আজ তেভাগা আন্দোলনের নেএী ইলা মিএের প্রয়ান দিবস বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ১১:০১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৩, ২০২১ মিত্র নারী আইন করিল জারী আধি জমি ত্রিফুটি ভাগ জিন হলো সাত আড়ি ভাই জিন হলো সাত আড়ি । কবি কন্ঠে ইলা মিত্রের মহিমা ধ্বনিত হয়েছে এভাবেই। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার আদায়ে এগিয়ে এসেছিলেন যিনি তিনি ইলা মিত্র, বাংলার কৃষকের রাণীমা। অভাবী আর বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে বিসর্জন দিয়েছিলেন নিজের জীবনের সব সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য। তবু নিজের আদর্শ থেকে পিছপা হননি এতটুকু। সংগ্রামী এই নারী আমৃত্যু লড়াই করেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা জীবন ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্র ছিলেন ইলা সেন। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বৃটিশ সরকারের অধীন বাংলার একাউন্টেন্ট জেনারেল। তাঁদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকুরির সুবাদে তাঁরা সবাই কলকাতায় থাকতেন। এ শহরেই তিনি বেড়ে ওঠেন, লেখাপড়া করেন কলকাতার বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৪সালে স্নাতক শ্রেণীতে বি.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। কৈশোরে তিনি খেলাধুলায় তুখোড় ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র এ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায়ও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অণুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল হয়ে যাওয়ায় তার অংশগ্রহণ করা হয়নি। খেলাধুলা ছাড়াও গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। রাজনীতিতে প্রবেশ ইলা সেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বি.এ. সম্মানের ছাত্রী তখন থেকেই রাজনীতির সাথে তাঁর পরিচয় হয়। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল, ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন৷ রাওবিল বা হিন্দু কোড বিল এর বিরুদ্ধে সে বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে করতে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। বিবাহ ও কর্ম জীবন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জমিদার মহিমচন্দ্রের পুত্র রমেন মিত্রের সাথে ১৯৪৫ সালে ইলা মিত্রের বিয়ে হয়। জমিদারি রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হয়েও উদারপন্থী ইলা মিত্রের স্বস্তি ছিল না। তিনি সবসময় এই পরিবেশ থেকে মুক্তি চাইতেন মনে মনে।পরবর্তীতে স্বামী রমেন মিত্রের সহযোগিতায় গ্রামের নিরক্ষর মেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছিয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেন। ইলা মিত্রের স্বামীও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ সদস্য হয়েছিলেন। এজন্য তাদের দুজনকে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পোহাতে হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। এ অপপ্রচার নির্যাতিত কৃষকের আরো কাছে এনে দিয়েছে ইলা মিত্রকে। গরিব কৃষকরা যাতে তাদের ন্যায় অধিকার আদায় করতে পারে, আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং সেই আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারেন সেজন্য তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ইলা মিত্র এক সংগ্রামের নাম। এক বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধির নাম। এক মানবতাবাদী নারীর নাম। যিনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বেচ্ছায় জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। তবুও থেমে যায়নি তার আদর্শের লড়াই। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন এই সংগ্রামী মহিয়সী নারী। শত অত্যাচার নীরবে সহ্য করে গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়ে শোষিতের পাশে দাঁড়িয়েছেন আবার শিক্ষকতা করে অগণিত শিক্ষার্থীকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে সে সময়ের ভূমি ব্যবস্থা বিষয়ে জানা প্রয়োজন। বাংলার গ্রামীণ সমাজে বৃটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন চাষিরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা এক তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। বৃটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষিদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী বৃটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সাথে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। এই জোতদার শ্রেণি কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করতো। ফসল উত্পাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো ‘আধিয়ারী’। জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বস্বান্ত হয়ে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর ক্ষেত মজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় ‘ফ্লাউড কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজ্ঞা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের ‘তোলা’ ও ‘লেখাই’ সহ নানা কর আদায় করা হতো। এসব বন্ধের জন্য আন্দোলন জোরদার হয়। এদিকে যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, চব্বিশ পরগণা, খুলনাসহ মোট ১৯টি জেলায় আন্দোলন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লেও তীব্র হয়ে ওঠেনি পূর্ববাংলায়। অনেক ভূমিমালিক স্বেচ্ছায় কৃষকদের তেভাগা অধিকার দিতে রাজি হন। ১৯৪৮-৫০ সালে দ্বিতীয় দফায় তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার আর পাঁচটা আন্দোলনের মতোই তেভাগা আন্দোলনকেও ভারতের ষড়যন্ত্র বলে খেতাব দেয়। ইলা মিত্র ছিলেন এই সময়ের প্রধান পথ প্রদর্শকদের একজন। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার-নিপীড়ন চালানো হয়। এজন্য ইলা মিত্র ও তার স্বামীকে আত্মগোপনে থাকতে হয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র ও রমেন মিত্র। ছত্র ভঙ্গ কৃষকদের সংগঠিত করতে ইলা মিত্র ছুটে যান গ্রাম থেকে গ্রামে। ১৫০ জন কৃষককে পুলিশ হত্যা করে। নাচোল কৃষক আন্দোলন চিরতরে বন্ধ করে দিতে শাসকগোষ্ঠী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ইলা মিত্রের একনিষ্ঠ আত্মত্যাগের ফলে সাঁওতালদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে উঠে। তিনি তাদের প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ দেন। শাসক গোষ্ঠী যখন সাঁওতাল অধ্যুষিত চন্ডিগড় গ্রামকে লক্ষ্য করে ১৯৫০ সালে অভিযান শুরু করে, তখন ইলা মিত্র সেখানেই ছিলেন। তেভাগার বিদ্রোহীরা এ গ্রামে লুকিয়ে আছে এমন খবর পেয়ে ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ গ্রামে হানা দিয়ে তেভাগা আন্দোলনে জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করতে আসে দুজন কৃষককে। কিন্তু তখন সারা গ্রামেই জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। গ্রামের কৃষকদের ভয় দেখাতে গুলি ছুঁড়লে মৃত্যু হয় এক কৃষকের। উত্তেজিত গ্রামবাসী হত্যা করে ৬ জন পুলিশকে। শুধু এটার অপেক্ষাতেই যেন এতদিন বসেছিল সরকার। পুলিশ মিলিটারী মিলে ৭ জানুয়ারি গ্রাম ঘেরাও করা হয়, শেষমুহুর্তে দলবলসহ ধরা পড়ে যান ইলা মিত্র। গ্রেফতার করার পর তার উপরে চলে পাশবিক নির্যাতন। এমনকি গণধর্ষণও বাদ যায়নি। ইলা মিত্রের জবানবন্দি বইটিতে ইলা মিত্র বলেছেন- “প্রচণ্ড তর্জন গর্জনে শব্দ শুনে চমকে উঠলাম, চেয়ে দেখি, হরেককে দলের মধ্য থেকে মারতে মারতে বার করে নিয়ে আসছে। ওদের মুখে সেই একই প্রশ্ন, বল, ইলা মিত্র সে-ই পুলিশদের হত্যা করবার আদেশ দিয়েছিল। না বললে মেরে ফেলব, একদম মেরে ফেলব। আমি চেয়ে আছি হরেকের মুখের দিকে। অদ্ভুত ভাববিকারহীন একখানি মুখ। অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে আছে। ওদের এতসব কথা যেন ওর কানেই যাচ্ছে না। ক্ষেপে উঠল ওরা। কয়েকজন মিলে ওকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। তারপর বুট দিয়ে বুকে পেটে সজোরে লাথি মেরে চলল… আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হরেক। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। একটু আগেই আমি কেঁদেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সমস্ত কান্না শুকিয়ে গেছে। তার পরিবর্তে ভিতর থেকে প্রচন্ড একটা জেদ মাথা তুলে জেগে উঠেছে। আমার মন বলছে, মারুক, মারুক, ওরা আমাকেও এমনি করে মারুক। আর মনে হচ্ছে, এই যে আমাদের কয়েকশো সাথী এদের কাউকে দিয়ে ওরা কথা বলাতে পারবে না, কিছুতেই না। ওদের হার হয়েছে। ওদের হার মানতে হবে।” অস্ত্রে সজ্জিত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে তীর ধনুকে সজ্জিত সাঁওতাল, হিন্দু ও মুসলিম কৃষকদের বেশিক্ষণ যুদ্ধ চালানো সম্ভব ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামবাসী পিছপা হতে শুরু করেন। যে যেদিক পারলেন গা ঢাকা দিলেন। গ্রামবাসী সরে যাওয়ার পর আন্ডার গ্রাউন্ডের নেতাদের অবস্থান বের করা সহজ হয়ে যায়। রমেন্দ্র মিত্র ও মাতলা মাঝি পালিয়ে ভারতে চলে যান। ইলা মিত্র ৭ জানুয়ারি সাঁওতাল বেশ ধারণ করে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ভারত সীমানা পার হওয়ার প্রস্তুতিকালে ইলা মিত্র ও তাঁর সঙ্গীরা রোহনপুর রেলওয়ে স্টেশনে ধরা পড়ে যান। তাঁদের ধরে আনা হয় নাচোল স্টেশনে। পুলিশ শুরু করে পাশবিক অত্যাচার। ইলা মিত্র ও তাঁর সাথীদের উপর্যুপরি নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো। কারণ যেভাবেই হোক স্বীকার করাতে হবে পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবল হত্যার পিছনে তাঁদের ইন্ধন ও পরিকল্পনা ছিল। নাচোল স্টেশনে ইলা মিত্রর সাথীদের মধ্যে আনুমানিক ৫০ থেকে ১০০ জন পুলিশী নির্যাতনে মারা যান।বন্দী জীবন: অমানুষিক নির্যাতন ভোগ কমরেড ইলা মিত্রর ওপরও পাশবিক নির্যাতন চালানো হলো। নারী হিসাবে তাঁকে সামান্য সম্মান দেখানো হয়নি বরং একজন নারী, তার ওপর তিনি হিন্দু-কমিউনিস্ট নারী, এজন্য অত্যাচারের মাত্রা ছিল আরো বেশি। তিনি অস্ত্র হাতে তেভাগা আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন এ কারণে পুলিশের আক্রোশ তাঁর উপর বেশি ছিল। পুলিশ অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁর স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে।কলকাতায় আন্দোলনের সময় বন্দি ইলা মিত্র টানা চার দিন অত্যাচারের পর নাচোল স্টেশন থেকে ইলা মিত্রকে নবাবগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে আনা হয়। সে সময় তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরছিল, গায়ে ছিল অসহনীয় জ্বর। ইলা মিত্রর ওপর যেসব অত্যাচার চালানো হয় তার মধ্যে ছিল- বাঁশকল, শরীরের নাজুক অংশে বুটের আঘাত, বিবস্ত্র করে প্রহার, অনাহারে রাখা, ধর্ষণ, আপত্তিজনক মন্তব্য ইত্যাদি। ইলা মিত্রকে নিয়ে এরপর শুরু হয় আইনের খেলা। সরকারের পক্ষ থেকে ইলা মিত্র, রমেন্দ্র মিত্র ও মাতলা মাঝি (ইলা মিত্রকে গোপনে সাঁওতালদের প্রশিক্ষণ দিতে সহায়তাকারী) কে প্রধান আসামী করে এবং শতাধিক সাঁওতাল কৃষকের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি রাজশাহী কোর্টে উঠে। এটাই কুখ্যাত ‘নাচোল হত্যা’ মামলা। রাজশাহী আদালতে ইলা মিত্র ইংরেজিতে লিখিত যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা থেকে তাঁর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে সে বিষয়ে জানা যায়। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘বিগত ০৭.০১.৫০ তারিখে আমি রোহনপুর থেকে গ্রেপ্তার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল থানা হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। কিন্তু পথে পাহারাদার পুলিশরা আমার ওপর অত্যাচার করে। নাচোলে ওরা আমাকে একটা সেলের মধ্যে রাখে। সেখানে একজন পুলিশের দারোগা আমাকে এ মর্মে ভীতি প্রদর্শন করে যে, আমি যদি হত্যাকান্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি না করি, তাহলে ওরা আমাকে উলঙ্গ করবে। আমার যেহেতু বলার মত কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার পরনের সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় সেলের মধ্যে আটকে রাখে। আমাকে কোন খাবার দেওয়া হয়নি। এমন কি এক বিন্দু জলও না। ঐ সন্ধ্যায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এসআইএর উপস্থিতিতে সিপাইরা এসে বন্দুকের বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে।অত্যাচারের চিহ্ন সারাজীবন বয়ে চলেছেন শরীরে সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর ওরা আমার পরনের কাপড় চোপড় ফেরত দেয়। রাত প্রায় বারোটার সময় আমাকে বের করে সম্ভবত এসআইএর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি খুব বেশি নিশ্চিত ছিলাম না। আমাকে যে কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে আমার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ওরা নৃশংস ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে ওরা আমার পা দুটোকে লাঠির মধ্যে রেখে ক্রমাগতভাবে চাপ দিতে শুরু করে। ওদের ভাষায় আমার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী ইনজেকশন পন্থায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল। এ ধরনের অত্যাচার চলার সময় ওরা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে রেখেছিল এবং আমার চুল ধরেও টান দিচ্ছিল। কিন্তু আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক কিছুই বলাতে সক্ষম হয়নি। এতসব অত্যাচারের দরুণ আমার পক্ষে আর হেঁটে যওয়া সম্ভব ছিল না। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে নিয়ে গেল। এবার পুলিশের সেই দারোগা সিপাহীদের ৪টা গরম ডিম আনার নির্দেশ দিয়ে বলল যে, এবার মেয়েটাকে কথা বলতেই হবে। তারপর শুরু হল নতুন ধরনের অত্যাচার। ৪/৫ জন সিপাহী মিলে জোর করে আমাকে চিত্ হয়ে শুতে বাধ্য করল এবং ওদের একজন আমার গোপন অঙ্গ দিয়ে একটা ডিম ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। সে এক ভয়াবহ জ্বালা। প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করলাম, আমার ভিতরটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে আমার জ্ঞান ফিরে এলো। একটু পরে জনাকয়েক পুলিশ সঙ্গে করে আবার সেই দারোগার আগমন ঘটে। সেলে ঢুকেই সে আমার তলপেটে বুট দিয়ে প্রচন্ড জোরে লাথি মারে। আমি দারুণ ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। এরপর ওরা জোর করে আমার ডান পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দিল। আমি তখন অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছি। কোন রকম স্বীকারোক্তি না পেয়ে দারোগা তখন রাগে অগ্নিশর্মা। যাওয়ার আগে বলে গেল, আমরা আবার রাতে আসব। তখন তুমি স্বীকারোক্তি না দিলে, একের পর এক সিপাহী তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাতে দারোগা আর সিপাহীরা আবার এলো এবং আবারো হুমকি দিল স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি তখনও কিছু বলতে অস্বীকার করলাম। এবার দু জন মিলে আমাকে মেঝেতে ফেলে ধরে রাখল এবং একজন সেপাহী আমাকে রীতিমত ধর্ষর্ণ করতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম’ (তথ্যসূত্র: ড. নিবেদিতা দাশপুরকায়স্থ, মুক্তিমঞ্চে নারী, প্রিপ ট্রাস্ট, ১৯৯৯, ঢাকা)। বন্দি জীবন শেষে নতুন অধ্যায় নাচোল হত্যা মামলার রায় প্রদান করে ইলা মিত্রকে রাজশাহী জেলে প্রেরণ করা হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করা হলে শাস্তির মেয়াদ ১০ বছর কমিয়ে দেয়া হয়। পুলিশের নির্যাতনে তখন ইলা মিত্রের শারীরিক অবস্থা শঙ্কটাপন্ন। ১৯৫৩ সালে তাঁকে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৫৪ সালে কমরেড ইলা মিত্রের চিকিত্সার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আনা হয়। তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ পুলিশী নির্যাতনের ভয়াবহতা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন।১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসলে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হকের নির্দেশে ইলা মিত্রের ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য গঠিয় একটি মেডিকেল টিমের সুপারিশে বলা হয়, ইলা মিত্র নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। এসবের চিকিত্সা পূর্ব-বাংলায় সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রী এই সুপারিশের ভিত্তিতে নির্দেশ দেন, নাচোল হত্যা মামলার অন্যতম সাজাপ্রাপ্ত আসামী ইলা মিত্রকে বিদেশে চিকিত্সার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হলো। ইলা মিত্রকে ভারতে প্রেরণের জন্য অর্থ এবং পাসপোর্ট সংগ্রহে পূর্ব-বাংলার বামপন্থী নেতারা এগিয়ে এসেছিলেন। পাসপোর্ট তৈরিতে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সাহায্য করেন এমনকি ভারত যাওয়ার প্রাক্কালে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ইলা মিত্রর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।কলকাতা মেডিকেল কলেজে দীর্ঘ আটমাস চিকিত্সাধীন ছিলেন ইলা মিত্র। তিনি একমাত্র পুত্র রণেন মিত্র মোহনের মুখ দেখেন দীর্ঘ ছয় বছর পর। শোষিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মাতৃত্বকে ত্যাগের এই দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল।এরপর শুরু হয় ইলা মিত্রর জীবনের নতুন অধ্যায়। সুস্থ হয়ে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন।শিক্ষকতার পাশাপাশি ইলা মিত্র পশ্চিম বঙ্গের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির জেলা ও প্রাদেশিক কমিটির সদস্য ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বিভিন্ন নারী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে তাকে আবারো কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক আন্দোলনের অগ্রপথিক। তাকে থামানো যাবে না। এজন্য তিনি চারবার বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ইলা মিত্র কলকাতায় স্বামী রমেন্দ্র মিত্র, একমাত্র পুত্র রণেন মিত্র, পুত্রবধু ও নাতি ঋতেনকে নিয়ে জীবনের শেষ সময় কাটিয়েছেন। উপমহাদেশের নারী জাগরণ ও কৃষক আন্দোলনের এই কিংবদন্তি নেত্রী ৭৭ বছর বয়সে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। আমৃত্যু নিজেকে বাংলাদেশীই ভেবে এসেছেন তিনিশত অত্যাচার নির্যাতনকে উপেক্ষা করে জমিদারের গৃহবধূ সাদামাটা জীবন কাটিয়েছেন। অকাতরে বঞ্চিতদের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। শত শত বিঘা জমি দান করে গেছেন কৃষকদের নামে। তার বসতবাড়ি আজ ভূমিদস্যুদের দখলে। তবু বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কৃষক আন্দোলনের নাম যতবার উচ্চারিত হবে ততবার তেভাগার রানীমা ইলা মিত্রের কথা উঠে আসবে। Related posts:বিজয়নগরেে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের বার্ষিক বনভোজন অনুষ্ঠিতবিজয়নগরে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার ৯২তম জন্মদিন পালনমুকুন্দপুর মুক্ত দিবস পালিত Post Views: ২৯৫ SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: