চক্রাখালি গণহত্যা  : মানবতার চরম বিপর্যয় 

প্রকাশিত: ৮:৪৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০২১

শংকর কুমার মল্লিক ।।মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য জঘন্য গণহত্যা। এতো কম সময়ে এতো বেশি মানুষকে আর কোনো যুদ্ধে হত্যা করা হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল গণহত্যার মধ্যে দিয়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে এই গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারপর নয়মাসের যুদ্ধকালে নির্মম গণহত্যা নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ সহ নানামুখী আক্রমণ, অত্যাচার চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশের সহযোগী বাহিনী রাজাকার, আলবদর ও তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। সারাদেশের মতো খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার ( তৎকালীন বটিয়াঘাটা থানা ) ১ নং জলমা ইউনিয়নের চক্রাখালি গ্রামে গণহত্যা চালিয়েছিলো পাকিস্তানি সৈন্যরা। 

লেখক : শংকর কুমার মল্লিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষ সংগঠিত হতে থাকেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে শহর,গ্রাম, গঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী,ছাত্র যুবক, স্বেচ্ছাসেবক যার যার এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা সংগ্রাম কমিটি এবং প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলেন। বটিয়াঘাটার চক্রাখালি গ্রামেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস এবং তাঁর বন্ধু অনিল কৃষ্ণ অধিকারী নিজ গ্রাম চক্রাখালি গ্রামে ফিরে এসে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এই কমিটির মিটিং হতো চক্রাখালি মাধ্যমিক স্কুলে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে থাকেন। এর সাথে যুক্ত হন নিরঞ্জন কুমার রায়,কার্তিক রায়,শান্তিরাম দত্ত, বিনয় সরকার, নির্মল অধিকারী সহ স্থানীয় আরও অনেক মানুষ। এদেরকে প্রত্যক্ষভাবে পরামর্শ দিয়ে, অর্থ ও পরবর্তীকালে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেন খুলনার তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা খয়বার হোসেন। চক্রাখালি সংগ্রাম কমিটির যোগাযোগ ছিল বটিয়াঘাটা থানা সদরের সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে। বটিয়াঘাটা থানা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন  সত্তরের নির্বাচনের জাতীয় পরিষদে দাকোপ বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া আসনের নির্বাচিত সদস্য শেখ লুৎফর রহমান মনি, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এনায়েত আলী সানা, খুলনা জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ, খুলনা ১ আসনের বর্তমান সাংসদ পঞ্চানন বিশ্বাস, ইন্দ্রজিৎ জোদ্দার,হরেন্দ্রনাথ টিকাদার, মুকুল বিশ্বাস সহ আরও অনেকে। 
 
চক্রাখালি গ্রামের সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা চক্রাখালি স্কুলে তাদের কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে তারা স্কুল ঘরে চাল, ডাল, নারকেল, গুড় ইত্যাদি জমা করেন। ৪ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআরের একটি দল খুলনা রেডিও স্টেশন দখলের অভিযানে ব্যর্থ হয়ে অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। তাদের একটা অংশ সরাসরি দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চক্রাখালি স্কুলে আশ্রয় নেন। এই সময়ে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মুসলিম লীগের কিছু সদস্য বটিয়াঘাটা থানার তৎকালীন দারোগার মাধ্যমে খুলনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে খবর পাঠায় যে, চক্রাখালি স্কুলে বিশাল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এবং এলাকার লোকজন সংগঠিত হচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর হামলার জন্য। তাদের অফিস চক্রাখালি স্কুল। এ খবর পেয়ে মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেয় চক্রাখালি স্কুলে আক্রমণ করতে হবে। 
 
এই ঘটনার প্রায় ১৫ /২০ দিন পর পাকিস্তানি সেনারা নৌপথে খুলনা থেকে বটিয়াঘাটার দিকে আসে। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল, সেদিন ছিল শনিবার। চক্রাখালিতে হাটবার। দুপুরের পরপর হাট বসতে শুরু করেছে। তখনও বেশি লোকজন আসেনি। শতখানেক লোকজন এসেছে। গ্রামের লোকজন কেউ দুপুরের খাবার খাচ্ছে, কেউ খেয়ে উঠেছে, কেউ স্নান করছে, কেউ মাঠে কাজ করে ফিরেছে, কেউ হাটে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। এমন সময় পূর্ব দিকে দূর থেকে নদীতে ভেসে আসছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটো গানবোট। উল্লেখ্য যে, স্থানীয় রাজাকার, শান্তি কমিটির লোকজন গুজব ছড়িয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ আসবেন চক্রাখালি গ্রামে তাদের জানমাল রক্ষার জন্য মিটিং করতে। হাটে আসা সাধারণ লোকজন সেটাই বিশ্বাস করছিলেন। খুলনা শহর থেকে বটিয়াঘাটা থানা সদর ভৌগোলিক দূরত্ব খুবই কম। কিন্তু খুলনা শহর থেকে বটিয়াঘাটায় আসা যাওয়ার জন্য কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না। বর্তমান গল্লামারী থেকে যে পাকা রাস্তা আছে। ঐ সময়ে রাস্তাটি ছিল কাঁচা এবং সরু। কয়েক জায়গায় বাঁশের সাঁকো ছিল। গাড়ি নিয়ে আসার পথ ছিল না। এ জন্য পাকিস্তানি নেভাল সদস্যরা গানবোটে আসে চক্রাখালি গ্রামে। 
 
কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি গানবোট কাজিবাছা নদী দিয়ে এসে চক্রাখালি স্কুলের কাছে এসে থামে। থেমেই গানবোটে থাকা সেনারা পজিশন নেয়। সেখান থেকে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব দেয় কিনা। কোনো সাড়া না পেয়ে তারা পাশে টিকাদার বাড়ির ঘাটে নেমে স্কুল ভবন লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি ও শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এসব দেখে বাজারের লোকজন সবকিছু ফেলে যে যেভাবে পেরেছে প্রাণ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে বাজার জনশূন্য হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে টিকাদার বাড়িতে ঢুকে কালিপদ টিকাদারকে গুলি করতে উদ্যত হয়। কিন্তু গুলি না করে তাকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচা মারলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। কিন্তু বাড়ির অন্য সদস্যরা তার আগে পালিয়ে যায়। এরপর সেনারা বাজারে আসে। সেখানে কোনো লোকজন না পেয়ে বহু দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারপর তারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে একটা দল চক্রাখালি স্কুলে ঢুকে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিদ্যালয় ভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং অফিসের কাগজপত্র পুড়ে যায়। সেই ক্ষতচিহ্ন এখনো আছে এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ তা সংরক্ষণ করে রেখেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আর একটা দল ভেকটমারী খাল পার হয়ে চক্রাখালি গ্রামের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে এগোতে থাকে। গ্রামের মধ্যে ঢুকে তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে অনেক মানুষকে হতাহত করে। বন্দুকের বাট দিয়ে পিটিয়েছে বহু মানুষকে। তাছাড়া বহু ঘরবাড়ি, মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে নির্মমভাবে। এর মধ্যে গ্রামবাসীরা যে যার মতো পাশের গ্রাম ছয়ঘরিয়া, রাঙ্গেমারী, দরগাতলার দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হানাদার বাহিনী গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাতে থাকে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এরকম ভয়ংকর তাণ্ডব চালিয়ে তারা আবার গানবোট নিয়ে কাজিবাছা নদী দিয়ে রূপসা নদী হয়ে খুলনায় ফিরে যায়। 
 
চক্রাখালি গণহত্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেদিন বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। শতাধিক বাড়ি, দোকান এবং মন্দির পুড়িয়ে দেয়। আহত হয় প্রায় ৫০ জন। ঐ দিনের গণহত্যায় যারা শহিদ হন তাদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায় তারা হলেন – গোপাল মণ্ডল, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং চন্দ্রকান্ত রায়। চক্রাখালি গ্রামের মতো বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরপরাধ নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তাদের এই হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার, নির্যাতন, অগ্নিকাণ্ড এবং লুটপাটের সাথে যুক্ত ছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ এবং তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্যরা। তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, প্রায় চার লক্ষ নারীর সম্ভ্রম, প্রায় এককোটি শরনার্থীর মানবেতর জীবন এবং বিপুল তাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। 
লেখক : অধ্যাপক : সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা