কোয়ারান্টাইনের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের

প্রকাশিত: ৮:১১ অপরাহ্ণ, মে ৮, ২০২০

কোয়ারান্টাইনের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায় কোভিড-১৯ এর দয়ায় আমাদের অতি পরিচিত হয়ে ওঠা একটি শব্দ হল ‘কোয়ারান্টাইন। শুধু একটি শব্দ মাত্র নয়। আমাদের জীবনের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা কোয়ারান্টাইন। এই শব্দটির উৎস কী? ইতিহাসই বা কী? কোয়ারান্টাইন শব্দটির মূলে আছে ‘কোয়ারান্টা। যার অর্থ চল্লিশ। চতুর্দশ শতকে ইউরোপ যে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামক কুখ্যাত মহামারী হয়েছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত শব্দটি উঠে আসে। সে সময়ে ইউরোপের কোনও কোনও বন্দরে যে সমস্ত জাহাজগুলি আসত, সেগুলিকে চল্লিশ দিন অপেক্ষা করত হত মাল খালাসের আগে। মহামারীর আগে এই চল্লিশ দিনের অবরোধের অর্থ দাঁড়ায়, কোনও সংক্রামিত এলাকা থেকে আগত ব্যক্তিবর্গের, যাঁরা আপাতভাবে অসুস্থ নয়, অন্যদের থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে আলাদা রাখা। চিকিৎসাশাস্ত্রে যে আইসোলেশন বলা হয়, তার সঙ্গে কোয়ারান্টাইনের তফাৎ হল, প্রথম ক্ষেত্রে অসুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। কোয়ারান্টাইনের ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি রোগটির বাহক হতে পারেন বা রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং সংক্রামক রোগের বিস্তার রোখার একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা হল কোয়ারান্টাইন। চতুর্দশ শতাব্দীতে শব্দটির জন্ম বলা হলেও, ব্যবস্থাটির ইতিহাস কিন্তু আরও পুরনো। আমাদের লৌকিক পরম্পরা থেকে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের লেভিটিকাসের ফরমান নিশ্চিত ভাবেই এই আলাদা করে রাখার সহস্রাব্দ প্রাচীন রীতির কথাই বলে। গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটাস খ্রী: পূ: পঞ্চম শতকেই রোগগ্রস্ত বা রোগের সম্ভাবনা আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার মধ্য দিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গিয়েছেন। খ্রীষ্টীয় ইতিহাসকালে খুব স্পষ্টভাবে আলাদা করে রাখার এই কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সময়ে ঘটা প্লেগ মহামারী রুখতে। এই ব্ল্যাক ডেথ এ রাজধানী কনস্টান্টিনোপোলে প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা যায় ৫৪২ খ্রীষ্টাব্দে। ৩-৪ মাস ধরে চলে এই মাহামারীর তাণ্ডব। এই পরবর্তী সময়ের মধ্যযুগের ইউরোপের এক ব্ল্যাক ডেথের কথা আগেই বলেছি। এই সূত্র ধরেই ১৬৬৫ সালের লণ্ডনের বিউবোনিক প্লেগের কথা আসে। বিউবোনিক শব্দটি এসেছে কুঁচকির স্ফীতি অর্থে। বস্তুত, এই ধরণের প্লেগে বগল, কুঁচকি ইত্যাদি অংশে স্ফীতি দেখা যায়। যাই হোক, মনে করা হয় ইউরোপ থেকে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে পৌঁছেছিল এই মহামারী। কোয়ারান্টাইনের সফল প্রয়োগ এই সময়ে ঘটেছিল একটি আকস্মিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ইংল্যাণ্ডের ডার্বিশায়ার ডেলস জেলার ইয়াম গ্রামের আলেকজান্ডার হ্যাডফিল্ড নামের এক দর্জির কাছে লণ্ডন থেকে কাপড়ের একটি গাঁটরির পার্সেল আসে। কাপড়ের সঙ্গে প্লেগ জীবাণুবাহী মাছির দেহ লেগে ছিল। চারদিন বাদে মারা যান দর্জি। আর মাসখানেকের মাথায় দর্জির সহকারী সহ আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় আতঙ্কিত ও সতর্ক হয়ে পড়েন গ্রামবাসী। প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা হিসাবে গ্রামটিতে কোয়ারান্টাইন চালু হয়। এর ফলও মেলে হাতেনাতে। মহামারী ছড়িয়ে পড়া এর দ্বারা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়। মহামারী ছড়িয়ে পড়া রুখতে এমন অনেকবার কোয়ারান্টাইনের আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস রয়েছে ইউরোপের নানা অংশে। এর মধ্যে ভেনিসিয় উপনিবেশ রাগুসা এ ১৩৭৭ সালে প্রবর্তিত কোয়ারান্টাইন বিধির কথা উল্লেখ করা যায়। এখানে প্রথমে ৩০ দিন কোয়ারান্টাইনের কথা বলা হয়। পরবর্তী সময়ে যা ৪০ দিন অবধি করা হয়ছিল। এ প্রসঙ্গে কর্ডন স্যানিটেয়ারের কথা বলা যায়। ফ্রান্সে এর প্রয়োগ হয়েছিল ইয়োলো ফিভারের সংক্রমণ আটকাতে। অস্ট্রিয় ও অটোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তে সশস্ত্র সেনা মোতায়েন থাকত এই কর্ডন রক্ষার্থে। ১৮-১৯ শতক জুড়ে প্রায় ১০০ বছর ধরে সীমান্ত সুরক্ষার মধ্য দিয়ে এই কোয়ারান্টাইন বিধি রক্ষণের চেষ্টা করা হয়। এসময় এই অঞ্চলে প্লেগ সংক্রমণ মুক্ত থাকার পেছনে এই ব্যবস্থাকে কারণ হিসাবে অনেকে অনেকে গণ্য করেন। একেবারে হালের ঘটনা হল, বর্তমান শতাব্দীর গোড়ায় আফ্রিকার মূলত তিনটি দেশে- লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন এবং গিনিতে এবোলা মহামারী রুখতে কোয়ারান্টাইন বিধির প্রয়োগ। লেখক বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক