মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কামান ও ট্যাংক দুই দেশের সম্মিলিত রাখি বন্ধনের সাক্ষী — মৃনাল চৌধুরী লিটন

প্রকাশিত: ৫:১৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ৮, ২০২১

মৃনাল চৌধুরী লিটন

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্মরণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় নির্মিত হয়েছিল স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু উন্নয়ন কাজের নামে সম্প্রতি সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারত তথা ত্রিপুরার মানুষের বিশাল সমর্থন। ভারত ও বাংলাদেশের গণমানুষের অভিন্ন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও সৌহার্দ্যের অন্যতম প্রধান স্মৃতিচিহ্ন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কেন্দ্রস্থল পোস্ট অফিস চৌমোহনীর ৪০ ফুট উঁচু শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। এটি দুই দেশের বীর শহীদদের সম্মিলিত রাখি বন্ধনের সাক্ষী।

ত্রিপুরা রাজ্যের মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধরত গণমানুষকে ঐতিহাসিক ঋণবন্ধনে আবদ্ধ করেছিল আগরতলার এই স্মৃতি-বিজড়িত স্থানটিকে ঘিরেই। গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি যে, সম্প্রতি এই স্মৃতিস্তম্ভটি বিলোপ করা হয়েছে।

, আমরা ব্যথিত বোধ করছি দুই দেশের রক্তরঞ্জিত সম্পর্কের ইতিহাস জড়িত এই স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে ফেলায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা অনুরোধ জানাই যাতে স্মৃতিস্তম্ভটি যথাস্থানে স্বমহিমায় পুনঃস্থাপন করা হয় এবং দুই দেশের মানুষের সম্পর্কের প্রতীকী স্মৃতিস্মারকসমূহ যথাযথ সংরক্ষণ করা হয়।

প্রসঙ্গত, আগরতলার প্রাণকেন্দ্র পোস্ট অফিস চৌমুহনীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় বীর শহীদ জওয়ানদের স্মরণে একটি শহীদ সৌধ তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধে ব্যবহৃত ভারতীয় সেনাদের ব্যবহৃত কামানও রাখা হয় সৌধটির পাশে।

রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট এবং বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৬ ডিসেম্বর এই শহীদ স্মৃতিসৌধে বীর জওয়ানদের শ্রদ্ধা জানানো হতো। এ ছাড়া সৌধটিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হতো।

কিন্তু সম্প্রতি আগরতলা স্মার্ট সিটির জন্য রাস্তা সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের নামে আগেই সেখান থেকে ট্যাঙ্ক ও কামান সরানো হয়। এর পর গত ৩ জুলাই (শনিবার) শহীদ বেদিটিও ভেঙে ফেলা হয়। এ নিয়ে রাজ্যটির বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে

আগরতলার ব্যস্ত সড়কের পোস্ট অফিস চৌমুহনীর মাঝখানে একটি বেদি। যেখানে একটি কামান ও ট্যাঙ্ক তাক করে রাখা। এই দুই ভারী যুদ্ধাস্ত্র বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রণক্ষেত্রে অসংখ্য শত্রুর বিনাশ করেছে। ১৯৭২ সাল থেকে আজও এই দুই যুদ্ধাস্ত্র বন্ধু রাজ্য ত্রিপুরার মানুষ ও বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পর্যটককে জানান দিচ্ছে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনী হিসেবে অংশ নিয়ে যুদ্ধ করে। মিত্রবাহিনীর সেনারা অসংখ্য ভারী যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেন। আগরতলা শহরের পোস্ট অফিস চৌমুহনীর বেদিতে রাখা দুইটি ভারী যুদ্ধাস্ত্রও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার গুরুত্ব অনেক। মুক্তিযোদ্ধের সময় ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার সমপরিমাণ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল রাজ্যটি। রাজ্যের মানুষের আন্তরিকতাও স্মরণ করার মতো। পাশাপাশি খাবার, চিকিৎসা আর মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছের এই রাজ্য।
শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের মিত্রবাহিনীর ব্যবহার করা অসংখ্য ট্যাঙ্ক আর কামানের মধ্যে দুইটি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা শহরের কেন্দ্রস্থল পোস্ট অফিস চৌমুহনীতে ১৯৭২ সালে স্মারক হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। যুদ্ধে ব্যবহৃত একটি ট্যাঙ্ক ও একটি কামান ত্রিপুরার মানুষ এবং ত্রিপুরা ভ্রমণে যাওয়া বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে প্রদর্শিত এই দুইটি ট্যাঙ্ক ও কামানের যত্নও করা হয় নিয়মিত। আগরতলা পুরপরিষদ এই কাজটি করে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মিত্র ও মুক্তিবাহিনী অসংখ্য ট্যাঙ্ক ও কামান ব্যবহার করেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজ্য সরকার ও আর্মির (সেনাবাহিনীর) তত্ত্বাবধানে আগরতলা পোস্ট অফিস চৌহমুহনীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করা একটি ট্যাঙ্ক ও একটি কামান বেদি করে রাখা হয়। এই দুইটি ভারী যুদ্ধাস্ত্র ত্রিপুরাবাসী ও ত্রিপুরায় ভ্রমণে আসা নানা দেশের মানুষকে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক কামান ও ট্যাঙ্ক যে চত্বরের বেদিতে রাখা আছে এর পূর্বদিকে হরিগঙ্গা বসাক রোড। সড়কটি শহরের প্রধান সড়ক হিসেবেও পরিচিত। পশ্চিমে মেলার মাঠ হয়ে বটতলা। উত্তর-পশ্চিম কোণে আগরতলা পশ্চিম থানা। আর উত্তর-পূর্বকোণে আগরতলা পোস্ট অফিস। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে প্রদেশ কংগ্রেস কার্যালয়। দক্ষিণে বিগ বাজার শপিংমল। এলাকাটি জনবহুল।
আগরতলার রজত রায় বলেন, তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে বাংলাদেশে। পোস্ট অফিস চৌমুহনীর কামান আর ট্যাঙ্ক বাংলাদেশ ও ওই দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ইতিহাসের এই স্মারক তাদের সন্তানদেরও বাংলাদেশের বীর জাতিকে শ্রদ্ধা জানাতে শিক্ষা দিচ্ছে। এছাড়াও

আগরতলা (ত্রিপুরা): ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার পোস্ট অফিস চৌমুহনী এলাকার গোল চত্বর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়বে রাজ্য সরকার।

আগরতলার প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত পোস্ট অফিস চৌমুহনীর গোল চত্বরে রাখা ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত কামান ও ট্যাংক।

রোববার (১৫ নভেম্বর) সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হঠাৎ দুটি ক্রেনে করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত সামগ্রী সরিয়ে নেওয়া হয়।

দুটি ক্রেনের সাহায্যে সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কামান ও পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা ট্যাংক। এই দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
ত্রিপুরাবাসীর আবেগ জড়িত এসব সামগ্রী কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জানতে চান স্থানীয়রা।
পরবর্তী সময়ে পশ্চিম জেলার জেলাশাসক ডা. শৈলেশ কুমার যাদব একটি নোটিশ জারি করে জানান, আগরতলা শহরের রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অস্ত্রগুলি পোস্ট অফিস থেকে সরানো হয়েছে।

এগুলো আগরতলার লিচু বাগান এলাকার মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম শহীদ জওয়ান অ্যালবার্ট এক্কার নামে নির্মিত পার্কে রাখা হয়েছে।
ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছে কংগ্রেস এবং সিপিআইএম। প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র তাপস দে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অবদান রয়েছে। আগামী প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাংলাদেশের জন্মের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর অবদান জানতে না পারে সে জন্য পরিকল্পিতভাবে এই কাজ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যদি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে তৈরি অ্যালবার্ট এক্কা পার্ককে সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা থেকে এ কাজ করা হয় তবে ট্যাংক ও কামানের রেপ্লিকা তৈরি করে রাখা যেত। কিন্তু সরকার তা না করে রাজধানীর জনবহুল এলাকা থেকে এগুলো সরিয়ে দিয়েছে পূর্ব পরিকল্পনা করে।

এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সিপিআইএম-এর ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সম্পাদক গৌতম দাস বলেন, জনবহুল স্থানে রাখা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন স্থানীয় মানুষসহ বাইরে থেকে আসা মানুষ দেখে আসছে। এগুলো এখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার মানে হচ্ছে ত্রিপুরার ঐতিহ্যকে নষ্ট করার অপচেষ্টা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পোস্ট অফিস চৌমুহনী এলাকায় অবস্থিত কংগ্রেস ভবনটি মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে ব্যবহার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর যুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পোস্ট অফিসের সামনের গোল চত্বরে একটি শহীদ বেদী তৈরি করা হয়, পাশাপাশি কামান ও ট্যাঙ্কটিকে রাখা হয়। প্রতি বছর বিজয় দিবসের দিন এখানে ভারতীয় সেনারা শহীদ সেনাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

লেখক।মৃনাল চৌধুরী লিটন সাবেক ছাএনেতা

সভাপতি প্রেসক্লাব বিজয়নগর

সম্পাদক সাপ্তাহিক তিতাস বানী ও

সবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাএলীগ ব্রাহ্মণ বাড়ীয়া সদর উপজেলা শাখা।