রাজনীতি: কেজরিওয়াল ‘স্টাইল’

প্রকাশিত: ৩:১৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০

মাসুদ কামাল ।। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে পরপর দু’বার ৯০ শতাংশ আসনে জয়ী হওয়ার পর অনেকেই বলতে শুরু করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তার আম আদমি পার্টি আসলেই এক নতুন ধারার রাজনীতির প্রবর্তন করেছে। নির্বাচনে যে সাফল্য তারা দেখিয়েছে, সন্দেহ নেই—এটা পুরো ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে এক নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়। আসলেই কি আমআদমি পার্টি নতুন কোনও রাজনীতি করছে, নাকি পুরনো রাজনীতিকেই একটু উন্নত ব্যবস্থাপনার মধ্যে চর্চা করছে? মূল আলোচনার আগে, গেলো সপ্তাহে হওয়া এই নির্বাচনের চিত্রটি একটু দেখে নেওয়া যাক। ভারতের দিল্লি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি ৭০টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে জয়ী হয়েছে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৮টি আসন। আর ভারতীয় কংগ্রেস তাদের খাতাই খুলতে পারেনি। অথচ মাত্র নয় মাস আগে হয়ে যাওয়া লোকসভা নির্বাচনে এই দিল্লির সাতটি আসনের সবকটিই বিজেপি পেয়েছিল। কংগ্রেস ছিল দ্বিতীয় স্থানে। আম আদমি পার্টি তৃতীয়। তখনকার ভোটের হিসাবকে ভিত্তি ধরলে বিধানসভায় ৬৫টি আসন পাওয়ার কথা বিজেপির, কংগ্রেসের পাওয়ার কথা ৫টি এবং আম আদমির কোনও আসনই পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং পুরো উল্টো হয়েছে। দিল্লি কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোনও রাজ্য নয়। এটাকে বলা হয় ইউনিয়ন টেরিটরি। এখানে ৭০ সদস্যের একটি বিধানসভা আছে, বিধায়করা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। বিধানসভা আছে, রাজ্যের একটি মন্ত্রিসভাও আছে। কিন্তু তারপরও দিল্লির পুরো নিয়ন্ত্রণ দিল্লি সরকারের হাতে নেই। এখানে পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জমি—এসব সরাসরি কেন্দ্র সরকারের নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ দিল্লির পুলিশ কেজরিওয়ালের কথা শুনবে না, মানবে অমিত শাহের কথা। দিল্লি সরকার চাইলেই কোনও একটা জায়গা নির্বাচন করে সেখানে কোনও স্কুল কিংবা স্থাপনা তৈরি করতে পরবে না, কেন্দ্রের অনুমতি লাগবে। এরকম একটা ‘আধারাজ্য’র নির্বাচনে জয়ী হতে ক্ষমতাসীন বিজেপি চেষ্টা কিন্তু কম করেনি। বরং বলা যায় রীতিমতো বেপরোয়া প্রচেষ্টাই তারা করেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে একাধিক নির্বাচনি জনসভা করেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একের পর এক সভা করেছেন, বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীরা এসে সেসব সভায় বক্তৃতা দিয়েছেন, ভোটারদের উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। এ কাজে জোর বাড়াতে রাজধানীতে হাজির করার হয়েছে বিজেপির দুই শতাধিক এমপিকে। এতকিছুর পরও বিজেপি ৭০ এ পেয়েছে মাত্র ৮টি! কিন্তু কেন এমন ফল? যে দলটির দিল্লি ও পাঞ্জাব ছাড়া দেশের আর কোথাও তেমন কোনও অস্তিত্বও নেই, সেই দলটিই পরপর তিনবার রাজধানী দিল্লির ক্ষমতায় কী করে যেতে পারছে? আম আদমি পার্টির অতীতের দিকে তাকালে আসলে কিছুটা বিস্মিতই হতে হয়। দলটির জন্ম ২০১২ সালে। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন করতে করতে এই দলটি গঠিত হয়। জন্মের পরের বছরই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে তারা ২৮টি আসন পেয়ে সবাইকে চমকে দেয়। সেবার কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে তারা সরকারও গঠন করে। কিন্তু লোকপাল বিল বিতর্কে কংগ্রেস তাদের সমর্থন না দিলে মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় তারা সরকার থেকে পদত্যাগ করে। দুবছর পর নতুন করে নির্বাচন হলে ৭০ আসনের মধ্যে ৬৭টি পেলে হতবাক হয়ে যায় পুরো ভারত। এরপর পাঁচ বছর কেন্দ্রের সবধরনের বিরোধিতার মধ্যেও দিল্লিতে নিয়ে আসে তারা এক দৃশ্যমান পরিবর্তন। এমন কিছু মৌলিক কাজ করে, যা দেশের অন্য কোনও রাজ্য সরকার কখনও করতে পারেনি। পাঁচ বছরে কী কী কাজ দিল্লিতে করেছেন কেজরিওয়াল সরকার? তালিকাটা একেবারে ছোট নয়। তারা দিল্লির সকল পরিবারের জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ফ্রি করে দিয়েছে, প্রতিটি পরিবারের জন্য মাসে ২০ হাজার লিটার পর্যন্ত পানি ফ্রি করে দিয়েছে, মেট্রো ও সরকারি বাসে মেয়েদের যাতায়াত ফ্রি, শিক্ষার্থীদের জন্যও গণপরিবহন ফ্রি করে দিয়েছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এগুলো সত্য। এর বাইরে তারা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থায়। মহল্লা ক্লিনিক করেছে নগরীর অলিতে-গলিতে। মহল্লা ক্লিনিক ও সরকারি হাসপাতালে কেউ গেলে তার সব টেস্ট ও চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে বিনাপয়সায়। যে সব চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে হয় না, সেগুলোর জন্য রোগীদের যদি কোনও বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোর দরকার হয়, তাও পাঠানো হচ্ছে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালের সেই বিলও শোধ করে দিচ্ছে সরকার। মাস কয়েক আগে আর এক নিয়ম হয়েছে—দিল্লির মধ্যে যদি কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়, তা যদি সে দিল্লির অধিবাসী না-ও হয়, তবুও তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় সরকার বহন করবে। এতসব পরিবর্তনের পরও সবচেয়ে গুরুত্ব কিন্তু পাচ্ছে দিল্লির শিক্ষা ব্যবস্থা। দিল্লি সরকার তাদের সরকারি স্কুলগুলোকে একেবারে আমূল পাল্টে দিয়েছে। স্কুলগুলোর শিক্ষার মান ও পরিবেশ এতটাই উন্নত হয়েছে যে, অনেক বেসরকারি স্কুলের ছাত্ররা এখন সরকারি স্কুলে এসে ভর্তি হচ্ছে। পরীক্ষার রেজাল্টেও সরকারি স্কুল ভালো করছে। এসবের বাইরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, আনাচে-কানাচে বসানো হয়েছে সিসি টিভি। কিকিছু এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে ফ্রি ওয়াইফাই। আগামী পাঁচ বছরে তারা পুরো দিল্লিকেই সিসি টিভি এবং ফ্রি ওয়াইফাইয়ের আওতায় আনতে পারবে বলে অঙ্গীকারও করেছে। এই যে সুযোগ-সুবিধার কথা বললাম, অনেক সময় এমন সরকার সিনেমায় দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবেও যে সেটা সম্ভব, তা প্রমাণ করেছে দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির পক্ষ থেকে অবশ্য এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে—এত সব ফ্রি দিতে গিয়ে আম আদমি সরকার জনগণের অর্থের অপচয় করেছে। কোষাগার শূন্য করে ফেলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অভিযোগও ধোপে টেকেনি। জবাবে দিল্লি সরকার সিএজি বা কেন্দ্রিয় অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট হাজির করেছে। তাতে দেখা গেছে—ভারতের সব রাজ্য সরকারে মধ্যে কেবল দিল্লি সরকারেরই বাজেটে কোনও ঘাটতি নেই, বরং তারা উদ্বৃত্তে রয়েছে। তাহলে ম্যাজিকটা কোথায়? এর জবাবও দিয়েছেন খোদ অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বলেছেন, তারা দুর্নীতি বন্ধ করতে পেরেছেন। হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না দেখে ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেনি, ফলে রাজস্ব আয় বেড়ে গেছে। আগে যে টাকাটা ঘুষ দিতেন, এখন সেটা ট্যাক্স হিসাবে সরকারের তহবিলে যাচ্ছে। যে কোনও নির্মাণ কাজে অপচয় কম হচ্ছে। সরকারের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মাত্র তার তদন্ত হচ্ছে, প্রমাণ হলে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে পুরো সরকার ও বিধায়কদের মধ্যে একটা দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এই জায়গাটিতে এসে বেকায়দায় পড়ে গেছে বিজেপি। আম আদমি পার্টি যখন তাদের এই কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছে, এর মোকাবিলায় বিজেপি তেমন কিছুই বলতে পারছে না। তারা হেঁটেছে গতানুগতিক ধারায়। বলেছে এনআরসি, সিএএ আর হিন্দু-মুসলমানের কথা। দিল্লির শাহিনবাগ এলাকায় এনআরসি ও সিএএ’র বিরোধিতা করে নারীরা যে অবস্থান ধর্মঘট করছে–সেটা নিয়ে হিন্দুদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছে। বলেছে–শাহীনবাগ মিনি পাকিস্তান হয়ে গেছে, বিজেপিকে ভোট না দিলে দেশ পাকিস্তান হয়ে যাবে, দেশে আবার মোঘল শাসন কায়েম হবে, দিল্লি সন্ত্রাসবাদীদের আস্তানায় পরিণত হবে, দেশে রামরাজত্ব কায়েম করা যাবে না, ইত্যাদি। কিন্তু দিল্লির জনগণ বিজেপির এইসব কথায় আতঙ্কিত হয়নি, বরং তারা যেসব অভাবিত সুযোগ সুবিধা পেয়েছে তা অব্যাহত রাখার পক্ষে রায় দিয়েছে। নির্বাচনের পর গত কয়েকদিন ধরেই ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যে প্রশ্নটির জবাব খোঁজার চেষ্টা করছেন সেটি হলো—বিজেপির এমন সর্বগ্রাসী প্রচারণার পরও আম আদমি পার্টি জিতলো কী করে? অধিকাংশ বিশ্লেষকরাই একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন। তারা বলছেন, শত প্ররোচনা সত্ত্বেও কেজরিওয়াল ও তার পার্টি বিজেপির ফাঁদে পা দেয়নি। তারা বিজেপির কোনও অভিযোগেরই কোনও জবাব দেয়নি। এনআরসি, সিএএ ঠিক কি বেঠিক—এনিয়ে কোনও কথা বলেনি। শাহীনবাগের অবস্থান ধর্মঘট নিয়ে একবারের জন্যও কোনও মন্তব্য করেনি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কেজরিওয়াল একবারের জন্যও সেখানে যাননি। তারা কেবল উন্নয়ন আর গত পাঁচ বছরের কাজের কথা বলেছে। কোনও বিতর্কে জড়িয়ে না পড়া, বিতর্কিত বিষয়ে কোনও একটা পক্ষ না নেওয়া—সন্দেহ নেই নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে এগুলো খুবই নিরাপদ পদ্ধতি। কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ের রাজনীতিটা কি এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না? সিএএ কিংবা এনআরসি এই সময়ে পুরো ভারতজুড়েই একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। যে দল রাজনীতিকে পাল্টে দেওয়ার কথা বলেই রাজনীতির মাঠে নেমেছে, তাদের পক্ষে এমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও চুপ করে থাকাটা নৈতিকভাবে কতটুকু সঠিক—তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাহলে কি আম আদমি পার্টির কাছেও নির্বাচনটাই মুখ্য, রাজনৈতিক সততা নিতান্তই গৌণ? ভারতের বিগত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বারবার নরেন্দ্র মোদিকে সামনে নিয়ে এসেছে। বলেছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদির বিকল্প কে? এ প্রশ্নের জুতসই কোনও জবাব ছিল না সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস কিংবা অন্য কোনও দলের কাছে। বিজেপির আদর্শ নয়, বরং মোদির জোয়ারেই যেন ভেসে গেছে সব। সমালোচকদের অনেকে এটাকে ব্যক্তিপূজার সঙ্গে তুলনা করেছেন। বলেছেন রাজনৈতিক আদর্শকে ছাপিয়ে ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে। সমালোচকরা যা-ই বলুন, উপমহাদেশের প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে ব্যক্তিকে ইমেজকে তুলে ধরার এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, দিল্লির নির্বাচনেও কিন্তু একই ব্যাপার দেখা গেছে। ব্যক্তি কেজরিওয়াল যেন ছাড়িয়ে গেছেন তার পার্টিকে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়াল নয়, তাহলে বিকল্প কে? এই প্রশ্নে জবাব ছিল না বিজেপির কাছে। এই জায়গাটিতেই প্রশ্ন ওঠেছে, তাহলে কেজরিওয়ালও কি ব্যক্তি ইমেজের রাজনীতি করছেন? আম আদমির রাজনীতিকে তিনি বা তার দল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছেন না কেন? তাহলে এখানে রাজনীতিকে পাল্টে দেওয়ার সেই অঙ্গীকারই বা থাকলো কোথায়? এতসব প্রশ্নের মধ্যেও নেট প্রাপ্তি হিসাবে যা ওঠে আসছে, সেটা হলো, রাজনীতি—তা গতানুগতিক হোক বা নতুন ধারারই হোক, সেখানে যদি সততা থাকে, তাহলে ভালো কিছু ফল পাওয়া যসুশাসন যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে জনগণের সমর্থন মেলে সহজেই।