ঐতিহাসিক তারিখটা ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সাল ও শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দও ….. বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৭:৫২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১ আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো……. 🛑 🛑 অশীতিপর এক বৃদ্ধ বন্দী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছিলেন। সারা শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন। পায়ে সামান্যতম শক্তি অবশিষ্ট নেই। সারা গায়ে তুলোর ব্যান্ডেজ, মাথা চোখ সব ঢাকা। কত দিন সয়েছিলেন এই অসহনীয় জীবনযন্ত্রণা, জানা যায় না। বৃদ্ধের ছোট ছেলে দিলীপকুমারও বন্দী হয়েছিলেন। দুজনেই আর ঘরে ফেরেননি। বৃদ্ধের নাম ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আজকের বাংলাদেশে তাঁর নামে রাস্তা আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে একটি গ্রন্থাগার আছে, জাদুঘরে ছবিও আছে। কিন্তু সাধারণ বাঙালির মনে তিনি কতখানি আছেন, জানা নেই। অথচ এই মানুষটাই বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ। 🍂 তারিখটা ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সাল…..‘কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি অব পাকিস্তান’-এর দ্বিতীয় অধিবেশন চলছিল করাচিতে। । আগের বছররেই ভারত ভাগ হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ তখন ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তাই নিয়ে চলছে বিতর্ক। উর্দু তো হতেই হবে, ইংরেজিও চলতে পারে। ধীরেন্দ্রনাথ প্রস্তাবের সংশোধনী এনে বললেন, বাংলাকেও এই স্বীকৃতি দিতে হবে। করাচির মাটিতে মহম্মদ আলি জিন্না’র সামনে অকম্পিত কণ্ঠে বাংলার জন্য তাঁর মতো সরব হতে সে দিন বাংলা প্রদেশের বাঙালি প্রতিনিধিরা অনেকেই পারেননি। 💥 গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, “দেশের ছয় কোটি নব্বই লক্ষ নাগরিকের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তা হলে আপনিই বলুন মহাশয়, রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত?… একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা তো সেই ভাষাই হওয়া উচিত, যাতে বেশির ভাগ মানুষ কথা বলেন।” সে দিন তাঁকে সমর্থন করেছিলেন কেবল তিন জন প্রতিনিধি। প্রেমহরি বর্মা, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তীও বলেন, “উর্দু পাকিস্তানের পাঁচ প্রদেশের কোনওটিরই কথ্য ভাষা নয়।… বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্যে চাপ দিচ্ছি না। শুধু চাই ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি।”🏵️ বলা বাহুল্য এই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পায়নি। দেশের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ভাষার সঙ্গে ধর্ম, জাতীয় ঐক্য ইত্যাদি জুড়ে দিয়ে বললেন, “উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের দাবিতে পাকিস্তানের জন্ম এবং তাঁদের ভাষা উর্দু। কাজেই বেশির ভাগ জনগণ যে-ভাষায় কথা বলেন, তাকে প্রাধান্য দিতে যাওয়া ভুল হবে।” তিনি পাকিস্তানকে ‘এক জাতি, এক দেশ, এক ভাষা’র তকমা দিতে চাইলেন, ১১ মার্চ গণপরিষদে ‘রাষ্ট্রভাষা উর্দু এই’ মর্মে বিল পাশ হল। অধিবেশন শেষে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলায় ফিরলেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে দেখেন, জনা পঞ্চাশ যুবক গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। তাদের গায়ে আবার চাদর। তিনি ভাবলেন, বাংলার দাবি জানিয়ে এসেছেন বলে এরা নিশ্চয় রেগে গিয়েছে এবং চাদরে লুকিয়ে অস্ত্র এনেছে তাঁকে আক্রমণ করবে বলে। তিনি পায়ে পায়ে এগোলেন। কাছে আসতেই এক আশ্চর্য ঘটনা। চাদরের নীচ থেকে বেরিয়ে এল রাশি রাশি ফুল। যুবকেরা সেই ফুল বর্ষণ করল মাতৃভাষার জন্য যুদ্ধের প্রথম বীর সৈনিকের উপর। এরা সকলেই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। 🥀🥀 অধিবেশনে যাওয়ার আগে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরেছিলেন; মানুষের ভয়ের নয়, মনের কথা জেনেছিলেন। ভাষা হারালে একটা জাতি হারিয়ে যাবে, তিনি জানতেন। চিঠির খামে লেখা ঠিকানা, জমি বেচাকেনার স্ট্যাম্প পেপারের লেখাজোখার মতো সাধারণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভাষাও তো তাঁদের অচেনা মনে হবে! প্রসঙ্গত, ভাষা নিয়ে পরিষদের বিতর্ক ভাষার কারণেই প্রদেশের বেশ কয়েক জন প্রতিনিধি সে দিন বুঝতেই পারেননি। ধীরেন্দ্রনাথের বক্তব্যই বাংলা ভাষা আন্দোলনকে প্রথম পর্বে একটা সাংগঠনিক রূপ দিল।🍂 অবশেষে এল ১৯৫২ সালের সেই কান্নার দিন, গর্বের দিন, ২১ ফেব্রুয়ারি। সারা পৃথিবী দেখল, মাতৃভাষার জন্যে মানুষ ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে প্রাণ দিতে পারে। পুলিশের অত্যাচার যত বাড়ল, আন্দোলনও তত তীব্র হল। ধীরেন্দ্রনাথ আরও সবাক, আরও সক্রিয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সপুত্র তাঁকে কুমিল্লার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হল ময়নামতি সেনা ক্যান্টনমেন্টে। অকথ্য নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে সকলের অজান্তে শেষ হয়ে গেল একটি অসাধারণ জীবন। 🔥 কাহিনীটা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হলোনা। ১৯৮৩ সালে ধীরেন্দ্রনাথের নাতনি আরমা দত্ত জানতে পারলেন, তাঁদের কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভিটেবাড়ি শত্রু সম্পত্তি আইনে দখল হয়ে যাচ্ছে। উনি আদালতে গেলে বাংলাদেশের বিচারক জানালেন, এই বাড়িটি অবশ্যই শত্রু সম্পত্তি। কারণ ওখানে এখন কেউ থাকে না। যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে বাড়িটি রেজিস্ট্রি করা আছে, তিনি ‘ইণ্ডিয়ায় চলে গেছেন’। হতবাক আরমা দত্তের উকিল জানালেন কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তো মুক্তিযুদ্ধের শহীদ।বিচারকের পাল্টা প্রশ্ন, “তাই নাকি! ডেথ সার্টিফিকেট আছে? দেখাতে পারবেন?” স্বভাবতই ক্যান্টনমেন্টে রাতের অন্ধকারে পাকসেনাদের হাতে খুন হওয়া মানুষটির ডেথ সার্টিফিকেট দেখানাে সম্ভব হয় নি। আর আইন মাফিক বেদখল হয়ে গেল প্রথম বাঙালী ভাষা সৈনিকের ভিটে। Related posts:বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার মাও স্বাধীনতার একই স্বপ্ন দেখতেন: প্রধানমন্ত্রীবিপ্লবী সূর্য সেন আজও শোষকদের আতংক মৃনাল চৌধুরী লিটনশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ: জাতিকে এর খেসারত দিতে হবে Post Views: ২৩৫ SHARES আইন-আদালত বিষয়: