সাহসী-লড়াকু একজন আমলার কথা

প্রকাশিত: ৪:২৩ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২০

করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা যখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছিল, যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অযোগ্যতা, নেতৃত্বহীনতা, দায়িত্বহীনতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছিল সর্বত্র। ঠিক সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরেকটি যুগান্তকারী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামকে সরিয়ে দিলেন, নতুন সচিব নিযুক্ত হলেন আবদুল মান্নান- এ যেন রণক্ষেত্রে সেনাপতি বদলের মতো। করোনার সঙ্গে যুদ্ধে বাংলাদেশ যখন দিশেহারা, পর্যদস্তু তখন সেই সময় সেনাপতি বদল নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল। অনেকেই বলেছিল যে, এইরকম মাঝপথে সেনাপতি বদল করলে কি কাজ ঠিকঠাক মতো হবে? নতুন সচিবকে তো বুঝে উঠতেই সময় লাগবে। কিন্তু আবদুল মান্নান একজন লড়াকু আমলা এবং তিনি প্রচলিত ধারার ‘ভিনগ্রহের আমলা’ নন। তিনি জনবান্ধব একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি জনগণের কল্যাণের নিয়োজিত। ৮ জুন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং দায়িত্ব নিয়েই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁকে যেন এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে নিয়তি। ১৩ জুন মারা গেলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী। স্ত্রীর মৃত্যুশোক সামলাতে না সামলাতেই তিনি জানলেন যে, তাঁর দুই সন্তানও করোনায় আক্রান্ত। তাঁদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। দায়িত্ব নেওয়ার পর এরকম একটি ঝড়ের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান। যিনি সৎ, নিষ্ঠাবান। যিনি দায়িত্বের প্রতি অবিচল, তিনি অবশ্যই সাহসী হবেন, লড়াকু হবেন- আবদুল মান্নান সেটা প্রমাণ করলেন। স্ত্রীর শোক নিজের বুকে চেপে রেখে, সন্তানের জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আড়াল করে তিনি এই সময়ের মধ্যেও ঘরে বসে কাজ করছেন, দিনে অন্তত ৫০ টি ফাইল নিষ্পত্তি করছেন। আমার সঙ্গে যখন তাঁর টেলিফোনে কথা হয় তখন তাঁর কণ্ঠ ছিল বাষ্পরুদ্ধ। তিনি বলেন যে, ‘আমি আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি। আমি যদি আমার সন্তান দুটোকেও হারাই তাহলে আমার কি হবে? আমার জন্য দোয়া করবেন’- এরকম মর্মস্পর্শী কথার পর তাঁর সাথে আমার আর কথা বলতে সাহস হচ্ছিল না, আমার সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও জানা ছিলো না। কিন্তু তিনি নিজেই যেন সাহসের প্রতীক, নিজেই যেন লড়াইয়ের প্রতীক। তিনি জানালেন যে, এর মধ্যেও তিনি বার্ন ইউনিটে কোভিড চিকিৎসা চালু করেছেন, এর মধ্যেও তিনি একক উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিসিআর ল্যাব চালু করেছেন। যেখানে কোভিড পরীক্ষা হবে। এই পিসিআর ল্যাবটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দিয়েছিল। একের পর এক কাজ করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তিনি বললেন যে, ‘আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।’ আবদুল মান্নানের সঙ্গে যদি এই বিপর্যয়টা না ঘটতো তাহলে তিনি সম্মুখ সমরে যেতেন, তিনি ঘরে বসে কাজ করতেন না। তিনি মাঠে যেতেন, বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করতেন, চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালাতেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও আবদুল মান্নান যে কাজগুলো করেছেন তা এক বছরেও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ করতে পারেনি। অথচ এই সময়টি তাঁর জন্য সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়, এমন পরিস্থিতিতে আমি, আপনি বা অন্য কেউ পরলে কাজ তো দূরের কথা, হয়তো সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে গুটিয়ে নিতাম। কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া এই লড়াকু আমলা। তিনি তাঁর দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাবান, অবিচল। তিনি মনে করেন যে, ‘শোককে চাপা দিয়ে যদি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন, তাহলে আমি একজন ক্ষুদ্র সরকারি কর্মচারী হয়ে কেন দেশের জন্য কাজ করতে পারবো না? শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পারবো না?’ আমরা সবসময় দেখি যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ্কটের সময়ে এমন কিছু লোককে বেছে নেন যে লোকগুলো পরীক্ষিত, যে লোকগুলো দুঃসময়ের সঙ্গী এবং আপাত দৃষ্টিতে দেখে সন্দেহ জাগে যে এরা হয়তো পারবে না। কারণ এরা হয়তো সেই রকম কেতাদুরস্ত নন, ঐরকম তথাকথিত পণ্ডিত নন, জ্ঞানপাপীও নন। কিন্তু তাঁরা আসলে যোদ্ধা, তাঁরা আসলে সাহসী যোদ্ধা। করোনা মোকাবেলার জন্য যে আবদুল মান্নানের মতো একজন সাহসী মানুষের খুব দরকার ছিল তা বোঝা গেল এই কয়েকদিনেই। এত শোককে ছাইচাপা দিয়ে যিনি করোনা মোকাবেলার কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন সেইরকম মানুষই তো দরকার এখন। সবক্ষেত্রে করোনা মোকাবেলার জন্য।