দানবীর, রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা জন্মদিন বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৩:৪৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৫, ২০২১ ” দানবীর, রায় বাহাদুররণদাপ্রসাদ সাহা “ প্রখ্যাত দানবীর, সমাজসেবক, ভারতেশ্বরী হোমস্, কুমুদিনী হাসপাতাল সহ বহু প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা রণদাপ্রসাদ সাহা। আজকের যুগে তিনি যে কত বেশি প্রাসঙ্গিক, তা বোঝা যায় তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন, নীতি-আদর্শ, অপার মানবিকতা, সমাজচেতনা ও দেশপ্রেমের বিস্ময়কর কাহিনির মধ্য দিয়ে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই আছেন যারা হয়তো তাঁর সম্পর্কে জানেন না। রণদাপ্রসাদ সাহা ১৮৯৬ সালের ১৫ই নভেম্বর ঢাকা জেলার উপকণ্ঠ সাভারের কাছুর গ্রামে মাতুলালয়ে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা পোদ্দার এবং মাতার নাম কুমুদিনী দেবী। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। মাত্র সাত বছর বয়সে রণদার চোখের সামনে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। সন্তান প্রসবের সময় বিনা চিকিৎসায় আর অবহেলায় মারা যান তার মা। উচ্ছ্বল শৈশব থমকে যায় মা’র অকাল মৃত্যুতে। ডানপিটে বালক জীবনের কঠিনতম সময়ে শুরু করেন তখন থেকেই। এই মৃত্যুই সাত বছরের বালকের জীবনের দর্শন বদলে দেয়। মনে মনে সংকল্প করেন- মানুষের জন্য, মানবতার জন্য কিছু করতে হবে। মা মারা যাবার পরে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পড়াশোনার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মামার বাড়ি। কিন্তু, বাঁধাধরা জীবন তার ভালো লাগেনি। তাই মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে যান তিনি। অচেনা-অজানা পরিবেশে পেটের তাগিদে জীবন বাঁচাতে কুলিগিরি, রিকশা চালানো, ফেরি করা, খবরের কাগজ বিক্রির মতো বিচিত্র কাজ করেছেন রণদা। কলকাতায় তখন সারাবাংলা থেকে কাজের সন্ধানে ছুটে আসা ভুখা মানুষের ভিড়। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে এরইমধ্যে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেন তিনি। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ভারত থেকেও অসংখ্য তরুণ যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নাম লিখায়। বাংলার সেই কিশোর যোগ দেয় বাঙালিদের প্রথম সামরিক সংগঠন বা ইউনিট ‘বেঙ্গল এ্যাম্বুলেন্স কোর’-এ। যুদ্ধ শেষে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে রেলওয়ে বিভাগের টিকিট কালেক্টরের চাকরি নেন। ১৯৩২ সালে এই চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। নিজের সঞ্চয় করা ও অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে শুরু করেন লবণ ও কয়লার ব্যবসা। বছর চারেকের মধ্যেই ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৩৯ সালে জমিদার নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী, ডা. বিধান চন্দ্র রায়, বিচারপতি জে. এন. মজুমদার ও নলিনী রঞ্জন সরকারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ নামে একটি নৌ-পরিবহণ কোম্পানি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি কোম্পানির একক মালিকানা লাভ করেন। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। তিনি নারায়ণগঞ্জে একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ করেন। এ অঞ্চলে এটিই প্রথম ডকইয়ার্ড। সেখানে বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের লঞ্চ ছাড়াও অন্যান্য কোম্পানির এবং ব্যক্তিগত লঞ্চও মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। দেশ বিভাগের আগেই রণদা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি চাকরি শুরু করেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে অসুস্থ ও আহতদের সেবাদানের মাধ্যমে। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার পরও তিনি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবা প্রদান অব্যাহত রাখেন। ১৯৪০ সালে রণদা নারায়ণগঞ্জের জর্জ অ্যান্ডারসনের যাবতীয় পাট ব্যবসা কিনে নেন। পাট মজুদের জন্য তিনি পাটকল সংলগ্ন বেশ কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করেন।এভাবেই সেই হতভাগ্য কিশোর হয়ে উঠেন দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একজন। ১৯৩৮ সালে মাতামহীর নামে শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারি ও মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৪২ সালে তার প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে ‘ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ’ স্থাপন করে ঐ অঞ্চলে নারীশিক্ষার সুযোগ করে দেন যা পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে ভারতেশ্বরী হোমস-এ রূপলাভ করে। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ স্থাপন করেন। তিনি মীর্জাপুরে ডিগ্রী মহিলা কলেজ ও কুমুদিনী মহিলা কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আড়াই শতাধিক লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন তিনি। রণদা প্রসাদের আহ্বানে ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড আর জি কেসি কলকাতা থেকে নদীপথে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এক অজোপাড়া গাঁয়ে এসে কুমুদিনী হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সংকটময় সময়ে রণদা রেডক্রসকে আড়াই লাখ রূপি দান করেন। ১৯৪৭ সালে রণদা তার সব ব্যবসা, কল-কারখানা, সম্পত্তি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার জন্য ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ গঠন করেন। ১৯৫৩ সালে কুমুদিনী হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা চালু হয়। বাংলাদেশে এখানেই প্রথম ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে তখন অসংখ্য মানুষ এই অঞ্চল থেকে স্রোতের মতো দেশান্তরী হয়ে পশ্চিম বাংলায় যান। কিন্তু, সেই সময় কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যের পাঠ চুকিয়ে সেখানকার অঢেল সম্পদের মায়া ত্যাগ করে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রণদা নিজের মাতৃভূমিতে পাকাপাকিভাবে ফিরে আসেন। ব্রিটিশ সরকারকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানের জন্য রণদা ১৯৪৪ সালে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব প্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার সমাজসেবার জন্য তাকে ‘হেলাল এ পাকিস্তান’ খেতাব প্রদান করে। পূর্ববাংলার প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে তিনি সেই খেতাব গ্রহণ করেননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে শুভাকাঙ্ক্ষীরা রণদা প্রসাদ সাহাকে দেশত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু, মাতৃভূমি ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে রাজি হননি। ১৯৭১ সালের ৭ মে। পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা মির্জাপুর থেকে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর, তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। দৃশ্যত, তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানগুলো জানান দেয় তিনি আছেন। কুমুদিনীতে এলে ঘুচে যায় মনের অনেক দীনতা, অনেক বৈকল্য। রণদাপ্রসাদ ছিলেন উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী এক বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ। ১৯৭৮ সালে রণদা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাব স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান। ১৯৮৪ সালে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও সমাজ সেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ করে। সারা জীবনের অর্জিত সব সম্পদ মানবকল্যাণে বিলিয়ে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মানবজীবনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। একজন সংগ্রামী, আত্মপ্রত্যয়ী মানবসেবক এই মহান মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাই। Related posts:ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন ড. ফারুক আহমেদমানিকগঞ্জের সিংগাইর থানায় নবাগত ইন্সপেক্টর তদন্ত হিসেবে যোগদান করেছেন সুমন কুমার আদিত্যস্মৃতিতে শেখ কামাল ও ৭৫ পরিবর্তী ঘটনা শীর্ষক গ্রন্তের প্রকাশনা উৎসবে মোকতাদির চৌধুরী এমপি Post Views: ১৫২ SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: