্বাচন দিনের প্রায় অর্ধেক সময় পুলিশ সুপার মহোদয়, অধিনায়ক বিজিবি মহোদয় সহ উপজেলার ১০ টি সেন্টার পরিদর্শন করেন এবং মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলেন। স্যারের এই পরিদর্শন আমাদের নির্বাচনের দায়িত্বরত সকল ম্যাজিস্ট্রেটদের আরো বেশি উজ্জীবিত করে তুলে। দিনশেষে বড় কোনো ঝামেলা ছাড়াই সুন্দরভাবে ভোট গ্রহণ, ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ১০৫ টি কেন্দ্রের কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। জয়ী প্রার্থীদের পাশাপাশি পরাজিত প্রার্থীরা পর্যন্ত প্রশাসনের কর্মতৎপরতার প্রশংসা করছে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছে। পুরুষের চেয়ে মহিলা ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকাটাই প্রমাণ করে কতোটা সুরক্ষিত ছিলো ভোট কেন্দ্রগুলো। বিজয়নগরে নির্বাচনে যেখানে মারামারি আর খুন হওয়া নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠেছিল সেখানে এই নির্বাচনে কেউ গুরুতর আহত পর্যন্ত হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন – ২০২১ কখনোই ভুলবো না। চাকুরী জীবনে ১১টি নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেট এর দায়িত্ব পালন করলেও এই প্রথম পুরো উপজেলার দায়িত্বে থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত ছিলাম। এই অভিজ্ঞতা সামনের দিনে পথচলায় পাথেয় হয়ে থাকবে। বিজয়নগরবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অবিরাম ভালোবাসা। লেখক-এ এইচ ইরফান উদ্দিন আহমেদউপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাবিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়ি Related posts:বই প্রেমিক মানুষ কাজী এমদাদুল হক খোকন কে আরমা দও এমপি র অভিনন্দনবিজয়নগরে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষঅরুয়াইল বাজারে দখলদারদের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি টয়লেটও Post Views: ১১৮ SHARES আইন-আদালত বিষয়: