শ্রীশ্রী ত্রিপুরেশ্বরী মাতাবাড়ি, গোমতী জেলা, ত্রিপুরার। বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৯:০৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৪, ২০২০ আলোচনায় আজ ত্রিপুরার ত্রিপুরেশ্বরী মাতাবাড়ি। শ্রীশ্রী ত্রিপুরেশ্বরী মাতাবাড়ি,উদয়পুর,গোমতী জেলা,ত্রিপুরা। ১৭৬০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে রাঙামাটি তথা বর্তমান উদয়পুর ছিলো ত্রিপুরার রাজধানী। মন্দিরনগরী উদয়পুরের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট বড় বহু মন্দির,প্রাসাদ,স্মৃতিসৌধ।অনেকগুলিই আজ অযত্নে অবহেলায় ধ্বংসের পথে,অনেকগুলি আবার পুনর্জন্ম পেয়েছে সরকারী সাহায্যের স্পর্শে আবার কিছু স্থাপত্য বজায় রেখেছে তাদের সুপ্রাচীন গৌরব উপরন্তু বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের যশ। এমনি এক সুপ্রাচীন ইতিহাসের গৌরবময় সাক্ষ্য বহন করে চলেছে শ্রীশ্রী ত্রিপুরেশ্বরী মাতাবাড়ি মন্দির। ভক্তকুলের কাছে মাতাবাড়ি নামেই অধিক পরিচিত এই মন্দির। উদয়পুর শহর থেকে ৫ কিমি. দূরে মাতাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত মায়ের মন্দির। মায়ের মন্দিরের নামে গ্রামের নামও মাতাবাড়ি,এমনকি ঐ অঞ্চলের বিধানসভা কেন্দ্রের নাম আর ব্লকের নামও মাতাবাড়ি। মাতা ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির পুণ্য ৫১ শক্তিপীঠের এক পীঠ। কূর্ম বা কচ্ছপের পৃষ্ঠের আকৃতি বিশিষ্ট অনুচ্চ টিলার উপর অবস্থিত মাতৃমন্দির,তাই এই পীঠকে অনেকে কূর্মপীঠও বলেন। তবে জনমানসে দেবী ত্রিপুরেশ্বরী নামে সুপ্রসিদ্ধা হলেও দেবীর শাস্ত্রসম্মত নাম কিন্তু ত্রিপুরাসুন্দরী।দেবীর ভৈরব ত্রিপুরেশ মহাদেবও প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন মাতাবাড়ি থেকে প্রায় ৪ কিমি. দূরে উদয়পুর শহরের উপকণ্ঠে বিজয়সাগর দীঘির পাড়ে। মহাদেবের নামে মন্দিরের নামের সাথে সাথে মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের নামও মহাদেব বাড়ি। পীঠনির্ণয় তন্ত্রানুয়ায়ী মাতা ত্রিপুরেশ্বরী হলেন ৫১পীঠের মধ্যে পঞ্চদশতম পীঠ। “ত্রিপুরায়াং দক্ষপাদো দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী। ভৈরবর্স্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বাভীষ্ট প্রদায়কঃ।।” অর্থাৎ,দেবী সতীর ডান পা পতিত হয়েছে ত্রিপুরায়।দেবী হলেন ত্রিপুরাসুন্দরী আর ভৈরব হলেন ত্রিপুরেশ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ত্রিপুরা সফরে আসা অসম রাজার দুই দূত তাদের বিবরণীতে দেবীকে “ত্রিপুরা ঠাকুরানী” নামে উল্লেখ করেছেন। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রচিত সমসের গাজীর আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ গাজীনামায় পাওয়া যায় যে,সেই সময় ত্রিপুরার প্রজাসাধারণের মধ্যে মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী পরিচিত ছিলেন ”মাতা ঠাকুরানী” নামে। মাতা ত্রিপুরেশ্বরী হলেন ত্রিপুরার অধিষ্ঠাত্রী দেবী,অর্থাৎ ত্রিপুরার ঈশ্বরী তিনি।তাই হয়তো মায়ের ত্রিপুরেশ্বরী নামটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মধ্যযুগের ত্রিপুরার প্রবল পরাক্রান্ত রাজা, মহারাজ ধন্যমাণিক্য ১৫০১ খৃষ্টাব্দে উদয়পুরে কূর্মপীঠের উপর এই মন্দির নির্মাণ করান ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে,কিন্তু বিষ্ণু বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই মহারাজ স্বপ্নাদেশ পেলেন ভগবতী আদ্যাশক্তির, যে চট্টগ্রাম থেকে দেবী চট্টেশ্বরীর বিগ্রহ এনে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হোক,কারণ এই কূর্মপীঠ ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম। রাজমালার ধন্যমাণিক্য খণ্ডে রয়েছে- “আর এক মঠ দিতে আরম্ভ করিল। বাস্তুপূজা সঙ্কল্প বিষ্ণুপ্রীতে কৈল।। ভগবতী রাজাতে স্বপ্ন দেখায় রাত্রিতে। এই মঠে আমা স্থাপ রাজা মহাসত্বে।। চাটিগ্রাম চট্টেশ্বরী তাহার নিকট। প্রস্তরেতে আমি আছি আমার প্রকট।। তথা হতে আনি আমা এই মঠে পূজ। পাইবা বহুল বর যেই মতে ভজ।।” স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মহারাজ ব্রাহ্মণদের সাথে পরামর্শ করে সেনাপতি রসাঙ্গমর্দ্দন নারায়ণকে চট্টগ্রামে পাঠালেন দেবীবিগ্রহ উদয়পুরে নিয়ে আসার জন্য। চট্টগ্রাম তখন ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে,আর ত্রিপুরেশ্বরীর এই বিগ্রহ চট্টগ্রামে এক গাছের নীচে চট্টেশ্বরী রূপে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মগ সম্প্রদায়ের দ্বারা পূজিত হচ্ছেন। এই সম্পর্কে ‘ত্রিপুর বংশাবলী’তেও বলা হয়েছে, রাজাকে ভগবতী স্বপ্নাদেশ দিচ্ছেন যে- “এই মঠে যদি আমা স্থাপন না কর। তবে জান রাজা তোমার নাহিক নিস্তার।। চট্টগ্রামে সদরঘাটে এক বৃক্ষমূলে। পূজয়ে আমাকে সদা মগধ সকলে।। সেই স্থান হৈতে শীঘ্র আনহ আমায়।” যাই হোক রসাঙ্গমর্দ্দন মগেদের বিতাড়িত করে মহাসমারোহে দেবীবিগ্রহ উদয়পুরে নিয়ে আসেন।কূর্মপীঠের নবনির্মিত মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলেন দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী। এই বিষয়ে রাজমালার বক্তব্য- “রসাঙ্গমর্দ্দন নারায়ণ পাঠায় চট্টলে। স্বপ্নে সেই স্থান দেখে মিলিলেক ভালে।। উৎসব মঙ্গলবাদ্যে রাজ্যেতে আনিল। সত্ত্বর গমনে রাজা নমস্কার কৈল।। কতদিন পরে মঠ প্রস্তুত হইল। পুণ্যাহ দিনেতে রাজা উৎসর্গিয়া দিল।।” কিন্তু দেবীর সাথে একই বেদীতে প্রতিষ্ঠিত হলেন শালগ্রামশিলা রপে জগৎপালক বিষ্ণু’ও, যিনি আজও মন্দিরে রয়েছেন ও নিত্যসেবিত হচ্ছেন। শক্তিদেবী আর বিষ্ণুর সহাবস্থান এই মন্দিরকে দিয়েছে এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য।হিন্দুধর্মের আপাত পরস্পরবিরোধী দুই মতের প্রতি ত্রিপুরার রাজাদের সহনশীলতা আর শ্রদ্ধাবোধও ফুটে উঠেছে এখানে। মন্দিরের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো মাতা ত্রিপুরেশ্বরীর ডানপাশেই প্রতিষ্ঠিত আছেন মাতা ত্রিপুরেশ্বরীর বিগ্রহের আদলেরই আরেকটি অপেক্ষাকৃত ছোট কষ্টিপাথরের শক্তিবিগ্রহ,ভক্তরা এনাকে “ছোটমা” নামে ডাকেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় একশো বছরেরও বেশী সময় পরে মাতা ত্রিপুরাসুন্দরীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মহারাজা কল্যাণমাণিক্য তাঁর রাজত্বকালের(১৬২৬-৬০ খৃঃ) কোন এক সময়ে মন্দিরের পূর্ব দিকের নীচু জমিতে একটি দীঘি খনন করিয়ে মায়ের সেবাপূজার জন্য মায়ের নামে উৎসর্গ করেন,এই দীঘির নাম কল্যাণসাগর। বলা হয় এই দীঘি খনন করার সময়ই “ছোটমা”র বিগ্রহ পাওয়া যায় এবং মাতা ত্রিপুরেশ্বরীর সাথে রূপসাদৃশ্যের কারণে মন্দিরেই “ছোটমা” রূপে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন। আবার আরেক জনশ্রুতির মতে মাতাবাড়ীর পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মছড়ায় জলমগ্ন অবস্থায় ছিলেন ছোটমা,রাজা সেখান থেকে এনাকে উদ্ধার করে এনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। ছোটমার প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুদ্ধের সময় নাকি রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন ছোটমাকে, মাতা ত্রিপুরেশ্বরীর প্রতিনিধি রূপে। মায়ের মূল বিগ্রহ চট্টগ্রাম থেকে ১৫০১ সালে আনা হয়েছিলো ঠিকই,কিন্তু এর আগেও মগেরা চট্টগ্রামে এই বিগ্রহে চট্টেশ্বরীর পূজা করতো,তাই বিগ্রহের সঠিক বয়স নির্ণয় করা যায় নি।তবে গঠনবৈচিত্র্য দেখে অনেকে বলেন যে সম্ভবত দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে তৈরী করা হয়েছিলো মায়ের এই বিগ্রহ। উৎকৃষ্ট কষ্টিপাথরের তৈরী বিগ্রহ,উচ্চতা ১মিটার ৫৭ সে.মি.।প্রস্থ ৬৪ সে.মি.। দেবীর চারটি হাত।ডানদিনের উপরের হাতে বরমুদ্রা,নীচের হাতে একটি অভয়মুদ্রা।বামদিকের উপরের হাতে খড়্গ ও নীচের হাতে একটি অসুরমুণ্ড।মাথায় জটামুকুট আর দুপাশে জটার রাশি,গলায় ১৩ টি মুণ্ডের মালা,মুখমণ্ডল লম্বাটে,গোলাকার দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট চোখ,ললাটে তৃতীয়নয়ন,চ্যাপ্টা নাসিকা।শবাসনে শায়িত মহাদেবের বক্ষে দুই পা স্থাপন করে দেবী দণ্ডায়মান। বিগ্রহ একটি পাথরের বেদীর উপর স্থাপিত। অনেকে এই বিগ্রহকে বৌদ্ধ তন্ত্রজানের দেবী বলে অভিহিত করেছেন।উল্লেখ্য, এই বিগ্রহ আগে চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মগেদের দ্বারা পূজিত হতো,আর চট্টগ্রামে একসময় বৌদ্ধ প্রভাব ছিলো প্রবল। ছোটমা’র বিগ্রহের উচ্চতা ৪৮ সে.মি. আর প্রস্থ ৩৫ সে.মি.।এনারও নাক চ্যাপ্টা আর ছোট চোখ।একসময় মাথায় জটামুকুট ছিলো তা বোঝা যায়,কিন্তু বর্তমানে তা অস্পষ্ট। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ বিপ্রদাস পালিতের মতে মাতাবাড়ীর মন্দির ত্রিপুরার নিজস্ব স্থাপত্যরীতির উজ্জ্বল নিদর্শন।মন্দিরটি স্তূপশীর্ষ বিশিষ্ট চারচালাকৃতির,মন্দিরের বাইরের দিকে চারকোণায় চারটি অর্ধবৃত্তাকার ঠেসনার মতো মিনার ক্রমশ ছোট হয়ে খাড়াভাবে উঠে ছাদের কার্নিশে মিলেছে,যা ইসলামিক আমলের মিনারের আদলে তৈরী।ছাদ চারচালার যা বাংলার চারচালা মন্দিরের অনুকরণে।চারচালার উপর বৌদ্ধস্তূপ।স্তূপের উপর অন্ত্র,তার উপর পদ্ম,তার উপর কলস ও ধ্বজ যা হিন্দু সংস্কৃতির থেকে অনুপ্রাণিত।পালিত বাবুর মতে মন্দিরের গঠনশৈলী দেখে বোঝা যায় যে মহারাজা ধন্যমাণিক্য হিন্দু,বৌদ্ধ ও ইসিলামিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে মন্দির গড়তে চেয়েছিলেন। মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে পোড়া ইটের তৈরী,মন্দিরের প্রধানদ্বার পশ্চিমমুখী,উত্তর দিকেও একটি দ্বার আছে,দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে রয়েছে একটি কুলুঙ্গি।গর্ভগৃহের অভ্যন্তর গোলাকার।মূল ভূমি থেকে উঁচু একটি চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মন্দিরের মূল ভিত্তিচত্বর।মূলমন্দিরের সম্মুখে নাটমন্দির,তার সম্মুখে রয়েছে বলিঘর,মূল মন্দিরের গাত্রবর্ণ লাল। ১৫০১ সালে মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৫ বার মন্দিরের সংস্কার করা হয়েছে। মন্দির নির্মাণের ৭০/৭৫ বছর পর মহারাজা উদয়মাণিক্যের সেনাপতি রণাগণ নারায়ণ প্রথম মন্দির সংস্কার করান।আবার মহারাজা অমরমাণিক্যের রাজত্বে মগ আক্রমণে মন্দিরের বিস্তর ক্ষতি হয়,মন্দিরের চূড়ার স্বর্ণকলসও মগেরা লুঠ করে নিয়ে যায়,পরে মহারাজা কল্যাণমাণিক্য তাঁর রাজত্বকালে(১৬২৬-৬০) ২য় বার মন্দির সংস্কার করান।আবার ১৬৮১ সালে মহারাজা রামমাণিক্য মন্দির সংস্কার করান।৪র্থ বারে ১৮৫৭ সালে মহারাণী জগদীশ্বরী দেবী ও ৫ম বারে ১৯০৪ সালে মহারাজা রাধাকিশোরমাণিক্য মন্দির সংস্কার করান। এইসবই মন্দির গাত্রে প্রোথিত শিলালিপিতে এবং রাজমালায় উল্লেখিত আছে। ৫০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরে পরিবর্তন ঘটে নি পূজাপদ্ধতির,মহারাজ ধন্যমাণিক্যের প্রচলিত নিয়মেই পুজো হয়ে আসছে আজ অবধি।মাতা ত্রিপুরেশ্বরী পূজিতা হন ষোড়শী রূপে আর ছোটমা পূজিতা হন চণ্ডী রূপে। ভোর ৪ টায় মন্দিরের দ্বার খুলেই শুরু হয় মঙ্গলারতি,সকাল ৫ টায় বাল্যভোগ,সকাল ৮ টায় মায়ের স্নান ও শৃঙ্গার,সকাল ৯ টায় শুরু হয় নিত্যপূজা।সকাল ১১ টায় শুরু হয় বলি,প্রথমে সরকারী তরফে একটি করে পাঁঠা প্রত্যহ বলি হয়।তারপরে ভক্তদের মানতের পাঁঠা,কবুতর,হাঁস বলি হয়,তবে দশমী তিথিতে বলি বন্ধ থাকে। দুপুর ১২ টায় পুষ্পাঞ্জলি,দুপুর ১:৩০ টায় পঞ্চব্যঞ্জন,পাঁঠার মাংস,লুচি,মিষ্টি সহকারে অন্নভোগ নিবেদন করার পর দুপুর ২ টা থেকে ৩ টা মায়ের বিশ্রামের সময় মন্দির বন্ধ থাকে।৩ টায় আবার খোলা হয় দ্বার।কেও চাইলে কুপন কেটে অন্নপ্রসাদও গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যহ সন্ধ্যায় মায়ের সন্ধারতি দেখবার মতো,প্রায় ৫০ মিনিট যাবত চলে সন্ধ্যারতি। রাত ৯ টায় শীতল ভোগ নিবেদন,রাত ১০ টায় শয়নারতি। প্রতি অমাবস্যায় রাত ১১:৩০ টায় শুরু হয় নিশিপূজা,অমাবস্যার রাতে ১ টি মহিষ,৫ টি পাঁঠা,১ টি হাঁসের ডিম,১ টি আদা বলি দেওয়া হয় সরকারী তরফে। দীপান্বিতা ও দুর্গাষ্টমীতে হয় মায়ের বিশেষ পূজা। দীপান্বিতার রাতে দুইবার পূজা হয়,একবার নিশিপূজা আরেকবার দীপান্বিতার বিশেষ পূজা।এইদিন সরকারী তরফের বলিও থাকে অন্যান্য অমাবস্যার থেকে দ্বিগুণ। দীপান্বিতা উৎসব মাতাবাড়ীর প্রধান উৎসব।এইসময় সমস্ত মন্দিরচত্বর সেজে উঠে আলোকসজ্জায়।বসে দুইদিনব্যাপী বিরাট মেলা।এই দুইদিনে কয়েক লক্ষ ভক্তসমাগম ঘটে মাতাবাড়িতে। মন্দিরের উত্তর দিকের দরজা দিয়ে ভক্তরা মায়ের পুজো দিতে পারেন,আর মায়ের দর্শনের জন্য রয়েছে পশ্চিমদিকের প্রধান দরজা। গর্ভগৃহে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মায়ের প্রিয় নৈবেদ্য হলো ক্ষীরের পেঁড়া।মন্দির চত্বরেই রয়েছে অগণিত পেঁড়ার দোকান,অনেকেই বংশপরম্পরায় এই ব্যবসা করছেন। মায়ের প্রসাদী পেঁড়ার স্বাদই আলাদা,অন্য কোনখানের পেঁড়াতেই এই স্বাদ পাওয়া যায় না। মায়ের মন্দির পরিচালনা ব্যবস্থার নিয়মেও রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রভাব।মন্দিরের পুরোহিতেরা ব্রাহ্মণ কিন্তু তাঁদের সহকারী টলুয়ারা* বাঙালী কায়স্থ।এঁরা গর্ভগৃহ পরিষ্কার করা,পূজার বাসন মাজা,ফুল বেলপাতা তোলার কাজ করেন। মালীরা* বাঙালী মালাকার সম্প্রদায়ের, এঁরা বাগানের কাজ করেন।বলির কাজের জন্য রয়েছে গালিম* যারা উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক।অমাবস্যার রাতে মন্দিরে মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন জোলাই*,এঁরাও উপজাতি সম্প্রদায়ের। উল্লেখ্য,মাতাবাড়ির দক্ষিণে অবস্থিত একটি জনপদের নাম জোলাইবাড়ি কারণ জোলাইরা অই অঞ্চলের বাসিন্দা। এছাড়াও রয়েছে ভাণ্ডারী, ঢাকী,পাচক। রাজন্য আমলে মন্দির পাহারায় নিযুক্ত সেপাইরা ছিলো মুসলমান। এঁরা সবাই বংশ পরম্পরায় মন্দিরের কাজে নিযুক্ত। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর মায়ের সেবাপূজার জন্য মাহারাজা ধন্যমাণিক্য কনৌজ থেকে বাৎসল্য গোত্রের গদাধর পাণ্ডে এবং শাণ্ডিল্য গোত্রের ধনঞ্জয় পাণ্ডে নামক দুই ব্রাহ্মণকে আনিয়ে নিষ্কর জমি দান করে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন ও চক্রবর্ত্তী উপাধিতে ভূষিত করেন। এঁদের অধস্তন যথাক্রমে ১৯তম ও ১৮তম পুরুষই বর্তমানে মায়ের পূজার কাজ করছেন। রাজন্য আমলে মন্দিরের যাবতীয় দায়িত্বভার আর খরচ বহন করতেন মহারাজা।১৯৪৯ সালে ত্রিপুরার ভারতভুক্তির পর চুক্তি অনুসারে মন্দিরের যাবতীয় খরচ,রক্ষণাবেক্ষণ,পরিচালনার দায়িত্ব এখন ভারত সরকারের। এখন গোমতী জেলার জেলাশাসক হলেন মায়ের প্রধান সেবাইত,তাঁর হয়ে কাজ করেন উদয়পুরের মহকুমা শাসক। মায়ের নামে বহু দেবোত্তর সম্পত্তিও ছিলো এককালে,কিন্তু বেশ কিছু এখন বেদখল। মায়ের নামে রয়েছে বহু বহু গয়না,রাজ আমল থেকেই জমা হচ্ছে অলঙ্কার,এখনো ভক্তেরা মানত পূর্ণ হলে মাকে অলঙ্কার দেন।সব অলঙ্কার জমা থাকে ট্রেজারীতে।দীপান্বিতা আর দুর্গাষ্টমীতে মাকে রাজবেশে সাজানো হয় সম্পূর্ণ স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে। মাতা ত্রিপুরেশ্বরীকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী শোনা যায় ত্রিপুরায়। মুসলিম ধর্মাবলম্বী সমসের গাজী অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় উদয়পুর আক্রমণ করে,কিন্তু কোনমতেই রাজার সৈন্যের সাথে পেরে উঠছে না।সাতদিন ধরে যুদ্ধ চলছে,রাজা এদিকে যুদ্ধের জন্য মায়ের পুজো বন্ধ করে দেন।দেবী রুষ্টা হয়ে সমসেরকে স্বপ্নাদেশ দিলেন যে যুদ্ধজয়ের জন্য দেবীকে ষোড়শপচারে পূজা দিতে হবে।সমসের তাই করলো,ফলস্বরূপ যুদ্ধেও জিতলো। সেই থেকে আজও উদয়পুরের অনেক মুসলমান মাতাবাড়িতে এসে মাকে পুজো দেন। আবার মোগলেরা একবার উদয়পুর দখল করে মায়ের পূজা বন্ধ করে দেয়,দেবী রুষ্টা হয়ে মোগল শিবিরে মহামারীর অভিশাপ দিলে বহু মোগল সৈন্য মারা যায়,ফলে বাধ্য হয়ে মোগলেরা ত্রিপুরা ছেড়ে চলে যায়। মাতাবাড়িতে একসময় নরবলি হতো,মন্দির প্রাঙ্গণের দুইটি তালগাছের সাথে সুলক্ষণযুক্ত একটি হিন্দু বালককে বেঁধে বলি দেওয়া হতো,কিন্তু একবার বলির উপযুক্ত কোন হিন্দু বালক না পেয়ে এক মুসলমান বালককে আনা হলো বলির জন্য,কিন্তু বলির আগেই নাকি মায়ের বিগ্রহের সাথে সাথে মন্দিরের অভিমুখও ঘুরে গিয়েছিলো অন্যদিকে।সেই থেকে মাতাবাড়িতে নরবলি বন্ধ হয়ে যায়।শোনা যায় মন্দিরচত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে যে দুইটি তালগাছ রয়েছে সেখানেই নাকি নরবলি দেওয়া হতো। মায়ের দীঘি কল্যাণসাগরের জলে রয়েছে প্রচুর শোল আর গজার মাছ,সাথে বিরল প্রজাতির কচ্ছপও।ভক্তদের দেওয়া খাবারে সবাই বেশ হৃষ্টপুষ্ট।কিন্তু ঘাটে সবসময় কচ্ছপের দেখা মেলে না, বেশীরভাগ সময় তাঁরা গভীর জলেই থাকে,তবে মাঝেমাঝে কচ্ছপের দর্শন পাওয়া যায়,ভক্তরা ঘাটে কচ্ছপের দর্শন পাওয়াকে সৌভাগ্যের ইঙ্গিত মনে করে,কচ্ছপের পীঠে হাত বুলিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে এখানে,দীঘির কচ্ছপগুলিকে মায়ের আশীর্বাদধন্য বলে মনে করা হয়।কচ্ছপগুলিও মৃত্যুর আগে দীঘি থেকে উঠে কূর্মপীঠের টিলা বেয়ে উপরে উঠে মায়ের মন্দিরের সামনে গিয়ে তবে মৃত্যুবরণ করে,এও এক আশ্চর্যের বিষয়!মায়ের মহিমা নয়তো আর কি? মন্দিরচত্বরের উত্তর দিকে অবস্থিত হনুমান ও শিবমন্দিরের পাশেই রয়েছে অনেকগুলি কচ্ছপের সমাধি।উল্লেখ্য এই শিব কিন্তু মায়ের ভৈরব ত্রিপুরেশ মহাদেব নন।তবে মাতাবাড়িতে মায়ের দর্শনের পূর্বে উদয়পুর শহরে অবস্থিত মহাদেব বাড়িতে মায়ের ভৈরব ত্রিপুরেশ মহাদেবের দর্শন করা আবশ্যক,নইলে ত্রিপুরেশ্বরী দর্শনের সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায় না। ত্রিপুরার সর্বশেষ স্বাধীন মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্যের মৃত্যুর কিছুদিন আগে মায়ের বিগ্রহের চোখে জল দেখে ভীত হয়েছিলেন তৎকালীন পুরোহিত ঁজয়কুমার চক্রবর্ত্তী।মহারাজার কানে এই খবর গেলে তা শুনে নাকি মহারাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে নিজের আয়ু প্রায় শেষ।মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মহারাজা একটি রূপার ত্রিশূল মা’কে দান করেন।এখনও তা মায়ের বিগ্রহের ডানদিকে রয়েছে। ১৫০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল,৫০০ বছরেরও বেশী হয়ে গেলো।কিন্তু এতো বছরের এতো এতো উত্থান-পতনের সাক্ষ্মী থেকেও ত্রিপুরাবাসীর হৃদয় থেকে ম্লান হয়নি মায়ের মহিমা,উপরন্তু আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরোত্তর।ত্রিপুরার যেকোন হিন্দু বাড়িতে চলে যান,আর কিছু পান কিংবা না পান,মাতা ত্রিপুরেশ্বরীর একখানা ছবি পাবেনই পাবেন।নিত্যদিন ত্রিপুরাবাসীর স্মরণে,মননে থাকে মায়ের নাম আর শুভকাজের প্রারম্ভে করতে হয় মায়ের দর্শন,বর্তমানে এ এক অলিখিত নিয়মের রূপ নিয়েছে ত্রিপুরায়। সম্ভব হলে একবার, ঘুরে আসুন মায়ের বাড়ি মাতাবাড়ি ধামে ত্রিপুরেশ্বরী দর্শনে! তথ্যসূত্র- শ্রী জয়দীপ ভট্টাচার্য্য ধন্যবাদ শ্রী জয়দীপ ভট্টাচার্য্য Related posts:বিজয়নগর উপজেলায় বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন ইউ এন ও মেহের নিগারবিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম ইয়াছিন আরাফাতের আহবানবিজয়নগর উপজেলার হরষপুর ইউনিয়নে গণটিকা দান কাযক্রমের প্রথম দিনে টিকা নিলেন ৬ শত Post Views: ৩৫৩ SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: