সোনালি অধ্যায়ের রচয়িতা স্যাম ‘বাহাদুর’ মানেকশ

প্রকাশিত: ৬:২৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০২০

স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষে বিজয়ের মাসজুড়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন প্রেক্ষিত সম্পর্কে নানা আয়োজন থাকছে বণিক বার্তায়। আজকের উপস্থাপনাটি স্যাম মানেকশকে নিয়ে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা। বার্মায় জাপানিদের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে। জাপানিদের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণে যাচ্ছে ৪/১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের একটি ইউনিট। নেতৃত্বে তরুণ ক্যাপ্টেন স্যাম মানেকশ। তীব্র প্রতিরোধ গড়েও শেষ পর্যন্ত পিছু হটে জাপানিরা। দুর্ধর্ষ ইউনিটটির এ সফল প্রত্যাঘাত শেষে দেখা গেল ক্যাপ্টেন স্যাম মানেকশ আহত। পাকস্থলীতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি।

স্যাম মানেকশ ও তার ইউনিটের বীরত্ব প্রচণ্ড নাড়া দিল ডিভিশন প্রধান মেজর জেনারেল ডিটি কাওয়ানকে। মুমূর্ষু তরুণ ক্যাপ্টেন বীরত্বের স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছিলেন তিনি। দ্রুত নিজের মিলিটারি ক্রস রিবনটিই ক্যাপ্টেন মানেকশকে পরিয়ে দিলেন ডিটি কাওয়ান। ক্যাপ্টেনের সাহসিকতার প্রশংসা করলেও ঝুঁকি নেয়ার জন্য মৃদু তিরস্কার করে বললেন, মৃত ব্যক্তির পক্ষে মিলিটারি ক্রস পাওয়া সম্ভব নয়।

ডিটি কাওয়ানের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে বেঁচে উঠলেন ক্যাপ্টেন স্যাম মানেকশ। পরে ভারতের সেনাপ্রধান হয়েছিলেন তিনি। বলা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশটির সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে সুখপ্রদ সময় পার করেছিল তার অধীনেই।

ভারতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সামরিক পদ ফিল্ড মার্শাল পর্যন্ত উঠতে পেরেছিলেন মাত্র দুজন ব্যক্তি। তাদেরই একজন স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ। সাহসিকতা ও দুর্ধর্ষতার জন্য অধীনদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘স্যাম বাহাদুর’ হিসেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেপরোয়া সাহসিকতার জন্য খ্যাতি পেলেও পরিণত বয়সে অনেক হিসেবী, প্রাজ্ঞ ও কৌশলী সেনানায়ক হয়ে উঠেছিলেন স্যাম বাহাদুর। সমসাময়িকরা বলছেন, দেশভাগের পর পরই ১৯৪৭-৪৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে সামরিক অপারেশন চালানোর সময়ই তার মধ্যে একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ সেনানায়কের সব লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল।

ঠোঁটকাটা চাঁছাছোলা জবাব এবং ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ার জন্য বেসামরিক প্রশাসনে মানেকশর জনপ্রিয়তা কিছুটা কম ছিল। ১৯৬১ সালে সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী কর্মকর্তা লে. জেনারেল বিএম কাউলের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন স্যাম বাহাদুর। বিএম কাউল ছিলেন ভারতের তত্কালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভিকে কৃষ্ণ মেননের কাছের মানুষ। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের দুই নেতৃস্থানীয়র সঙ্গে বিবাদে জড়ানোয় তার ক্যারিয়ার পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

কিন্তু এর মধ্যেই ১৯৬২ সালে শুরু হয় চীন-ভারত যুদ্ধ। যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উত্তর-পূর্ব সীমান্ত সংস্থা (এনইএফএ) মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ওই সময়ে এ বিপর্যয়ের জন্য কৃষ্ণ মেনন ও বিএম কাউলকে দায়ী করা হলে তারা দুজনেই পদত্যাগ করেন। ওই সময় নেহরু মানেকশকে পদোন্নতি দিয়ে এনইএফএতে পিছু হটতে থাকা ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার করে পাঠান।

ইতিহাস বলছে, কমান্ড পোস্টে স্যাম বাহাদুরের আবির্ভাব ওই সময় ভারতীয় অফিসার ও সৈনিকদের মনোবল অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। ওই সময় মানেকশর নেতৃত্বে ভারতীয় সৈন্যরা চীনাদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

পরের বছরই তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান করে পাঠানো হয়। ১৯৬৪ সালে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে বদলি হয়ে আসেন তিনি। ১৯৬৮ সালে নাগাল্যান্ডে অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হন তিনি, যার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করা হয়।

১৯৬৯ সালে তত্কালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান পিপি কুমারামঙ্গলম অবসর গ্রহণ করলে তার স্থলাভিষিক্ত হন মানেকশ। দায়িত্ব নিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যুদ্ধোপযোগী দক্ষ একটি বাহিনী হিসেবে ঢেলে সাজানোয় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে চীন-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান তিনি।

মানেকশর ওই সময়ের ভূমিকাকে তার অধস্তন জেএফআর জ্যাকব বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘১৯৬২ সালের পরাজয় ও ১৯৬৫ সালের অমীমাংসিত যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মান তিনি পুনরুদ্ধার করেছেন। সবসময় তিনি সেনাবাহিনীর স্বার্থে কাজ করেছেন। আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেননি। পরে তিনি অত্যন্ত সফল, সম্ভবত ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল এক সেনানায়কে পরিণত হন।’

মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলায় মানেকশর গৃহীত উদ্যোগগুলো প্রথমবারের মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। মার্চে পাকিস্তানিদের ক্র্যাকডাউন শুরু হলে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে শরণার্থী পাড়ি জমায় ভারতে। শরণার্থীর চাপে প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের রাজ্য সরকার তখন দিশেহারা। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যগুলোর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়তই দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একের পর এক টেলিগ্রাম পাঠানো হচ্ছে। 

এ সমস্যা সমাধানে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন তার দেশের সেনাবাহিনী তখনই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। এপ্রিলের শেষ দিকে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে স্যাম মানেকশকে তখনই সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের নির্দেশ দেন তিনি।

স্যাম বাহাদুর গোটা পরিস্থিতি তুলে ধরে জানালেন, ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে ওই সময়েই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া অসম্ভব। বিষয়টিতে ইন্দিরা গান্ধী হতাশ হলেও তাকে প্রস্তুতি নিতে বলেন।

শুরু থেকেই এ বিষয়ে মানেকশর ওপর ভারত সরকারের চাপ ছিল। এ কারণে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ওই বৈঠকের আগে এপ্রিলের শুরুতেই মানেকশ এ বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে প্রস্তুতি শুরু করতে বলেছিলেন। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের তত্কালীন চিফ অব স্টাফ জেএফআর জ্যাকব (ওই সময় মেজর জেনারেল) পরে জানান, এপ্রিলের শুরুর দিকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এসএইচএফজে মানেকশ টেলিফোনে তাকে বলেন, সরকার চাইছে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করুক। জেএফআর জ্যাকব ওই সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীন সেনাবাহিনীর প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরলে মানেকশ জানতে চান, প্রস্তুতি নিতে কতদিন লাগতে পারে। উত্তরে জ্যাকব জানান, কমপক্ষে ১৫ নভেম্বর।

ইতিহাস বলছে, ওই সময় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মূল্যায়নকে সঠিক বিবেচনায় স্যাম বাহাদুর সরকারের চাপের মুখেও নতি স্বীকার করেননি। এপ্রিলের শেষ দিককার ওই মন্ত্রিসভা বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর সামনে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরেন তিনি।

তাত্ক্ষণিকভাবে যুদ্ধে যোগদানে স্যাম মানেকশর ওই অস্বীকৃতিকে পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরাও সঠিক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, ভারত তখন কোনোভাবেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওই অবস্থায় দেশটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অনেক বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিল।

পরের মাসগুলো স্যাম মানেকশ যুদ্ধের জন্য বাহিনীকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি রসদ সরবরাহসহ খুঁটিনাটি নানা সমস্যা সমাধানে অতিবাহিত করেন। একই সঙ্গে পশ্চিম ফ্রন্ট (পশ্চিম পাকিস্তান) ও পূর্ব ফ্রন্টে যুগপৎ যুদ্ধ চালানোর জন্য কৌশল নির্ধারণও করতে থাকেন তিনি।

নয়াদিল্লিভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের অধ্যাপক পিআর চারি স্যাম বাহাদুরের চৌকস ও কৌশলী রণচাতুর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, পর্যবেক্ষণভিত্তিক প্রজ্ঞা এবং হিসেবী উপায়ে কিন্তু অপ্রত্যাশিত সময়ে অপ্রত্যাশিত কাজে পটুতার এক অনন্য উদাহরণ তিনি।

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগদানের ১৩ দিনের মাথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এর পেছনে মানেকশর রণকৌশল ও তার অধীনদের হাতে এর দক্ষ বাস্তবায়ন অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে বলে পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময়টিকেই বলা চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালি অধ্যায়, যার রচয়িতা ছিলেন স্যাম মানেকশ।

ওই সময়ের সাফল্য সত্ত্বেও মানেকশ নিজের অবস্থানগত মর্যাদা ধরে রাখার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলে জানাচ্ছেন তার সহকর্মীরা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের তত্কালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পরবর্তী সময়ে জানান, ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময়ে স্যাম মানেকশকে সেখানে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু স্যাম বাহাদুর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধানই এ সম্মানের দাবিদার। আমি সেখানে তখনই যেতে পারি, যখন গোটা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।

সুএ। বনিক বার্তা