বিপ্লবী সূর্য সেন আজও শোষকদের আতংক মৃনাল চৌধুরী লিটন

প্রকাশিত: ১১:৪১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২১

সকলেই জানেন যে ১৯৩৪ সালের বারোই জানুয়ারি সূর্য সেনের ফাঁসি হয়। কিন্তু তিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়তে পারেন নি। কিংবা বীরদর্পে ফাঁসির মঞ্চে উঠে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে পারেন নি। যা ছিল সে যুগের বিপ্লবীদের পক্ষে স্বাভাবিক কাজ।
তার কারণ ফাঁসির আগেই ব্রিটিশ সেনা ও জেল কর্তৃপক্ষ মাস্টারদার উপর নামিয়ে আনে ভয়ঙ্কর নৃশংস অত্যাচার। সাঁড়াশি দিয়ে তাঁর প্রত্যেকটি আঙুলের নখ উপড়ে নেওয়া হয়। হাতুড়ি দিয়ে তাঁর সমস্ত দাঁত তুলে নেওয়া হয়। তাঁকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, তখন তিনি মৃত বা প্রায় মৃত। এমনকি মৃতদেহটিকেও তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় নি। সেটিকে বঙ্গোপসাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তার সুযোগ্য সহকারী বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারকে তারই সঙ্গে একই ভাবে নৃশংস অত্যাচার, অর্ধমৃত অবস্থায় ফাঁসিতে ঝোলানো ও দেহ লোপাট করা হয়।
কেন এরকম করা হলো। ইংরেজ শাসকেরা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করলেও এ ধরনের নৃশংসতা, এত পৈশাচিকতা একেবারেই বিরল। বিচার প্রক্রিয়ার সময়, পুলিশ হেফাজতে, জেলখানায়, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর বহু অত্যাচার হয়েছে, কিন্তু ফাঁসির আদেশ হয়ে যাওয়ার পর কিংবা ফাঁসির সময় এরকম নৃশংসতা বিরল। সূর্য সেনের মতো এত বড়মাপের নেতার ক্ষেত্রে তো বটেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ফাঁসির মঞ্চে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহস, দেশপ্রেম, মৃত্যুর মুখে অটল জীবনের জয়গান, দেখে বহু ব্রিটিশ রাজপুরুষ সসম্ভ্রমে মাথা নীচু করেছে।
মাস্টারদার বেলায় কেন এমন ঘটনা হলো যে ফাঁসির দিন ব্রিটিশ সেনারা তার উপর নৃশংস বর্বর অত্যাচার করে নিথর দেহটাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিল। দেহটাকে লুকিয়ে ফেলল লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সেই কথাই আমি লিখতে চাই। আর সামনের প্রজাতন্ত্র দিবসে এটাই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ মত হল যে, আন্দোলনের দুটি মূল ধারা। একটি গান্ধীজির নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগের ধারা, অপরটি হল গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। বাংলায় দুটি ধারাতেই ইংরেজবিরোধী সংগ্রাম ছিল এবং অতি প্রবলভাবেই ছিল। দুই ধারারই সংগ্রামীদের উপর নেমে এসেছিল শাসক ইংরেজের প্রবল আক্রমণ। অনেকের ধারণা আছে যে অহিংস ধারার আন্দোলনকারীদের ওপর বুঝি বিশেষ অত্যাচার হয় নি। নেতাদের ক্ষেত্রে ধারনাটি আংশিক সত্যি হলেও সাধারণ কর্মীদের বেলায় ঠিক নয়। প্রবল আক্রমণ ছিল। পুলিশের লাঠির আঘাতে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে, চির পঙ্গু হয়েছেন, অনেক সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর সহিংস বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। যে অত্যাচার বর্বরতার সম্মুখীন তারা হয়েছেন, ইতিহাসের পাতা থেকে মানুষের স্মৃতিপটে তা লেখা আছে।
অবিভক্ত বাংলায় মুখ্য দুটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল ছিল যুগান্তর আর অনুশীলনী গোষ্ঠী। বাংলার যে যেখানে সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় সকলেই এই দুটি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবী দলটি ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

সূর্য সেন চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী যুব দলটি গড়ে তুলেছিলেন সেটিকে কিন্তু কোনো গোষ্ঠীরই শাখা হতে দেন নি। অথচ মাস্টারদা যখন বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়তেন, সেই সময় যুগান্তর দলের বিশিষ্ট নেতা সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীর সংস্পর্শে এসেই বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তার কয়েকজন বিশেষ সহকর্মী অনুশীলনী দলে যোগ দিলেও মাস্টারদা তার সংগঠনটিকে সর্বদা স্বতন্ত্র রেখেছিলেন। ( কেন তিনি যুগান্তর বা অনুশীলনীতে যোগ দেন নি, এটা এখানে আলোচনা করলে প্রসঙ্গ অন্তর হবে )। মোট কথা হল সে সময়ে বাংলার অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কার্য পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ ছিল। তাহলে কি ছিল মাস্টারদার কর্মপদ্ধতি? এটা বুঝতে পারলে কেন মাস্টারদা আর তার সহকর্মীদের উপর ব্রিটিশদের এতো রাগ তার কারণ বোঝা যাবে।
মাস্টারদা ইতস্তত কিছু ব্রিটিশ রাজপুরুষ কিংবা তাদের নেটিভ সহচরদের ব্যক্তিহত্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি বিকল্প স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন। এর জন্যে চাই এক সশস্ত্র সৈনিক দল। যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করবে। মাস্টারদা তৈরি করলেন সেই সশস্ত্র বাহিনী। নাম দিলেন – ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি সেই সময় ইংরেজের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছিল তিনি সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী তৈরি করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি সৃষ্টির বহু আগে মাস্টারদার এই মহান প্রচেষ্টা। সেই সময় সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র বাহিনীর চিন্তা নেহাতই কল্পনার বিষয়, অথবা কল্পনাতেই নেই। সেই সময় সুভাষচন্দ্রকে বাংলা কংগ্রেস সভাপতির পদ নিয়ে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত দের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করতে হচ্ছে।
ভারতবর্ষের সংগ্রামে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি শুধুমাত্র প্রথম সশস্ত্র বাহিনী নয়, আরও অনেক দিক থেকে অনন্য। এই বাহিনী ছিল দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সর্বস্ব ত্যাগী একদল তরুণ তরুণী দিয়ে গড়া। ( ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি কিন্তু মূলত ব্রিটিশ ভারত সেনা যারা যুদ্ধে জাপানি দ্বারা বন্দী হয়েছিল তাদের নিয়ে গড়া। এতে অবশ্যই কিছু সংখ্যক পূর্ব এশিয়া নিবাসী ভারতীয় যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু বাহিনী ছিল মূলত যুদ্ধবন্দীদের নিয়েই। এই বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল এবং এক বিরাট সংখ্যক সেনা সাহসের সঙ্গে রণক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তা সত্বেও একথা মানতেই হবে যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোদ্ধারা ছিলেন পেশাদার সৈনিক, আর ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির যোদ্ধারা ছিলেন বাংলার অসামরিক অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলার বীর বিপ্লবী। প্রসঙ্গত একটু উল্লেখ করতে চাই যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (INA) প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু না সুভাষচন্দ্র, না রাসবিহারী বসু। এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোহন সিং এবং জ্ঞানী প্রীতম সিং। যদি কোনোদিন সুযোগ পাই সে কাহিনী লেখা যাবে। কিন্তু এতো স্বল্প পরিসরে সেটা সম্ভব নয়। এক মহাগ্রন্থ হয়ে যাবে )।
INA গঠনের অন্তত 12 বছর আগে এই বাংলার একটি প্রান্তে একজন স্কুল মাস্টারের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী সেনা বাহিনী গঠিত হল। এত বড় দেশের একটি ক্ষুদ্র প্রান্তে হলেও তার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বিশাল।

INA গঠনের অন্তত 12 বছর আগে এই বাংলার একটি প্রান্তে একজন শান্ত সৌম্য স্কুল মাস্টারের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী সেনা বাহিনী গঠিত হল। এত বড় দেশের একটি ক্ষুদ্র প্রান্তে হলেও তার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বিশাল। কত বিশাল ? মাস্টারদা যে বাহিনী গঠন করলেন তার নাম রাখলেন – ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ। লক্ষ্য করে দেখুন, একমাত্র বাহিনী হলেও তিনি একে চট্টগ্রাম শাখা হিসেবে চিহ্নিত করলেন। মাস্টারদার স্বপ্ন ছিল যে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি সারা দেশ জুড়ে গড়ে উঠবে। চট্টগ্রামের মতো তার শাখা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। দেশের জন্য আত্মত্যাগে প্ৰস্তুত তরুণ তরুণীদের বিশাল এক বাহিনী। অহিংস অসহযোগ নয়, অস্ত্র হাতে গুপ্ত হত্যা নয়, দেশজুড়ে সামরিক বাহিনী গড়ে ব্রিটিশদের উৎখাত করে বিকল্প রাস্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি একে একে ব্রিটিশ কোম্পানির টাকা লুট, নাখরখানা পাহাড়ের লড়াই, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ, সারা চট্টগ্রাম জুড়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলে জাতীয় সরকার গঠনের মত যুগান্তকারী কাজ সমাধা করলো। এর বিস্তৃত বিবরণ আমি দেব না, কারণ আপনারা তা জানেন। আর যদি না জানেন অবশ্যই জেনে নেবেন, না জানাটা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও।
বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়েদ্দার, গনেশ ঘোষ, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী, প্রমুখ ভারতের শ্রেষ্ঠ বীর সন্তানদের কীর্তি না জানাটা নিতান্তই লজ্জার। এই বীরত্বময় সংগ্রামই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পূর্ণ নতুন এক ধারা।
আগেই বলেছি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মূলত দুটি ধারার কথা পাঠ্য ইতিহাসে লিখিত হয়। একটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, অপরটি সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী। তৃতীয় একটি ধারা যাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি, সেটি হল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহগুলো ছিল ব্যাপক সর্বাত্মক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সশস্ত্র। এই বিদ্রোহগুলি কেবলমাত্র শাসকদের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল অত্যাচারী জমিদার, দেশীয় রাজা, প্রতিনিধি কর আদায়কারী এদের বিরুদ্ধেও। তখনকার শিক্ষিত জাতীয়তাবাদীরা প্রায় সকলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল এবং সরাসরি জমিদারদের সঙ্গে জড়িত থাকায় তারা এইসব বিদ্রোহে সমর্থন করেন নি। পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতে ইতিহাস রচনার সময়ে উপযুক্ত স্বীকৃতি পর্যন্ত দেন নি।
মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম, স্বাধীনতা আন্দোলনের চতুর্থ একটি স্বতন্ত্র ধারা।

ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম অন্যসব ধারার তুলনায় অনন্য এক পর্যায়। কোথায় তা স্বতন্ত্র, কেন ইংরেজদের মাস্টারদার প্রতি এতো রাগ তা আমরা বোঝার চেষ্টা করবো।
লক্ষ্য করে দেখবেন অন্য তিনটি ধারার লড়াইয়ে কোথাও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে, কোথাও ইংরেজ রাজ কর্মচারী বা নেটিভ সাকরেদদের হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের কোনো পরিকল্পনা সেখানে নেই। কাজে পরিণত করা তো অনেক দুরস্থান। মাস্টারদা সশস্ত্র বাহিনী গড়ে শুধু ইংরেজ শাসনকে উৎখাতই করেন নি। তিনি প্রথম ভারতবর্ষের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে স্বাধীন ভারতের নতুন সরকার গঠন করলেন। সেনা ক্যান্টনমেন্ট এবং পুলিশ থানাগুলি দখল করে বিকল্প প্রশাসন চালু করলেন। পুলিশ লাইনে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে মুক্তি বাহিনীর গার্ড অব অনার গ্রহণ করলেন। টানা চার দিন চট্টগ্রাম স্বাধীন ভারতবর্ষ হয়ে রইল। ভারতের ইতিহাসে এ এক অনন্য নজির।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির রণকৌশলও ছিল যেমন অভিনব তেমনই কার্যকরী। বাহিনী কয়েকটি ট্যাকটিকাল দলে বিভক্ত রাখা হয়েছিল এবং প্রতিটি দলের একজন নেতৃত্ব ছিল। এই দলগুলো একসঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাত করতো। সেনাদের অস্ত্রাগার লুন্ঠন, মালগাড়ি উল্টিয়ে দিয়ে রেল যোগাযোগ রুদ্ধ করে দেওয়া, টেলিফোন অফিস গুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সবই প্রায় একযোগে ঘটানো হয়েছিল। এই রণকৌশলের সফল প্রয়োগ যে কোনো অনভিজ্ঞ ভারতীয় বিপ্লবী দল করতে পারে, এটা ইংরেজ শাসকদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। তারা সাময়িকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির মধ্যে একটি জাতীয় গণমুক্তি ফৌজের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও উপাদান বর্তমান ছিল। শিক্ষিত সবল অনুপ্রাণিত একদল তরুণ তরুণী যারা আদর্শ বোধে উজ্জ্বল, প্রাণদানে সতত প্রস্তুত। বাহিনীর মধ্যে দলনেতা আছে কিন্তু সকলেই সম শ্রদ্ধাভাজন। বিকল্প নেতৃত্ব সর্বদা প্রস্তুত। বেতন নাই, রসদ সংগ্ৰহ করে নিতে হয়। (আজাদ হিন্দ ফৌজে কিন্তু সৈনিকদের বেতন ছিল। তার বাস্তবতাও ছিল। কিন্তু আপত্তিকর যেটি ছিল তা হল বাহিনীর ওপর তলার অফিসারদের সঙ্গে সাধারণ সৈনিকদের বেতনে দৃষ্টিকটুভাবে বেতন বৈষম্য। একটা মুক্তি বাহিনীর পক্ষে যা একেবারে বেমানান। আমার লেখা “সুভাষ চন্দ্র – ভাবমুর্তিতে ও ইতিহাসে” বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ) চরিত্রে, তৎপরতায়, দ্রুত আঘাত হানার ক্ষমতায়, আদর্শে, ত্যাগে শ্রেষ্ঠ এইরকম একটা বাহিনীকে ইংরেজরা যে ভয়, সম্ভ্রম, বিষ দৃষ্টিতে দেখবেই তাতে সন্দেহ কি। আর যার নেতৃত্বে এই ভয়ঙ্কর দল গড়ে উঠেছে, যার আদর্শের টানে শত শত তরুণ তরুণী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, যার এই অত্যাশ্চর্য রণকৌশল, তিনি যে ব্রিটিশ রাজের সবচেয়ে বড় শত্রু হবেন এ তো জানা কথা।
আর একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, এতো দিন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যত লড়াই হয়েছে সব পুলিশের সঙ্গে, সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষ। এবং এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন চলেছে তা পুলিশ দ্বারাই। এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসক মিলিটারি বাহিনী ব্যবহার করেছে, এ অতি বিরল ঘটনা। তার দরকারও তারা অনুভব করে নি। মাস্টারদার লড়াই ছিল কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি জানতেন যদি সশস্ত্র পদ্ধতিতে লড়াই করতে হয়, তা করতে হবে ওই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গেই। ভারতবর্ষের মাটিতে এই প্রথম কোনো সংগ্রাম প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে স্বাধীন ভারতের নিশান ওড়ালো, প্রতিহিংসা নেবে না ? যে মানুষটার নেতৃত্বে এই মহাসংগ্রাম, যার অভিনব রণকৌশল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিল, সবচেয়ে বড় কথা যিনি সশস্ত্র বিপ্লবী ধারায় সঠিক পথটি চিনিয়ে দিল, তাকে কি বীর শহীদের মর্যাদা দেওয়া যায় ? তার মৃতদেহের শেষ স্মৃতিটুকু পর্যন্ত নষ্ট করে দাও।
স্বাধীন ভারতবর্ষেও মাস্টারদার পথ শাসকের পক্ষে বড় বিপদজনক। ওই আদর্শ যেন যুব সমাজের সামনে না আসে। তাই যুব সমাজের নতুন আইকন সৃস্টি করে তার পুজো করো। মাস্টারদার শহীদ দিবসে শাসকের পক্ষে সুবিধাজনক মনীষীর জন্মদিনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে উৎসব ধামাকা মাচিয়ে তরুণ প্রজন্মকে বুঁদ করে রাখো।
আর তরুণ প্রজন্ম কোন আদর্শ গ্রহণ করবে, কোন পথে ভারতবর্ষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে , তা তাদেরকেই ঠিক করতে হবে। একটি পথ সহজ, শাসকের অনুগ্রহভাজক, সমৃদ্ধির পথ। মাস্টারদার পথ বিপদসঙ্কুল, শাসকের রক্তচক্ষু, সর্বস্ব ত্যাগের পথ। আর কে না জানে তরুণ প্রজন্ম শাসকের রক্তচক্ষুকে থোড়াই কেয়ার করে।

পুরনো লেখা। আবার দিলাম। শহীদ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি

সূর্য সেন – আজও শাসকের আতঙ্ক – গৌর অধিকারী

সকলেই জানেন যে ১৯৩৪ সালের বারোই জানুয়ারি সূর্য সেনের ফাঁসি হয়। কিন্তু তিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়তে পারেন নি। কিংবা বীরদর্পে ফাঁসির মঞ্চে উঠে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে পারেন নি। যা ছিল সে যুগের বিপ্লবীদের পক্ষে স্বাভাবিক কাজ।
তার কারণ ফাঁসির আগেই ব্রিটিশ সেনা ও জেল কর্তৃপক্ষ মাস্টারদার উপর নামিয়ে আনে ভয়ঙ্কর নৃশংস অত্যাচার। সাঁড়াশি দিয়ে তাঁর প্রত্যেকটি আঙুলের নখ উপড়ে নেওয়া হয়। হাতুড়ি দিয়ে তাঁর সমস্ত দাঁত তুলে নেওয়া হয়। তাঁকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, তখন তিনি মৃত বা প্রায় মৃত। এমনকি মৃতদেহটিকেও তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় নি। সেটিকে বঙ্গোপসাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তার সুযোগ্য সহকারী বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারকে তারই সঙ্গে একই ভাবে নৃশংস অত্যাচার, অর্ধমৃত অবস্থায় ফাঁসিতে ঝোলানো ও দেহ লোপাট করা হয়।
কেন এরকম করা হলো। ইংরেজ শাসকেরা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করলেও এ ধরনের নৃশংসতা, এত পৈশাচিকতা একেবারেই বিরল। বিচার প্রক্রিয়ার সময়, পুলিশ হেফাজতে, জেলখানায়, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর বহু অত্যাচার হয়েছে, কিন্তু ফাঁসির আদেশ হয়ে যাওয়ার পর কিংবা ফাঁসির সময় এরকম নৃশংসতা বিরল। সূর্য সেনের মতো এত বড়মাপের নেতার ক্ষেত্রে তো বটেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ফাঁসির মঞ্চে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহস, দেশপ্রেম, মৃত্যুর মুখে অটল জীবনের জয়গান, দেখে বহু ব্রিটিশ রাজপুরুষ সসম্ভ্রমে মাথা নীচু করেছে।
মাস্টারদার বেলায় কেন এমন ঘটনা হলো যে ফাঁসির দিন ব্রিটিশ সেনারা তার উপর নৃশংস বর্বর অত্যাচার করে নিথর দেহটাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিল। দেহটাকে লুকিয়ে ফেলল লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সেই কথাই আমি লিখতে চাই। আর সামনের প্রজাতন্ত্র দিবসে এটাই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ মত হল যে, আন্দোলনের দুটি মূল ধারা। একটি গান্ধীজির নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগের ধারা, অপরটি হল গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। বাংলায় দুটি ধারাতেই ইংরেজবিরোধী সংগ্রাম ছিল এবং অতি প্রবলভাবেই ছিল। দুই ধারারই সংগ্রামীদের উপর নেমে এসেছিল শাসক ইংরেজের প্রবল আক্রমণ। অনেকের ধারণা আছে যে অহিংস ধারার আন্দোলনকারীদের ওপর বুঝি বিশেষ অত্যাচার হয় নি। নেতাদের ক্ষেত্রে ধারনাটি আংশিক সত্যি হলেও সাধারণ কর্মীদের বেলায় ঠিক নয়। প্রবল আক্রমণ ছিল। পুলিশের লাঠির আঘাতে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে, চির পঙ্গু হয়েছেন, অনেক সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর সহিংস বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। যে অত্যাচার বর্বরতার সম্মুখীন তারা হয়েছেন, ইতিহাসের পাতা থেকে মানুষের স্মৃতিপটে তা লেখা আছে।
অবিভক্ত বাংলায় মুখ্য দুটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল ছিল যুগান্তর আর অনুশীলনী গোষ্ঠী। বাংলার যে যেখানে সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় সকলেই এই দুটি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবী দলটি ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

সূর্য সেন চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী যুব দলটি গড়ে তুলেছিলেন সেটিকে কিন্তু কোনো গোষ্ঠীরই শাখা হতে দেন নি। অথচ মাস্টারদা যখন বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়তেন, সেই সময় যুগান্তর দলের বিশিষ্ট নেতা সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীর সংস্পর্শে এসেই বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তার কয়েকজন বিশেষ সহকর্মী অনুশীলনী দলে যোগ দিলেও মাস্টারদা তার সংগঠনটিকে সর্বদা স্বতন্ত্র রেখেছিলেন। ( কেন তিনি যুগান্তর বা অনুশীলনীতে যোগ দেন নি, এটা এখানে আলোচনা করলে প্রসঙ্গ অন্তর হবে )। মোট কথা হল সে সময়ে বাংলার অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কার্য পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ ছিল। তাহলে কি ছিল মাস্টারদার কর্মপদ্ধতি? এটা বুঝতে পারলে কেন মাস্টারদা আর তার সহকর্মীদের উপর ব্রিটিশদের এতো রাগ তার কারণ বোঝা যাবে।
মাস্টারদা ইতস্তত কিছু ব্রিটিশ রাজপুরুষ কিংবা তাদের নেটিভ সহচরদের ব্যক্তিহত্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি বিকল্প স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন। এর জন্যে চাই এক সশস্ত্র সৈনিক দল। যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করবে। মাস্টারদা তৈরি করলেন সেই সশস্ত্র বাহিনী। নাম দিলেন – ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি সেই সময় ইংরেজের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছিল তিনি সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী তৈরি করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি সৃষ্টির বহু আগে মাস্টারদার এই মহান প্রচেষ্টা। সেই সময় সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র বাহিনীর চিন্তা নেহাতই কল্পনার বিষয়, অথবা কল্পনাতেই নেই। সেই সময় সুভাষচন্দ্রকে বাংলা কংগ্রেস সভাপতির পদ নিয়ে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত দের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করতে হচ্ছে।
ভারতবর্ষের সংগ্রামে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি শুধুমাত্র প্রথম সশস্ত্র বাহিনী নয়, আরও অনেক দিক থেকে অনন্য। এই বাহিনী ছিল দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সর্বস্ব ত্যাগী একদল তরুণ তরুণী দিয়ে গড়া। ( ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি কিন্তু মূলত ব্রিটিশ ভারত সেনা যারা যুদ্ধে জাপানি দ্বারা বন্দী হয়েছিল তাদের নিয়ে গড়া। এতে অবশ্যই কিছু সংখ্যক পূর্ব এশিয়া নিবাসী ভারতীয় যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু বাহিনী ছিল মূলত যুদ্ধবন্দীদের নিয়েই। এই বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল এবং এক বিরাট সংখ্যক সেনা সাহসের সঙ্গে রণক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তা সত্বেও একথা মানতেই হবে যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোদ্ধারা ছিলেন পেশাদার সৈনিক, আর ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির যোদ্ধারা ছিলেন বাংলার অসামরিক অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলার বীর বিপ্লবী। প্রসঙ্গত একটু উল্লেখ করতে চাই যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (INA) প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু না সুভাষচন্দ্র, না রাসবিহারী বসু। এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোহন সিং এবং জ্ঞানী প্রীতম সিং। যদি কোনোদিন সুযোগ পাই সে কাহিনী লেখা যাবে। কিন্তু এতো স্বল্প পরিসরে সেটা সম্ভব নয়। এক মহাগ্রন্থ হয়ে যাবে )।
INA গঠনের অন্তত 12 বছর আগে এই বাংলার একটি প্রান্তে একজন স্কুল মাস্টারের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী সেনা বাহিনী গঠিত হল। এত বড় দেশের একটি ক্ষুদ্র প্রান্তে হলেও তার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বিশাল।

INA গঠনের অন্তত 12 বছর আগে এই বাংলার একটি প্রান্তে একজন শান্ত সৌম্য স্কুল মাস্টারের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী সেনা বাহিনী গঠিত হল। এত বড় দেশের একটি ক্ষুদ্র প্রান্তে হলেও তার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বিশাল। কত বিশাল ? মাস্টারদা যে বাহিনী গঠন করলেন তার নাম রাখলেন – ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ। লক্ষ্য করে দেখুন, একমাত্র বাহিনী হলেও তিনি একে চট্টগ্রাম শাখা হিসেবে চিহ্নিত করলেন। মাস্টারদার স্বপ্ন ছিল যে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি সারা দেশ জুড়ে গড়ে উঠবে। চট্টগ্রামের মতো তার শাখা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। দেশের জন্য আত্মত্যাগে প্ৰস্তুত তরুণ তরুণীদের বিশাল এক বাহিনী। অহিংস অসহযোগ নয়, অস্ত্র হাতে গুপ্ত হত্যা নয়, দেশজুড়ে সামরিক বাহিনী গড়ে ব্রিটিশদের উৎখাত করে বিকল্প রাস্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি একে একে ব্রিটিশ কোম্পানির টাকা লুট, নাখরখানা পাহাড়ের লড়াই, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ, সারা চট্টগ্রাম জুড়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলে জাতীয় সরকার গঠনের মত যুগান্তকারী কাজ সমাধা করলো। এর বিস্তৃত বিবরণ আমি দেব না, কারণ আপনারা তা জানেন। আর যদি না জানেন অবশ্যই জেনে নেবেন, না জানাটা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও।
বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়েদ্দার, গনেশ ঘোষ, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী, প্রমুখ ভারতের শ্রেষ্ঠ বীর সন্তানদের কীর্তি না জানাটা নিতান্তই লজ্জার। এই বীরত্বময় সংগ্রামই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পূর্ণ নতুন এক ধারা।
আগেই বলেছি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মূলত দুটি ধারার কথা পাঠ্য ইতিহাসে লিখিত হয়। একটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, অপরটি সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী। তৃতীয় একটি ধারা যাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি, সেটি হল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহগুলো ছিল ব্যাপক সর্বাত্মক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সশস্ত্র। এই বিদ্রোহগুলি কেবলমাত্র শাসকদের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল অত্যাচারী জমিদার, দেশীয় রাজা, প্রতিনিধি কর আদায়কারী এদের বিরুদ্ধেও। তখনকার শিক্ষিত জাতীয়তাবাদীরা প্রায় সকলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল এবং সরাসরি জমিদারদের সঙ্গে জড়িত থাকায় তারা এইসব বিদ্রোহে সমর্থন করেন নি। পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতে ইতিহাস রচনার সময়ে উপযুক্ত স্বীকৃতি পর্যন্ত দেন নি।
মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম, স্বাধীনতা আন্দোলনের চতুর্থ একটি স্বতন্ত্র ধারা।

ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম অন্যসব ধারার তুলনায় অনন্য এক পর্যায়। কোথায় তা স্বতন্ত্র, কেন ইংরেজদের মাস্টারদার প্রতি এতো রাগ তা আমরা বোঝার চেষ্টা করবো।
লক্ষ্য করে দেখবেন অন্য তিনটি ধারার লড়াইয়ে কোথাও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে, কোথাও ইংরেজ রাজ কর্মচারী বা নেটিভ সাকরেদদের হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের কোনো পরিকল্পনা সেখানে নেই। কাজে পরিণত করা তো অনেক দুরস্থান। মাস্টারদা সশস্ত্র বাহিনী গড়ে শুধু ইংরেজ শাসনকে উৎখাতই করেন নি। তিনি প্রথম ভারতবর্ষের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে স্বাধীন ভারতের নতুন সরকার গঠন করলেন। সেনা ক্যান্টনমেন্ট এবং পুলিশ থানাগুলি দখল করে বিকল্প প্রশাসন চালু করলেন। পুলিশ লাইনে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে মুক্তি বাহিনীর গার্ড অব অনার গ্রহণ করলেন। টানা চার দিন চট্টগ্রাম স্বাধীন ভারতবর্ষ হয়ে রইল। ভারতের ইতিহাসে এ এক অনন্য নজির।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির রণকৌশলও ছিল যেমন অভিনব তেমনই কার্যকরী। বাহিনী কয়েকটি ট্যাকটিকাল দলে বিভক্ত রাখা হয়েছিল এবং প্রতিটি দলের একজন নেতৃত্ব ছিল। এই দলগুলো একসঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাত করতো। সেনাদের অস্ত্রাগার লুন্ঠন, মালগাড়ি উল্টিয়ে দিয়ে রেল যোগাযোগ রুদ্ধ করে দেওয়া, টেলিফোন অফিস গুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সবই প্রায় একযোগে ঘটানো হয়েছিল। এই রণকৌশলের সফল প্রয়োগ যে কোনো অনভিজ্ঞ ভারতীয় বিপ্লবী দল করতে পারে, এটা ইংরেজ শাসকদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। তারা সাময়িকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির মধ্যে একটি জাতীয় গণমুক্তি ফৌজের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও উপাদান বর্তমান ছিল। শিক্ষিত সবল অনুপ্রাণিত একদল তরুণ তরুণী যারা আদর্শ বোধে উজ্জ্বল, প্রাণদানে সতত প্রস্তুত। বাহিনীর মধ্যে দলনেতা আছে কিন্তু সকলেই সম শ্রদ্ধাভাজন। বিকল্প নেতৃত্ব সর্বদা প্রস্তুত। বেতন নাই, রসদ সংগ্ৰহ করে নিতে হয়। (আজাদ হিন্দ ফৌজে কিন্তু সৈনিকদের বেতন ছিল। তার বাস্তবতাও ছিল। কিন্তু আপত্তিকর যেটি ছিল তা হল বাহিনীর ওপর তলার অফিসারদের সঙ্গে সাধারণ সৈনিকদের বেতনে দৃষ্টিকটুভাবে বেতন বৈষম্য। একটা মুক্তি বাহিনীর পক্ষে যা একেবারে বেমানান। আমার লেখা “সুভাষ চন্দ্র – ভাবমুর্তিতে ও ইতিহাসে” বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ) চরিত্রে, তৎপরতায়, দ্রুত আঘাত হানার ক্ষমতায়, আদর্শে, ত্যাগে শ্রেষ্ঠ এইরকম একটা বাহিনীকে ইংরেজরা যে ভয়, সম্ভ্রম, বিষ দৃষ্টিতে দেখবেই তাতে সন্দেহ কি। আর যার নেতৃত্বে এই ভয়ঙ্কর দল গড়ে উঠেছে, যার আদর্শের টানে শত শত তরুণ তরুণী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, যার এই অত্যাশ্চর্য রণকৌশল, তিনি যে ব্রিটিশ রাজের সবচেয়ে বড় শত্রু হবেন এ তো জানা কথা।
আর একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, এতো দিন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যত লড়াই হয়েছে সব পুলিশের সঙ্গে, সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষ। এবং এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন চলেছে তা পুলিশ দ্বারাই। এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসক মিলিটারি বাহিনী ব্যবহার করেছে, এ অতি বিরল ঘটনা। তার দরকারও তারা অনুভব করে নি। মাস্টারদার লড়াই ছিল কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি জানতেন যদি সশস্ত্র পদ্ধতিতে লড়াই করতে হয়, তা করতে হবে ওই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গেই। ভারতবর্ষের মাটিতে এই প্রথম কোনো সংগ্রাম প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে স্বাধীন ভারতের নিশান ওড়ালো, প্রতিহিংসা নেবে না ? যে মানুষটার নেতৃত্বে এই মহাসংগ্রাম, যার অভিনব রণকৌশল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিল, সবচেয়ে বড় কথা যিনি সশস্ত্র বিপ্লবী ধারায় সঠিক পথটি চিনিয়ে দিল, তাকে কি বীর শহীদের মর্যাদা দেওয়া যায় ? তার মৃতদেহের শেষ স্মৃতিটুকু পর্যন্ত নষ্ট করে দাও।
স্বাধীন ভারতবর্ষেও মাস্টারদার পথ শাসকের পক্ষে বড় বিপদজনক। ওই আদর্শ যেন যুব সমাজের সামনে না আসে। তাই যুব সমাজের নতুন আইকন সৃস্টি করে তার পুজো করো। মাস্টারদার শহীদ দিবসে শাসকের পক্ষে সুবিধাজনক মনীষীর জন্মদিনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে উৎসব ধামাকা মাচিয়ে তরুণ প্রজন্মকে বুঁদ করে রাখো।
আর তরুণ প্রজন্ম কোন আদর্শ গ্রহণ করবে, কোন পথে ভারতবর্ষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে , তা তাদেরকেই ঠিক করতে হবে। একটি পথ সহজ, শাসকের অনুগ্রহভাজক, সমৃদ্ধির পথ। মাস্টারদার পথ বিপদসঙ্কুল, শাসকের রক্তচক্ষু, সর্বস্ব ত্যাগের পথ। আর কে না জানে তরুণ প্রজন্ম শাসকের রক্তচক্ষুকে থোড়াই কেয়ার করে।

পুরনো লেখা। আবার দিলাম। শহীদ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি

সূর্য সেন – আজও শোষক দের আতংক মৃনাল চৌধুরী লিটন)

সকলেই জানেন যে ১৯৩৪ সালের বারোই জানুয়ারি সূর্য সেনের ফাঁসি হয়। কিন্তু তিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়তে পারেন নি। কিংবা বীরদর্পে ফাঁসির মঞ্চে উঠে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে পারেন নি। যা ছিল সে যুগের বিপ্লবীদের পক্ষে স্বাভাবিক কাজ।
তার কারণ ফাঁসির আগেই ব্রিটিশ সেনা ও জেল কর্তৃপক্ষ মাস্টারদার উপর নামিয়ে আনে ভয়ঙ্কর নৃশংস অত্যাচার। সাঁড়াশি দিয়ে তাঁর প্রত্যেকটি আঙুলের নখ উপড়ে নেওয়া হয়। হাতুড়ি দিয়ে তাঁর সমস্ত দাঁত তুলে নেওয়া হয়। তাঁকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, তখন তিনি মৃত বা প্রায় মৃত। এমনকি মৃতদেহটিকেও তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় নি। সেটিকে বঙ্গোপসাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তার সুযোগ্য সহকারী বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারকে তারই সঙ্গে একই ভাবে নৃশংস অত্যাচার, অর্ধমৃত অবস্থায় ফাঁসিতে ঝোলানো ও দেহ লোপাট করা হয়।
কেন এরকম করা হলো। ইংরেজ শাসকেরা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করলেও এ ধরনের নৃশংসতা, এত পৈশাচিকতা একেবারেই বিরল। বিচার প্রক্রিয়ার সময়, পুলিশ হেফাজতে, জেলখানায়, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর বহু অত্যাচার হয়েছে, কিন্তু ফাঁসির আদেশ হয়ে যাওয়ার পর কিংবা ফাঁসির সময় এরকম নৃশংসতা বিরল। সূর্য সেনের মতো এত বড়মাপের নেতার ক্ষেত্রে তো বটেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ফাঁসির মঞ্চে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহস, দেশপ্রেম, মৃত্যুর মুখে অটল জীবনের জয়গান, দেখে বহু ব্রিটিশ রাজপুরুষ সসম্ভ্রমে মাথা নীচু করেছে।
মাস্টারদার বেলায় কেন এমন ঘটনা হলো যে ফাঁসির দিন ব্রিটিশ সেনারা তার উপর নৃশংস বর্বর অত্যাচার করে নিথর দেহটাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিল। দেহটাকে লুকিয়ে ফেলল লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সেই কথাই আমি লিখতে চাই। আর সামনের প্রজাতন্ত্র দিবসে এটাই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ মত হল যে, আন্দোলনের দুটি মূল ধারা। একটি গান্ধীজির নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগের ধারা, অপরটি হল গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। বাংলায় দুটি ধারাতেই ইংরেজবিরোধী সংগ্রাম ছিল এবং অতি প্রবলভাবেই ছিল। দুই ধারারই সংগ্রামীদের উপর নেমে এসেছিল শাসক ইংরেজের প্রবল আক্রমণ। অনেকের ধারণা আছে যে অহিংস ধারার আন্দোলনকারীদের ওপর বুঝি বিশেষ অত্যাচার হয় নি। নেতাদের ক্ষেত্রে ধারনাটি আংশিক সত্যি হলেও সাধারণ কর্মীদের বেলায় ঠিক নয়। প্রবল আক্রমণ ছিল। পুলিশের লাঠির আঘাতে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে, চির পঙ্গু হয়েছেন, অনেক সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর সহিংস বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। যে অত্যাচার বর্বরতার সম্মুখীন তারা হয়েছেন, ইতিহাসের পাতা থেকে মানুষের স্মৃতিপটে তা লেখা আছে।
অবিভক্ত বাংলায় মুখ্য দুটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল ছিল যুগান্তর আর অনুশীলনী গোষ্ঠী। বাংলার যে যেখানে সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় সকলেই এই দুটি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবী দলটি ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

সূর্য সেন চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী যুব দলটি গড়ে তুলেছিলেন সেটিকে কিন্তু কোনো গোষ্ঠীরই শাখা হতে দেন নি। অথচ মাস্টারদা যখন বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়তেন, সেই সময় যুগান্তর দলের বিশিষ্ট নেতা সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীর সংস্পর্শে এসেই বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তার কয়েকজন বিশেষ সহকর্মী অনুশীলনী দলে যোগ দিলেও মাস্টারদা তার সংগঠনটিকে সর্বদা স্বতন্ত্র রেখেছিলেন। ( কেন তিনি যুগান্তর বা অনুশীলনীতে যোগ দেন নি, এটা এখানে আলোচনা করলে প্রসঙ্গ অন্তর হবে )। মোট কথা হল সে সময়ে বাংলার অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কার্য পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ ছিল। তাহলে কি ছিল মাস্টারদার কর্মপদ্ধতি? এটা বুঝতে পারলে কেন মাস্টারদা আর তার সহকর্মীদের উপর ব্রিটিশদের এতো রাগ তার কারণ বোঝা যাবে।
মাস্টারদা ইতস্তত কিছু ব্রিটিশ রাজপুরুষ কিংবা তাদের নেটিভ সহচরদের ব্যক্তিহত্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি বিকল্প স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন। এর জন্যে চাই এক সশস্ত্র সৈনিক দল। যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করবে। মাস্টারদা তৈরি করলেন সেই সশস্ত্র বাহিনী। নাম দিলেন – ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি সেই সময় ইংরেজের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছিল তিনি সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী তৈরি করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি সৃষ্টির বহু আগে মাস্টারদার এই মহান প্রচেষ্টা। সেই সময় সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র বাহিনীর চিন্তা নেহাতই কল্পনার বিষয়, অথবা কল্পনাতেই নেই। সেই সময় সুভাষচন্দ্রকে বাংলা কংগ্রেস সভাপতির পদ নিয়ে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত দের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করতে হচ্ছে।
ভারতবর্ষের সংগ্রামে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি শুধুমাত্র প্রথম সশস্ত্র বাহিনী নয়, আরও অনেক দিক থেকে অনন্য। এই বাহিনী ছিল দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সর্বস্ব ত্যাগী একদল তরুণ তরুণী দিয়ে গড়া। ( ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি কিন্তু মূলত ব্রিটিশ ভারত সেনা যারা যুদ্ধে জাপানি দ্বারা বন্দী হয়েছিল তাদের নিয়ে গড়া। এতে অবশ্যই কিছু সংখ্যক পূর্ব এশিয়া নিবাসী ভারতীয় যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু বাহিনী ছিল মূলত যুদ্ধবন্দীদের নিয়েই। এই বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল এবং এক বিরাট সংখ্যক সেনা সাহসের সঙ্গে রণক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তা সত্বেও একথা মানতেই হবে যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোদ্ধারা ছিলেন পেশাদার সৈনিক, আর ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির যোদ্ধারা ছিলেন বাংলার অসামরিক অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলার বীর বিপ্লবী। প্রসঙ্গত একটু উল্লেখ করতে চাই যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (INA) প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু না সুভাষচন্দ্র, না রাসবিহারী বসু। এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোহন সিং এবং জ্ঞানী প্রীতম সিং। যদি কোনোদিন সুযোগ পাই সে কাহিনী লেখা যাবে। কিন্তু এতো স্বল্প পরিসরে সেটা সম্ভব নয়। এক মহাগ্রন্থ হয়ে যাবে )।
INA গঠনের অন্তত 12 বছর আগে এই বাংলার একটি প্রান্তে একজন স্কুল মাস্টারের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী সেনা বাহিনী গঠিত হল। এত বড় দেশের একটি ক্ষুদ্র প্রান্তে হলেও তার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বিশাল।

INA গঠনের অন্তত 12 বছর আগে এই বাংলার একটি প্রান্তে একজন শান্ত সৌম্য স্কুল মাস্টারের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী সেনা বাহিনী গঠিত হল। এত বড় দেশের একটি ক্ষুদ্র প্রান্তে হলেও তার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বিশাল। কত বিশাল ? মাস্টারদা যে বাহিনী গঠন করলেন তার নাম রাখলেন – ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ। লক্ষ্য করে দেখুন, একমাত্র বাহিনী হলেও তিনি একে চট্টগ্রাম শাখা হিসেবে চিহ্নিত করলেন। মাস্টারদার স্বপ্ন ছিল যে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি সারা দেশ জুড়ে গড়ে উঠবে। চট্টগ্রামের মতো তার শাখা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। দেশের জন্য আত্মত্যাগে প্ৰস্তুত তরুণ তরুণীদের বিশাল এক বাহিনী। অহিংস অসহযোগ নয়, অস্ত্র হাতে গুপ্ত হত্যা নয়, দেশজুড়ে সামরিক বাহিনী গড়ে ব্রিটিশদের উৎখাত করে বিকল্প রাস্ট্র ব্যবস্থা স্থাপন।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি একে একে ব্রিটিশ কোম্পানির টাকা লুট, নাখরখানা পাহাড়ের লড়াই, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ, সারা চট্টগ্রাম জুড়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলে জাতীয় সরকার গঠনের মত যুগান্তকারী কাজ সমাধা করলো। এর বিস্তৃত বিবরণ আমি দেব না, কারণ আপনারা তা জানেন। আর যদি না জানেন অবশ্যই জেনে নেবেন, না জানাটা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও।
বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়েদ্দার, গনেশ ঘোষ, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী, প্রমুখ ভারতের শ্রেষ্ঠ বীর সন্তানদের কীর্তি না জানাটা নিতান্তই লজ্জার। এই বীরত্বময় সংগ্রামই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পূর্ণ নতুন এক ধারা।
আগেই বলেছি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মূলত দুটি ধারার কথা পাঠ্য ইতিহাসে লিখিত হয়। একটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, অপরটি সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী। তৃতীয় একটি ধারা যাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি, সেটি হল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহগুলো ছিল ব্যাপক সর্বাত্মক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সশস্ত্র। এই বিদ্রোহগুলি কেবলমাত্র শাসকদের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল অত্যাচারী জমিদার, দেশীয় রাজা, প্রতিনিধি কর আদায়কারী এদের বিরুদ্ধেও। তখনকার শিক্ষিত জাতীয়তাবাদীরা প্রায় সকলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল এবং সরাসরি জমিদারদের সঙ্গে জড়িত থাকায় তারা এইসব বিদ্রোহে সমর্থন করেন নি। পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতে ইতিহাস রচনার সময়ে উপযুক্ত স্বীকৃতি পর্যন্ত দেন নি।
মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম, স্বাধীনতা আন্দোলনের চতুর্থ একটি স্বতন্ত্র ধারা।

ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম অন্যসব ধারার তুলনায় অনন্য এক পর্যায়। কোথায় তা স্বতন্ত্র, কেন ইংরেজদের মাস্টারদার প্রতি এতো রাগ তা আমরা বোঝার চেষ্টা করবো।
লক্ষ্য করে দেখবেন অন্য তিনটি ধারার লড়াইয়ে কোথাও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে, কোথাও ইংরেজ রাজ কর্মচারী বা নেটিভ সাকরেদদের হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের কোনো পরিকল্পনা সেখানে নেই। কাজে পরিণত করা তো অনেক দুরস্থান। মাস্টারদা সশস্ত্র বাহিনী গড়ে শুধু ইংরেজ শাসনকে উৎখাতই করেন নি। তিনি প্রথম ভারতবর্ষের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে স্বাধীন ভারতের নতুন সরকার গঠন করলেন। সেনা ক্যান্টনমেন্ট এবং পুলিশ থানাগুলি দখল করে বিকল্প প্রশাসন চালু করলেন। পুলিশ লাইনে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে মুক্তি বাহিনীর গার্ড অব অনার গ্রহণ করলেন। টানা চার দিন চট্টগ্রাম স্বাধীন ভারতবর্ষ হয়ে রইল। ভারতের ইতিহাসে এ এক অনন্য নজির।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির রণকৌশলও ছিল যেমন অভিনব তেমনই কার্যকরী। বাহিনী কয়েকটি ট্যাকটিকাল দলে বিভক্ত রাখা হয়েছিল এবং প্রতিটি দলের একজন নেতৃত্ব ছিল। এই দলগুলো একসঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাত করতো। সেনাদের অস্ত্রাগার লুন্ঠন, মালগাড়ি উল্টিয়ে দিয়ে রেল যোগাযোগ রুদ্ধ করে দেওয়া, টেলিফোন অফিস গুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সবই প্রায় একযোগে ঘটানো হয়েছিল। এই রণকৌশলের সফল প্রয়োগ যে কোনো অনভিজ্ঞ ভারতীয় বিপ্লবী দল করতে পারে, এটা ইংরেজ শাসকদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। তারা সাময়িকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির মধ্যে একটি জাতীয় গণমুক্তি ফৌজের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও উপাদান বর্তমান ছিল। শিক্ষিত সবল অনুপ্রাণিত একদল তরুণ তরুণী যারা আদর্শ বোধে উজ্জ্বল, প্রাণদানে সতত প্রস্তুত। বাহিনীর মধ্যে দলনেতা আছে কিন্তু সকলেই সম শ্রদ্ধাভাজন। বিকল্প নেতৃত্ব সর্বদা প্রস্তুত। বেতন নাই, রসদ সংগ্ৰহ করে নিতে হয়। (আজাদ হিন্দ ফৌজে কিন্তু সৈনিকদের বেতন ছিল। তার বাস্তবতাও ছিল। কিন্তু আপত্তিকর যেটি ছিল তা হল বাহিনীর ওপর তলার অফিসারদের সঙ্গে সাধারণ সৈনিকদের বেতনে দৃষ্টিকটুভাবে বেতন বৈষম্য। একটা মুক্তি বাহিনীর পক্ষে যা একেবারে বেমানান। আমার লেখা “সুভাষ চন্দ্র – ভাবমুর্তিতে ও ইতিহাসে” বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ) চরিত্রে, তৎপরতায়, দ্রুত আঘাত হানার ক্ষমতায়, আদর্শে, ত্যাগে শ্রেষ্ঠ এইরকম একটা বাহিনীকে ইংরেজরা যে ভয়, সম্ভ্রম, বিষ দৃষ্টিতে দেখবেই তাতে সন্দেহ কি। আর যার নেতৃত্বে এই ভয়ঙ্কর দল গড়ে উঠেছে, যার আদর্শের টানে শত শত তরুণ তরুণী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, যার এই অত্যাশ্চর্য রণকৌশল, তিনি যে ব্রিটিশ রাজের সবচেয়ে বড় শত্রু হবেন এ তো জানা কথা।
আর একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, এতো দিন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যত লড়াই হয়েছে সব পুলিশের সঙ্গে, সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষ। এবং এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন চলেছে তা পুলিশ দ্বারাই। এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসক মিলিটারি বাহিনী ব্যবহার করেছে, এ অতি বিরল ঘটনা। তার দরকারও তারা অনুভব করে নি। মাস্টারদার লড়াই ছিল কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি জানতেন যদি সশস্ত্র পদ্ধতিতে লড়াই করতে হয়, তা করতে হবে ওই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গেই। ভারতবর্ষের মাটিতে এই প্রথম কোনো সংগ্রাম প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে স্বাধীন ভারতের নিশান ওড়ালো, প্রতিহিংসা নেবে না ? যে মানুষটার নেতৃত্বে এই মহাসংগ্রাম, যার অভিনব রণকৌশল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিল, সবচেয়ে বড় কথা যিনি সশস্ত্র বিপ্লবী ধারায় সঠিক পথটি চিনিয়ে দিল, তাকে কি বীর শহীদের মর্যাদা দেওয়া যায় ? তার মৃতদেহের শেষ স্মৃতিটুকু পর্যন্ত নষ্ট করে দাও।
স্বাধীন ভারতবর্ষেও মাস্টারদার পথ শাসকের পক্ষে বড় বিপদজনক। ওই আদর্শ যেন যুব সমাজের সামনে না আসে। তাই যুব সমাজের নতুন আইকন সৃস্টি করে তার পুজো করো। মাস্টারদার শহীদ দিবসে শাসকের পক্ষে সুবিধাজনক মনীষীর জন্মদিনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে উৎসব ধামাকা মাচিয়ে তরুণ প্রজন্মকে বুঁদ করে রাখো।
আর তরুণ প্রজন্ম কোন আদর্শ গ্রহণ করবে, কোন পথে ভারতবর্ষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে , তা তাদেরকেই ঠিক করতে হবে। একটি পথ সহজ, শাসকের অনুগ্রহভাজক, সমৃদ্ধির পথ। মাস্টারদার পথ বিপদসঙ্কুল, শাসকের রক্তচক্ষু, সর্বস্ব ত্যাগের পথ। আর কে না জানে তরুণ প্রজন্ম শাসকের রক্তচক্ষুকে থোড়াই কেয়ার করে।

শহীদ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি