বাঙ্গালি বীর বিপ্লবী বাঘা যতীনের ১০৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৩:৩৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২১ ” বাঙ্গালির বিপ্লবী চেতনারএক অনন্য নাম বাঘা যতীন” ১৯১৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর আজকের এই দিনে ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে গুরুতর আহত ও আটক অবস্থায় বালেশ্বরের একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এক বাঙ্গালি বীর বিপ্লবী বাঘা যতীন। মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশ কমিশনার টেগার্ট বলেছিলেন - "I have met the brevest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty." ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক একজন বাঙ্গালি বিপ্লবীর নাম বাঘা যতীন। হলদিঘাট বুড়ি বালামের তীরের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।কোন অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই খালি হাতে বাঘ হত্যা করার পর তাঁকে বাঘা যতীন নামে অভিহিত করা হয়। বাঘা যতীনের আসল নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন নদীয়া বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে মামার বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ জেলার রিসখালী গ্রামে। বাবার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম শরৎশশী। খুব ছোটবেলায় যতীন তার বাবাকে হারায়। যতীনের মা বিধবা শরৎশশী দেবী ছিলেন স্বভাবকবি। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার পেছনে তার মা শরৎশশীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৮৯৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর তিনি সাঁটলিপি ও টাইপ শেখেন এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের স্টেনোগ্রাফার নিযুক্ত হন। এই সময়েই তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্যে আসেন এবং বিবেকানন্দ তাঁকে শরীরচর্চা শিক্ষার জন্য অম্বুগুহের কুস্তির আখড়ায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে যতীন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন এবং দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে; গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত জীবনী লেখক পণ্ডিত যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণের পুত্র মোহন বাগান ফুটবল ক্লাবের ক্যাপ্টেন শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে আসেন। শচীন তার পিতা পণ্ডিত যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণের সাথে যতীনের পরিচয় করিয়ে দেন, যার প্রভাবেই তিনি দেশের কাজে ব্রতী হন। এসময় সিস্টার নিবেদিতার সহযোগী হিসেবে যতীন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা ও সমাজ সেবামূলক কাজও শুরু করে দেন। ১৯০০ সালে যতীন ব্যারিস্টার কেনেডীর সুপারিশে বাংলা সরকারের অর্থসচিব হেনরি হুইলারের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে ১২০ টাকা বেতনের একটি চাকুরী পেয়ে আবার কলকাতায় চলে আসেন। ওই বছর তিনি ইন্দুবালাকে বিয়ে করেন। তাঁদের পরিবারে ৪টি সন্তানের জন্ম হয় - অতীন্দ্র, আশালতা, তেজেন্দ্র, ও বীরেন্দ্র। বেঙ্গল গভর্ণমেন্টের চাকরীসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে হত যতীনকে। তেমনই এক সফরে ১৯০৮ এপ্রিল মাসে দার্জিলিং এর পথে শিলিগুড়ি ষ্টেশনে প্রথমে তর্ক তারপর হাতাহাতি এবং একা হাতে উত্তম মধ্যম দিয়ে গুর্খা বাহিনীর ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সামারভিল সহ ৪ ইংরেজ সদস্যের চোয়াল ভেংগে ধরাশায়ী করে দিলেন। এই অপরাধে যতীনের নামে মামলা হলে সারাদেশে সাড়া পড়ে যায়! খবরের কাগজে এই নিয়ে লেখালেখি হলে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে। ঠাট বজায় রাখতে ম্যাজিস্ট্রেট যতীনকে শাসিয়ে দেন, "এমনটি আর যেন না ঘটে!" দর্পভরে যতীন জবাব দেন: "নিজের সম্মান বা দেশবাসীর সম্মান বাঁচাতে যদি প্রয়োজন হয়, এমনটি যে আবার করব না, এ শপথ আমি করতে অপারগ।" এই ঘটনার পর হেনরি হুইলারের একদিন ঠাট্টা করে যতীনকে জিজ্ঞাসা করেন: "আচ্ছা, একা হাতে ক'টা লোককে আপনি শায়েস্তা করতে পারেন?" হেসে যতীন বলেন, "ভাল মানুষ হয় যদি, একটাও নয়: দুর্বৃত্ত হলে যতগুলি খুশি সামলাতে পারব।" একবার ফোর্ট উইলিয়ামের কাছে গোরাবাজারে অন্যায় কাজের জন্য এক গোরা সৈন্যকে বেধড়ক পিটুনি দিয়েছিলেন যতীন। ১৯০৩ সালে অরবিন্দের সাথে পরিচিত হয়ে যতীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। অরবিন্দ ঘোষের সাথে যতীন, যোগেন্দ্রনাথ, লোলিতনাথ চট্যোপাধ্যায় ভারত মুক্তির উপায় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ পান এসময়ই। মনে করা হয় এই সমস্ত আলোচনারই ফল “যুগান্তর”। বাঘা যতীন সরকারি চাকরিরত অবস্থায় অত্যন্ত সুকৌশলে ও গোপনে বিপ্লবী সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। “যুগান্তর” দলে কাজ করার সময় সম্ভবতঃ ১৯০৬ সালে এম.এন রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯০৫ সালে দেশব্যাপী শুরু হওয়া বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যতীন্দ্রনাথ নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে। তিনি বাংলার সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল যুগান্তর; এবং পরে বিপ্লববাদী দলের প্রধান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯০৮ সালে আলীপুর বোমা হামলা মামলার তদন্তকারী বিখ্যাত সিআইডি অফিসার শামসুল আলমকে গুলি করে হত্যা করার পর যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়। ১৯০৮ সালে কলকাতার মানিকতলায় গোপন বোমার কারখানার বিপ্লবীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।পরবর্তীতে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এক সময় বাঘা যতীনের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর এলাকায় যাতায়াত করতে হতো। মূলত ব্যবসার আড়ালে তিনি ইংরেজ বিরোধী একটি বিপ্লবী দল গঠন করেন। যশোরের নলডাঙ্গা বলরামপুরে তিনি বিপ্লবের কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯১৪ সালে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ চালিয়ে গেলেন সর্বাধিনায়ক যতীন। গোপনে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হল। দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হল। সংগ্রহ করা হল বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ১৯১৫ সালে সর্বাধিনায়ক যতীন সমগ্র ভারত নিয়ে একটি বিপ্লবের চিন্তা করেন। তিনি রাসবিহারী বসু ও শচীন্দ্রনাথ স্যানালের সহযোগিতায় বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের “জাতীয় অভ্যূত্থানের” জন্য অনুপ্রাণিত করে তাঁদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কলকাতাস্থ জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি যতীন মুখোপাধ্যায়ের নিকট একজন দূত পাঠান। যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের কমান্ডার-ইন-চিফ করা হয়। যতীনকে বালেশ্বরে (উড়িষ্যা) গুপ্ত অবস্থায় রেখে নরেন বাটাভিয়া যান এবং সেখানে জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাহাজে অস্ত্র প্রেরণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ে আলোচনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বুড়িবালাম নদীর তীরে চার সহযোগী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন যতীন। উদ্দেশ্য জার্মান অস্ত্র ব্যবহার করে বালেশ্বর রেললাইন দখল করে ব্রিটিশ সৈন্যদের মাদ্রাজ থেকে কলকাতা ভ্রমণ বন্ধ করা। কিন্তু গ্রামবাসীর কাছে ততক্ষণে যতীনকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কারের ঘোষণা পৌঁছে গেছে। পুলিশ ধানক্ষেতের পাশে যতীনের গুপ্ত আশ্রয়ের সন্ধান পায়। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক গুলি বিনিময়ের পর কয়েকজন বিপ্লবী হতাহত হন। পুলিস অন্য দের সাথে যতীনকে গুরুতর আহত অবস্থায় আটক করে। আহত দুজনের একজন ছিলেন মাদারিপুরের চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, যার কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু হয়। বিপ্লবী যতীন গুরুতর আহত অবস্থায় উড়িশ্যায় বালেশ্বর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সকালে ৩৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন! হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে; তখনো তাঁর রক্তবমি হচ্ছে। হেসে বললেন- "এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।" বিপ্লবী বাঘা যতীনের হলদিঘাট বুড়ি বালামের তীরের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন - “বাঙালির রণ দেখে যা তোরারাজপুত, শিখ, মারাঠী জাতবালাশোর, বুড়ি বালামের তীরনবভারতের হলদিঘাট।” মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার ও শোষণমুক্তির আন্দোলন যতদিন চলবে ততদিন বাঘা যতীন বেঁচে থাকবেন মানুষের মাঝে। বেঁচে থাকবেন যুগ-যুগান্তরের ইতিহাসে। মানুষের চেতনায় ও কর্মে। আজ এই মহান বিপ্লবী নেতার ১০৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিপ্লবী এই মহান নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। Related posts:মেহেরপুরে যুবলীগের দুই নেতাকে গলা কেটে হত্যাকসবায় পশুর হাটে গরু রাখার জায়গা নিয়ে সংঘর্ষে নিহত একসাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী Post Views: ৩৬৮ SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: