করোনা পরিস্থিতি : জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা চাই

প্রকাশিত: ৯:৫১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩, ২০২১

এম. এম. আকাশ

বাংলাদেশ মহামারীর মধ্যে আছে। দীর্ঘ এক বছরেরও কিছু বেশি সময় জুড়ে সারা বিশ্বে এই মহামারী চলছে। কেউই আমরা এর প্রভাব থেকে একদম মুক্ত থাকতে পারছি না। অতীতে এরকম মহামারী আমাদের দেশে আরো হয়েছিল। যেমন, কলেরা, প্লেগ, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধিতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হতে অতীতেও আমরা দেখেছি। কিন্তু কখনো এত দীর্ঘস্থায়ী ও বিশ্বব্যাপী এত বিস্তৃত মহামারী দেখা যায়নি। তাছাড়া তখন দেশে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র ছিল না। মানুষ বাধ্য হয়ে ওলা বিবির পুজা দিতেন বা পীরের দরগায় সিন্নি দিতেন। তবে এবার করোনার স্মৃতি ও প্রভাব দীর্ঘ দিন বিশ্বকে বহন করতে হবে বলে মনে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে একবিংশ শতকে বিশ্ব যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বার প্রান্তে কড়া নাড়ছে তখন কেন এবং কীভাবে এই রোগ এত ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। গভীরভাবে আজ তা ভেবে দেখতে হবে এবং এর একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বার করতে হবে। মানবিক এবং শ্রেণিগত উভয়প্রকার সমাধানের প্রয়োজন হবে। বর্তমান পরিস্থিতির অনিশ্চিত ভয়াবহতা প্রথমতঃ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এখনো আমরা বলতে পারছি না যে এর কোনো শীঘ্র তড়িৎ সমাধান সম্ভব। মহামারীর প্রকোপটা এখানে ঢেউয়ের মত ছড়াচ্ছে, কোথাও কমছে, কোথাও বাড়ছে। একদম চলে গিয়েও আবার ফিরে আসছে। সে জন্য সকল শ্রেণির মানুষই এখনো অসহায় বোধ করছেন, অনিশ্চিত ভয়ে ভুগছেন, সমস্যাকে মনে করছেন ভয়াবহ জটিল এবং খুবই অস্পষ্ট। এরকম অনিশ্চিত অসহায় অবস্থাতেই ধর্মের প্রভাব ক্রমশঃ বেড়ে যেতে থাকে। ইংরেজিতে এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে VUCA (Vulnerable, Uncertain Complex and Ambiguous) কিন্তু শ্রেণিগত ভাবে অনুন্নত দেশের দরিদ্র মানুষেরা বলছেন, এই মহামারীর ভয়ে ঘরে বসে থাকলে তো আমাদের চলবে না, এভাবে আমাদের খাবার জুটবে না। তখন তো মহামারীতে না মরলেও তিলে তিলে না খেয়ে আমাদের মরতে হবে। সুতরাং এই মহামারী (কেউ কেউ অবশ্য বলেন-“অতিমারী”) মানুষকে এক কঠিন কুটাভাষের (dilemma) মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সে জীবনকে রোগ থেকে রক্ষা করতে চাইলে জীবিকাকে সে রক্ষা করতে পারছে না। আর জীবিকাকে রক্ষা করতে গেলে রোগে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। মহামারী থেকে যাতে দ্রুত পরিত্রাণ মেলে সে জন্য দুরকম পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তার বিশেষজ্ঞরা। একটি পদ্ধতি হচ্ছে মহামারী নিরোধক পদ্ধতি (Preventive Method) আরেকটি পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে মহামারীর প্রতিষেধক (Curative Method) পদ্ধতি। সমাধান কোন পথে? পৃথিবীতে ধুলা থেকে পদযুগলকে রক্ষা করার জন্য যেমন জুতা দিয়ে যার যার পা ঢেকে দিলেই চলে, সারা পৃথিবীকে চামড়া দিয়ে মুড়ে দেওয়ার দরকার হয় না, তেমনি চীনের যেই বাজারে বা পরবর্তীতে পৃথিবীর যে সব জায়গায় এই করোনা জীবানুর জন্ম হয়েছিল–তাকে বিচ্ছিন্ন করে কোয়ারেন্টাইনে রেখে দিলেই তো এটা ছড়াতো না–এরকম যুক্তি দেওয়া যায়। এই সূত্র ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরবর্তীতে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, চীনের ল্যাবরেটরিতে গবেষণা থেকেই এই জীবানুর অপ্রত্যাশিত জন্ম বা সৃষ্টি হয়েছে। এই ভাবে বিশ্বের সামনে চীনকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যুক্তিরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে বাণিজ্যিক অবরোধের মধ্যে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। এই ভাবে করোনা মহামারী পৃথিবীর ভূ-রাজনীতিতে তীব্র উত্তেজনা ও নতুন মেরুকরণের সূচনাও করেছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈজ্ঞানিকেরা নানা তদন্ত করে পরবর্তীতে মত দিয়েছেন যে এই অভিযোগ অমূলক। সুতরাং বিশ্বকে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছে যে পরস্পর বিরোধীতা ও অভিযোগ করে এ সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং এতে মরার উপর খাঁড়ার ঘার মত উত্তেজনা বাড়বে ও এমনকি তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধেরও সূচনা হতে পারে। অবশ্য চরমপন্থী পাগলা ট্রাম্পের পরাজয়ের পর এবং চীনের শি পিং কর্তৃক কঠোর অবস্থান গ্রহণ এবং বিশেষতঃ চীনের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার কারণে সেই আশংকা বর্তমানে কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। মানবমুক্তি ও বৈশ্বিক প্রকৃতির সুরক্ষার জন্য শুভবুদ্ধি ও শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বকে এখন চিন্তা করতে হচ্ছে কিভাবে মহামারীর বিস্তৃতি ও সংক্রমণ বোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠোর ট্র্যাডিশানাল ধনীবান্ধব একটি চরম পদ্ধতি হচ্ছে “কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি”। যাদের যথেষ্ট সঞ্চয় ও ধন সম্পদ আছে তারা হয়তো নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও গৃহবন্দী রেখেও বেঁচে থাকতে পারেন, কিন্তু যাদেরকে রোজগার করে খেতে হয়, যারা দিনমজুর এবং যারা অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী, যাদের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা সেবার বা আর্থিক নগদ তহবিলের সুবিধা নেই, তাদের পক্ষে এভাবে বেশি দিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তদুপরী যতদিন যাবে উৎপাদনে ঘাটতির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বিশেষতঃ যেসব দেশে কৃষিজ খাদ্য পণ্যের ঘাটতি রয়েছে, সেসব দেশে খাদ্য নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটবে এবং কোটি কোটি ক্ষুধার্থ দরিদ্র মানুষকে খাদ্যাভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। তাই করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে, এমনকি ধীরে ধীরে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও ধীরে ধীরে সংকটে পতিত হবেন। সুতরাং অমর্ত্য সেনের মতো মানবতাবাদী অর্থনীতিবিদদের মতে “জীবন” বাঁচানোর জন্য “জীবিকা” একদম বিসর্জন দিয়ে রোগ প্রতিরোধের জন্য পূর্ণ লকডাউন কৌশলটি সঠিক হবে না। তাহলে প্রধান যে দ্বিতীয় রাস্তটি খোলা থাকে তা হচ্ছে সার্বজনীন “টীকা” গ্রহণ করে ব্যক্তির নিজস্ব “ইমিউনিটি” বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। অথবা জুতা দিয়ে পা ঢাকার মত নিজে নিজ মুখমণ্ডল মাস্ক দিয়ে ঢেকে রেখে, সাবান দিয়ে ঠিকমত হাত ধুয়ে ফেলে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা-ফেরা যতটা না করলেই নয় ততটা করা । রোগ ঠেকানোর ব্যক্তিগত সংক্ষিপ্ত ব্যবস্থা সহ সামাজিক জীবন-জীবিকা প্রণালী পাশাপাশি অব্যাহত রাখা যেতে পারে। কখন, কোথায়, কতটুকু এবং কিভাবে তা অবশ্য সুনির্দিষ্ট ঝুঁকির মাত্রা ও রাষ্ট্রের দক্ষতার উপর নির্ভর করবে। সাধারণভাবে বর্তমানে জীবিকার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজগুলি অফিসে অনলাইনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং গ্রামে বা কৃষিতে প্রাকৃতিক কাজে নিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে জীবিকা ও জীবন উভয়ই রক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা ভারসাম্য বজায় রেখে নানা উদ্যোগ নেয়ার কথাই অনেকে বলছেন। তবে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট (Variant) এখন গ্রামেও ছড়াচ্ছে। এসব ভয়াবহ বিপদজনক সময়ে জনবান্ধব রাষ্ট্র অথবা সম্মিলিত সামাজিক সুশৃংখল একটি শক্তিই পারে যথাযথ প্রতিরোধ ও প্রতিষেধকের কাজগুলি ঠিক মত করতে। সে জন্য এবার ভারতের মধ্যে কেরালা রাজ্যে ও বাইরের দেশ গুলির মধ্যে ভূটানে এবং এই রোগের উদ্ভব যেখানে হয়েছে সেই চীনে অথবা সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামে আমরা করোনা প্রতিরোধ ও প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অধিক সাফল্য দেখতে পেয়েছি। এদের রাজনৈতিক দক্ষতা থেকে সারা বিশ্বের অনেক কিছু শিক্ষার আছে। এসব নিয়ে Internet-এ অনেক শিক্ষনীয় আলোচনা হচ্ছে। পক্ষান্তরে ধনী দেশগুলিতে আমরা দেখলাম এক বিশৃংখল অবস্থা। টিকা আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মত উন্নত দেশেও আমরা প্রচুর মৃত্যুর ঘটনা দেখতে পেয়েছি। এমনকি সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাও যে পর্যাপ্ত ছিল না, বিশেষত যাদের স্বাস্থ্য বীমাও ছিল না, আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না তারা যে বিপদে পড়েছিলেন তা এবারের করোনাকালে ভালভাবেই সেসব দেশে উদ্ঘাটিত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশে অবশ্য এখন দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুর হারও ঊর্ধ্বমুখী। এই মুহূর্তে আমরা কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সে জন্য দরিদ্র লোকদের যে জীবিকা সমর্থন দিতে হতো তা পর্যাপ্ত পরিমাণে এখনো দেওয়া হচ্ছে না। যতটুকু দেওয়া হচ্ছে সেটারও বিলি বণ্টনে প্রচুর দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকার অবশ্য অনেক নয়-ছয় করার পর একচেটিয়া কোম্পানির বা বাজারের হাত থেকে টিকাটি নিজেদের কর্তৃত্বে এনে বিনামূল্যে অনলাইন রেজিষ্ট্রশনের মাধ্যমে বণ্টন শুরু করেছে। তবে ইত্যেমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং সমগ্র কর্মসূচির গতিবেগ এখনো খুবই শ্লথ। মরার উপর খাঁড়ার ঘার মত এখন দেখা যাচ্ছে করোনা আক্রান্ত হয়ে যে রোগীরা সংকটজনক মাত্রায় উপনীত হচ্ছেন তাদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার সক্ষমতাও বাংলাদেশে নাই। হাসপাতাল কম, অথবা নাগালের বাইরে। যদিওবা নাগাল মেলে, সেখানে সিট ও অক্সিজেনের প্রকট অভাব রয়েছে। দরিদ্ররা তো বটেই এমনকি ধনীরাও ঠিকমত চিকিৎসার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। দরিদ্র জনগণের জন্য আজ দুদিক থেকে বিপদ উদ্যত হয়ে উঠেছে- জীবিকা বন্ধ হওয়ার বিপদ, আর জীবনের ঝুঁকির বিপদ। তাদেরকে সংগঠিত করে কিছুটা দৈনন্দিন ঝুঁকি কমানোর জন্য মাস্ক ইত্যাদি প্রদান করা, অভ্যস্ত করে তোলা, এটা দরকার বটে কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। তাই পাশাপাশি তাদের জন্য ন্যুনতম জীবিকাও নিশ্চিত করতে হবে। একজন রিকশাওয়ালা আমাকে বলছিলেন- ‘ভাই আমি তো ভিক্ষা চাই না, কাজ চাই। সরকার আমাকে কাজ দেক এবং সেই রোজগার দিয়ে বেঁচে থাকার মত ভোক্তা অধিকারটুকু রক্ষার ব্যবস্থা করে দেক। তাহলেই আমরা খুশী।’ কিন্তু সকারের ও আমলাতন্ত্রের প্রণোদনা প্যাকেজ এখন পর্যন্ত ধনীদের প্রভাবে ধনীকমুখী। আর যে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের সামাজিক সুশৃংখল শক্তি করোনা প্রতিরোধে সামাজিক ব্যুহ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারতো সেটাও নিদারুণভাবে অনুপস্থিত। তাই বাংলাদেশের আজো ভুগতে হচ্ছে তুলনামুলক ভাবে বেশি। ফলে করোনা সামাজিক বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন তীব্রভাবে তুলে ধরেছে তেমনি এর অনুপস্থিতি এবং প্রকট ঘাটতির দিকটিও এই বাজার নীতির আধিপত্যের যুগে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আস্থাভাজন বিকল্প সামাজিক শক্তি ও কর্মতৎপরতা গড়ে তোলাই এখন আমাদের কর্তব্য। জনগণের সেবাও করতে হবে, তার ন্যায্য অধিকারের জন্য সংগ্রামও করতে হবে। সুএ সাপ্তাহিক একতা