একজন প্রতীতি দেবীর প্রস্থান এবং আমাদের নিস্পৃহতা

প্রকাশিত: ৫:০৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২০

চলে গেলেন কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তিত্ব প্রতীতি দেবী। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন এবং ভাষাসৈনিক ও একাত্তরে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্রবধু তিনি। আরও অনেক অনেক পরিচয়ের মধ্যে মানবাধিকার কর্মী অ্যারোমা দত্ত তাঁর মেয়ে। এই সময়ে এসে এমন একটি গুণী পরিবার হাজারে একটিও মেলে কীনা সন্দেহ! কিন্তু তাঁর এই মৃত্যুতে একান্ত কাছের মানুষ ছাড়া কারো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, গণমাধ্যমগুলোও ব্যস্ত ছিল নির্বাচন নিয়ে, অনেকেই দায়সারা গোছের খবর প্রকাশ করেই তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে। অথচ যে মানুষটির সাথে পুরো বাংলাদেশের জন্ম এবং জন্মপূর্ব সম্পর্ক, যে পরিবারের এতো এতো অবদান এই বাংলা ও বাঙালীর জন্য, সেই পরিবারের শেষ সদস্যটির প্রয়াণে একধরনের নিস্পৃহতা বেশ চোখে লেগেছে। হয়তো কেউ জানেই না এই মানুষটির কথা, জানতে চায়ওনি কোনদিন। সাতচল্লিশে দেশভাগ, একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এবং তার পরের সবটুকু সময় এপার-ওপার বাংলায় বিচ্ছেদে বিভক্ত হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর কয়জনার খবরই বা রাখে আজকাল!

রেজা ঘটক লিখেছেন,

গতকাল (১২ জানুয়ারি ২০২০) রাত ৮টা ৪০ মিনিটে প্রতীতি দেবী চলে গেলেন অনন্তলোকে। আজ শেষবারের মতো তাঁর দেহ নেওয়া হয়েছিল বড় মগবাজারের বাসস্থান সেঞ্চুরি টাওয়ারে। সেখানে তাঁকে সবাই শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য মৃত্যুর আগেই লিখিতভাবে দেহদান করে গিয়েছিলেন প্রতীতি দেবী। দুপুর ১টায় আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে অ্যারোমা দত্তসহ কয়েকজন আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতীতি দেবীর দেহ হস্তান্তর করেন। দিদিকে নিয়ে যাওয়ার পরেও আমরা সেঞ্চুরি টাওয়ারে কিছুক্ষণ রাহুলদার সাথে ছিলাম।

দেশভাগের পর দুই যমজ ভাইবোন ঋত্বিক ঘটক আর প্রতীতি দেবী দু’জন দুই দেশের হয়ে গেলেন। ঋত্বিক সারাজীবন দেশভাগের এই কষ্ট মন থেকে মানতে পারেননি। আজ ঋত্বিক ঘটকের পরিবারের সর্বশেষ চিহ্নটুকু আমরা হারালাম। দু’জনই এখন ইতিহাস।

তৎকালীন ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশ ঘটক ও ইন্দুবালা দেবী’র নয় সন্তান ছিলেন। পাঁচ ছেলে মনীশ ঘটক, সুদীশ ঘটক, আশিষ ঘটক, লোকেশ ঘটক ও ঋত্বিক ঘটক এবং চার মেয়ে সম্প্রীতি ঘটক, তপতী ঘটক, ব্রততী ঘটক ও প্রতীতি ঘটক। এর মধ্যে অষ্টম সন্তান ঋত্বিক ও নবম সন্তান প্রতীতি দেবী ছিলেন যমজ ভাইবোন। প্রতীতি দেবী ছিলেন ঋত্বিকের চেয়ে ৫ মিনিটের ছোট।

প্রতীতি দেবী ও ঋত্বিক ঘটকের বড় ভাই মনীশ ঘটক ছিলেন কবি ও ঔপন্যাসিক। তাঁর মেয়ে মহাশ্বেতা দেবীও ছিলেন লেখক। যার ডাকনাম ছিল খুকু। খুকু, ভবা আর ভবি খুব কাছাকাছি বয়সের ছিলেন। খুকু’র স্বামী ছিলেন নাট্যকার ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য। মহাশ্বেতা দেবী ও বিজন ভট্টাচার্যের পুত্র ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। যিনি ফ্যাতাড়ু নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

সুরেশ ঘটকের দ্বিতীয় ছেলের নাম সুদীশ ঘটক। তিনি ছিলেন একজন সিনেমাটোগ্রাফার। তৃতীয় ছেলে আশিষ ঘটক যার মেয়ের ঘরের নাতী হলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় (বাবা সতীনাথ চ্যাটার্জি ও মা সুনেত্রা ঘটক) একজন অভিনেতা, নির্মাতা ও প্রডিউসার। সুরেশ ঘটকের চতুর্থ ছেলের নাম লোকেশ ঘটক। যিনি ছিলেন একজন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট।

আর পঞ্চম ছেলে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম মাস্টার নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার। ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রীর নাম সুরমা ঘটক। একছেলে ঋতবান ঘটক, যিনি একজন নির্মাতা ও দুই মেয়ে সংহিতা ঘটক ও সুচিস্মিতা ঘটক।

প্রতীতি দেবী’র বিয়ে হয়েছিল কুমিল্লার আরেক বিখ্যাত পরিবারে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ও ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলেন, যিনি ও তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ কুমার দত্ত একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্র সঞ্জীব দত্তের সাথে বিয়ে হয় প্রতীতি দেবী’র। প্রতীতি দেবী ঘটক ও সঞ্জীব দত্তের দুই ছেলে মেয়ে। মেয়ে অ্যারোমা দত্ত, যিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাগুলোতে কর্মরত আছেন এবং বর্তমান সংসদের একজন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য এবং ছেলে রাহুল দত্ত।

কুমিল্লা সার্কিট হাউসে বসে বোনের শাড়িতে ঋত্বিক লিখেছিলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের প্রাথমিক চিত্রনাট্য। আর বোন লিখেছেন ঋত্বিককে নিয়ে অসামান্য একটি বই ‘ঋত্বিককে শেষ ভালোবাসা’ স্মৃতিগ্রন্থটি। তাদের দুই ভাইবোনকে ভবা এবং ভবি বলে সম্বোধন করা হতো। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর পুরান ঢাকার হৃষিকেশ দাশ লেনের ১ নম্বর বাড়িতে ভবা আর ভবি’র জন্ম। ভবা আগেই বিদায় নিয়েছেন। গতকাল ৯৫ বছর বয়সে ভবিও আমাদের ছেড়ে ইতিহাস হয়ে গেলেন। প্রতীতি দেবী’র আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

আজ সেঞ্চুরি টাওয়ারে বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন চ্যানেল যায়নি। যায়নি বাংলাদেশের কোনো দৈনিক পত্রিকার কোনো সাংবাদিক। অথচ আমাদের পঞ্চাশের উপরে টেলিভিশন চ্যানেল আছে। আমাদের একশো’র উপরে দৈনিক সংবাদপত্র আছে। এরা সবাই রাজনৈতিক দলের লোকজনদের টাউট-বাটপারদের পেছনে সারাক্ষণ আঠার মত লেগে থাকে।

দেশের ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের যেখানে আজ পরিসমাপ্তি হলো, সেখানে আমাদের মিডিয়ার অনুপস্থিতিই বলে দেয় আমরা জাতি হিসেবে কতোটা অধঃপতনে গেছি। আমি মিডিয়ার এই উপস্থিত না থাকাকে চরমভাবে ধিক্কার জানাই। প্রতিবাদ জানাই। ক্ষোভ জানাই।

আমাদের নষ্ট রাজনীতির মত আমাদের মিডিয়াও এখন যেখানে খাবারের উচ্ছিষ্ট আছে, সেখানে দৌঁড়ঝাপ করে। মিডিয়ার এই চরম অবনতি একটি রাষ্ট্রের জন্যও চরম অবমাননাকর বলেই আমি মনে করি। সুএ উইমেন চ্যাপ্টারে