নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ

প্রকাশিত: ২:৫৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০২১

” নন্দিত কথাশিল্পী
হুমায়ূন আহমেদ “

      বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম হুমায়ুন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। নন্দিত এই বাঙালী লেখক, কবি, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের নবম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

      হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা আর মা আয়েশা ফয়েজের গৃহিণী। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তার ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।

      তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বলে গণ্য করা হয়। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। 

       হুমায়ুন আহমেদের  উপন্যাসের ভাষা ছিল সহজ-সরল, স্বচ্ছন্দ ও গতিময়। গল্প বলার অসাধারণ এক সম্মোহনী শক্তি ছিল তাঁর। এই গল্প বলার জাদুকরি শক্তিই তাঁকে দ্রুত খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। কাহিনি-বর্ণনায় টানটান উত্তেজনা, কৌতূহল, উদ্দীপক ঘটনার বিন্যাস, চমকপ্রদ নাটকীয়তা, বৈচিত্র্যময় ও বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র সৃষ্টি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি হুমায়ূন আহমেদকে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। স্বাধীনতা-উত্তর শহরকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের শিক্ষিত শ্রেণিই মূলত হুমায়ূন আহমেদের প্রধান পাঠক। উল্লেখ্য, কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণির লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’

      ১৯৬৯ সালে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। মোহসিন হলের ৫৬৪ নং কক্ষের বাসিন্দা। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পড়তেই তিনি উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন। তৈরি হয়ে যায় তিনটে পান্ডুলিপি। যার একটি ‘নন্দিত নরকে’। অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আহমদ ছফা পান্ডুলিপিটি দেখে মুগ্ধ হন। তাগিদ দেন প্রকাশের।   নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত।    

       ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন এবং নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিমার রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।

       বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর পুরো পরিবার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তাঁর বাবা ফয়জুর রহমানকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। জোছনামাখা এক রাতে উত্তাল নদীতে ভেসে গিয়েছিল সেই মৃতদেহ। প্রাণ বাঁচাতে মা এবং ছোট ভাইবোনকে নিয়ে ছুটতে হয় আশ্রয়ের সন্ধানে। হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান।  পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে আটক করে এবং নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালায় কিন্তু তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। 

       হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। সত্তর দশকের এই সময় থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। এই কালপর্বে তার গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তার সৃষ্ট হিমু এবং মিসির আলি ও শুভ্র চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবক শ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। অন্য দিকে তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীও তার সৃষ্টিকর্মের অন্তর্গত, তাঁর রচিত প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী তোমাদের জন্য ভালোবাসা।

       টেলিভিশনে হুমায়ুন আহমেদের নাটকগুলো অবিশ্বাস্য রকমের আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর ধারাবাহিক নাটকগুলোর সব চরিত্রই মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে খুব চেনা। প্রতিটি ধারাবাহিক শুরুর আগেই পরিবারের সবাই টিভি সেটের সামনে বসে অপেক্ষা করেছে গভীর আগ্রহে। সারা শহর যেন থেমে থাকত ওই সময়টুকুর জন্য। নাটকে চরিত্রের সঙ্গে দর্শক অদ্ভুতভাবে মিশে যেত। ফলে নাট্যকার হুমায়ূন যখন শিশু টুনিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন বা বাকের ভাইকে মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে ফাঁসির দড়ির দিকে এগিয়ে দেন, তখন সাধারণ দর্শক আর নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তারা নাট্যকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাস্তায় মিছিল বের করে। এই হচ্ছে নাট্যকার হুমায়ূনের ক্ষমতা।

       তাঁর সাড়া জাগানো নাটকের মধ্যে রয়েছে 'কোথাও কেউ নেই', 'বহুব্রীহি', 'এইসব দিনরাত্রি', 'আজ রবিবার', 'অয়োময়', 'উড়ে যায় বকপক্ষী' ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, হুমায়ূন আহমেদের নাটকেও উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ। বিটিভির ধারাবাহিক নাটক 'বহুব্রীহি'-তে টিয়া পাখির মুখ দিয়ে 'তুই রাজাকার' সংলাপটি বলিয়েছিলেন, তা আজ কিংবদন্তীতুল্য মর্যাদা পেয়েছে, পরিণত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক সার্থক অভিব্যক্তিতেও। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে যখন মুখরিত হয়েছিল শাহবাগ, সেখানেও একটি নিয়মিত স্লোগান ছিল 'তুই রাজাকার'।

       ১৯৮৮-৮৯ সালের কথা। দেশের ক্ষমতায় তখন স্বৈরশাসক। টেলিভিশনে 'পাকিস্তানি হানাদার' বলা নিষিদ্ধ। বলতে হবে শুধু 'হানাদার'। এছাড়া ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন বা রেডিওতে 'রাজাকার' শব্দটিও আর ব্যবহৃত হয়নি। পুরো একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা নিয়ে। এমনই একটি সময়ে হুমায়ূন আহমেদ ঠিক করলেন নাটকে 'রাজাকার' শব্দটি ব্যবহার করবেন। কিন্তু মানব চরিত্রের মুখ দিয়ে কথাটি বলালে বিপদে পড়তে হতে পারে। ওই চরিত্রে রূপদানকারীর জীবনসংশয়ও হতে পারে। তাই তিনি কথাটি বলালেন টিয়াপাখির মুখ দিয়ে। এমন বুদ্ধিবৃত্তিক দুঃসাহস বোধহয় শুধু হুমায়ূন আহমেদই দেখাতে পারতেন।

     ১৯৮৮-৮৯ সালের কথা। দেশের ক্ষমতায় তখন স্বৈরশাসক। টেলিভিশনে 'পাকিস্তানি হানাদার' বলা নিষিদ্ধ। বলতে হবে শুধু 'হানাদার'। এছাড়া ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন বা রেডিওতে 'রাজাকার' শব্দটিও আর ব্যবহৃত হয়নি। পুরো একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা নিয়ে। এমনই একটি সময়ে হুমায়ূন আহমেদ ঠিক করলেন নাটকে 'রাজাকার' শব্দটি ব্যবহার করবেন। কিন্তু মানব চরিত্রের মুখ দিয়ে কথাটি বলালে বিপদে পড়তে হতে পারে। ওই চরিত্রে রূপদানকারীর জীবনসংশয়ও হতে পারে। তাই তিনি কথাটি বলালেন টিয়াপাখির মুখ দিয়ে। এমন বুদ্ধিবৃত্তিক দুঃসাহস বোধহয় শুধু হুমায়ূন আহমেদই দেখাতে পারতেন।

      হুমায়ূন আহমেদ যেনো এক সব্যসাচী। চলচ্চিত্র নির্মাণেও দীপ্তি ছড়ানোর মাধ্যমে সে প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বানিয়ে যান- 'আগুনের পরশমণি',  'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী', 'চন্দ্রকথা', 'শ্যামল ছায়া', 'নয় নম্বর বিপদ সংকেত', 'আমার আছে জল', 'ঘেটুপুত্র কমলা'র মতো অনবদ্য সব ছবি। শ্যামল ছায়া ও ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র দুটি বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের জন্য দাখিল করা হয়েছিল। এছাড়া ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

      সংখ্যায় বেশি না হলেও তাঁর রচিত গানগুলোও জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর রচিত অন্যতম উপন্যাসসমূহ হলো মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার ইত্যাদি। 

       বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। 

       বিচিত্র সৃষ্টিসম্ভারে হুমায়ুন আহমেদ আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক থেকে জননন্দিত কথাশিল্পী। তাঁর স্মৃতি আর সৃষ্টির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

© Harun Or Rashid.
(Source: “টিভি নাটকে বিপ্লব”- দৈনিক যায় যায় দিন। ৩১ জুলাই ২০১২। “হুমায়ূন আহমেদ : সঙ্গীতসাহিত্যে”- স. ম. শামসুল আলম, দৈনিক ভোরের কাগজ (২০ জুলাই ২০১৮)। kaliokalam, roar media, daily jagaran, Wikipedia )