ছাএ রাজনীতির একাল সেকাল

প্রকাশিত: ৬:৩৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ৪, ২০২১

মৃনাল চৌধুরী লিটন

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ছাত্র রাজনীতি বাংলার রাজনীতিতে নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করে। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ‘স্বদেশী আন্দোলন’ ও ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ছাত্র রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং জমিদারী প্রথার বিরূদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল ছাত্রদের। তবে তখন ছাত্র রাজনীতি ছিল বলেই ছাত্ররা আন্দোলন ও সংগ্রাম করে নাই; বরং সময়ের প্রয়োজনে দেশ ও জাতির স্বার্থে ছাত্ররা এগিয়ে এসেছিল। আজকের দিনেও দেশের সঙ্কটময় সময়ে ছাত্ররা এগিয়ে আসবে; এজন্য ছাত্র রাজনীতির কোন দরকার পড়বে না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোন রাষ্ট্র নায়কই নিকট অতীতে ছাত্র রাজনীতিতে হাত পাকিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে আসেন নাই। বাংলাদেশে যারা ছাত্র রাজনীতি করে উঠে এসে এমপি/মিনিস্টার হয়েছেন তাদের প্রায় সবারই ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস মসৃণ নয়। অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সাতচল্লিশে দেশ বিভাগ হওয়া পর্যন্ত উপমহাদেশের ছাত্ররাজনীতির ধারা ছিল এক রকম; আবার সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত এ ধারাটির গতি পরিবর্তন হয়; আবার একাত্তর থেকে একানব্বই পর্যন্ত এ দেশের ছাত্র রাজনীতি ছিল বিভিন্ন ধারা উপধারায় বিভক্ত; আর এ জং ধরা ধারায় এইডসের মড়ক লাগে একানব্বই পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে; এখন তো ছাত্র রাজনীতি একটি মহামারীতে রূপ নিয়েছে। ছাত্র রাজনীতি এখন আর ছাত্রদের করতে হয় না; এর মালিকানা রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা আর অছাত্র, বখাটে, টেন্ডারবাজ আর গুন্ডাদের দখলে। এখানে নীতি আর আদর্শের কোন স্থান নেই।

৯১ পরবর্তী বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে আদর্শ ও দায়িত্বের গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন ছাত্র রাজনীতি চিরায়ত ‘গণমুখী’ ঐতিহ্য ত্যাগ করে ‘ক্ষমতামুখী’ আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্র নেতারা এখন পদ পদবীর আশায় কলেজ/বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ইচ্ছা করেই ফেল করেন; এতে তাদের ছাত্র জীবন দীর্ঘ হয়, পদ পদবীর সুযোগ হয়। নেতাদের পড়াশুনায় নিয়মিত হওয়ার চেয়ে ফেলটুস ছাত্র হয়ে থাকাটাই এখন অধিক মর্যদার। এতে পদ পদবীর পাশাপাশি তাদের পেশি শক্তি বাড়ে, অর্থবিত্ত বাড়ে, বড় নেতার আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার সুযোগ বাড়ে। হাত পাকে তদবীর বাণিজ্যে, হলে সিট বাণিজ্যেে, টেন্ডার বাণিজ্যে। ফলাফল স্বরূপ চাকরি জীবনে প্রবেশের আগেই তিনি হয়ে যান কোটিপতি নেতা।

যারা ছাত্র রাজনীতির পক্ষে সবক দেন তারা ছাত্র রাজনীতিতির অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা বলে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন; কিন্তু বর্তমানেে কী ছাত্র রাজনীতির সে দিনটি আছে? তা উনারা দেখতে পান না অথবা দেখলেও তা স্বীকার করেন না।


বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস খুব গৌরবজ্জল। মাওলানা ভাষানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাসিদা কে চৌধুরী তোফায়লে আহমেদ রাসেদ খান মেনন কে এম ওবাইদুর রহমান নির্মল সেন শেখ ফজলুল হক মনি সিরাজুল আলম খান আব্দুর রাজ্জাক এর মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য নেতারা ছাত্র রাজনীতি করেই বিখ্যাত নেতা হয়েছিলেন। তাঁরা কখনো কর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন নাই। সব সময় আদর্শের শিক্ষা দিয়েছেন। পড়ালেখা করতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তাঁরা রাজনীতিকে হাতিয়ার করে নিজেরা বাড়ি-গাড়ি, সহায় সম্পত্তি করেননি। তাঁদের লড়াই ছিল আদর্শের, মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের; ভোগ ও প্রতিহিংসার নয়। এজন্য এসব নেতাদের নাম শুনলেই মানুষ শ্রদ্ধায় অবনত হত, আশ্রয় খুঁজত। তাঁদের যে কোন আহ্বানে মানুষ নির্ধিদায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন ও বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ আন্দোলন গুলো সফল করেছিল। যার ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। ছাত্র রাজনীতির সোনালী সে দিন আজ শুধু স্মৃতি।

বিশেষ করে ৫২’র ভাষা আন্দোলন; ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন; ৬২’র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন; ৬৬’র ঐতিহাসিক ৬ ও ১১ দফা; ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান; ৭০’র নির্বাচন; ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করার ভ্যানগার্ড হিসেবে তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম। পরবর্তীতে ৯১’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে

গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা। চলবে ১