মুক্তিযোদ্ধা সায়েরা বেগমের যত দুংখ

প্রকাশিত: ৭:৪৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৯, ২০২০

সায়রা বেগম। মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব রণাঙ্গনে যার অবদানের কথা মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকরা তাদের গ্রন্থে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ২০১৬ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতাও পেয়ে আসছিলেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের চার শর্ত পূরণ করতে না

বিজয়নগর উপজেলার ৬১ মুক্তিযোদ্ধার ভাতা স্থগিত করেছেন ইউএনও।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মিলিশিয়া ক্যাম্পে হানাদার বাহিনীর সহযোগী ও বেতনভুক্ত নারীকর্মীর কন্যা হাজেরা বেগম কুট্টিকে গেজেটভুক্ত করায়ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃত নারী মুক্তিযোদ্ধা সায়রা বেগমকে বাদ দিয়ে বিতর্কিত এক নারীকে গেজেটভুক্ত করায় মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি

হয়েছে।

জানা গেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সায়রার বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। তার বাবা আবদুল আজিজ চৌকিদার ছিলেন রাজাকার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনুকম্পা লাভের আশায় এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর প্ররোচনায় নিজ কন্যা মাহারা সায়রাকে একদিন মুকুন্দপুর ক্যাম্পে রেখে আসেন আজিজ। সেখানে থাকার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সায়রার যোগাযোগ তৈরি হয়। ক্যাম্পের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থানসহ তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন তিনি। সায়রার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লে. সাঈদের নেতৃত্বে একাত্তরের ১৮ নভেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মুকুন্দপুর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। ১৯ নভেম্বর মুক্ত হয় মুকুন্দপুর। এতে বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ২৯ জন আত্মসমর্পণ করে।

২০১১ সালের ১৯ নভেম্বর মুকুন্দপুর মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ৩নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল সাঈদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সায়রা বেগমের অবদানের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি জেনারেল সাঈদ এক প্রত্যয়নপত্রে সায়রা বেগমকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিদানের অনুরোধ জানান। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় সায়রা বেগম মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতার আবেদন করার পর ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। কিন্তু চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিজয়নগর ইউএনও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর টেলিফোনের নির্দেশের উদ্ৃব্দতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সায়রা বেগমসহ বিজয়নগর উপজেলার ৬১ জন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা স্থগিত করেন এবং একই চিঠিতে তাদের ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে গৃহীত ভাতা ফেরত দেওয়ারও নির্দেশ দেন।

এ ব্যাপারে বিজয়নগরের ইউএনও মেহের নিগার বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য কিছু তথ্যপ্রমাণের নির্দেশনা আছে। যাদের তা প্রমাণের কাগজপত্র নেই কিংবা যারা এসব কাগজ জমা দিতে পারেননি, তাদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ভাতা ফেরত দিতে বলা হয়েছে।’

গত মঙ্গলবার সায়রার সেজামোড়ার বাড়িতে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাতা বন্ধ করলে বৃদ্ধ মা, স্বামীছাড়া মেয়ে ও নাতনিকে নিয়ে কীভাবে চলব? জীবন বাজি রাইখ্যা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দেওয়া কী আমার অপরাধ হয়েছে? তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন রোগভোগের পর স্বামী গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি নিঃস্ব। দেখা গেছে, তার বসবাসের ঘরটিও জরাজীর্ণ। টিনের চালায় অসংখ্য ফুটো। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘ভাতা না পাইলে আমি কি খামু, বৃষ্টিবাদলার দিনে এ ঘরে কেমনে থাকুম?’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’, মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার ‘একাত্তরের কন্যা জায়া জননী’ ও স্থানীয় গবেষক কবি জয়দুল হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক মুকুন্দপুর যুদ্ধে সায়রা বেগমের ভূমিকা ও অবদানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, গেরিলা কমান্ডার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকার বলেন, এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধারা আমরণ অনশন করতে বাধ্য হবেন।

বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, সায়রা বেগমসহ ৬১ জনের সবাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আমি এই বিতর্কিত নির্দেশের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং অবিলম্বে আবার ভাতা চালুর আহ্বান জানাই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবু হোরায়রাহ, মুক্তিযোদ্ধা দাবি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ওয়াসেল সিদ্দিকী, বিজয়নগর উপজেলার সাবেক কমান্ডার হাবিলদার তারা মিয়া বলেন, সায়রা বেগমসহ ৬১ জনের ভাতা বন্ধ করা ও হাজেরা বেগম কুট্টির মতো বিতর্কিতদের গেজটভুক্ত করা- এই দুই ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। আমরা অবিলম্বে এই দুই আদেশ বাতিলের দাবি জানাই। অন্যথায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় শত শত মুক্তিযোদ্ধা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইব।

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি উভয় ঘটনাকে নিন্দনীয় ও দুঃখজনক উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি হিসাবে আমরা বিতর্কিত অ-মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে রেজুলেশন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয়ে শুনানিতে উপস্থিত হয়ে তথ্যপ্রমাণও দাখিল করেছি। এরএরপরও তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। কোথাও একটা গলদ আছে নিশ্চয়