বীরাঙ্গনা নয়, মুক্তিযোদ্ধা > দু’একটা রাজাকারগো ফাঁসি দিলেই হইব না : সখিনা বেগম

প্রকাশিত: ৮:৩১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯

বিজয়নগর নিউজ। দু’একটা রাজাকারগো ফাঁসি দিলেই হইব না, সব রাজাকারের ফাঁসি হইব কি না, জানতে ইচ্ছা করতাছে। রাজাকারদের এত দিন বাঁচায়ে রাখছেন ক্যান? ওদের এত দিন বেঁচে থাকার তো কথা না! দেশের মইধ্যে ওদের চেয়ে বড় দুশমন আর কেডা আছে আমি তো জানি না। এই দেশে আমরা থাকব, রাজাকাররা নয়। এখানে ওরা এখনো বুক ফুলিয়ে হাঁটে, এইটা সহ্য হয় না। ৪৪ বছর সহ্য করছি। আর পারমু না। এই সরকারের কাছে দাবি জানাই- সব রাজাকারকে ফাঁসি দিন। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার সখিনা বেগম এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া জানান। একাত্তরের স্মৃতিচারণ করে সখিনা বেগম বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধে গেছিলাম মতির জন্য। মতি আমার বুকের ধন। আমার বইনের ছেলে। মতি, মানে মতিউর তখন ২৫ বছরের যুবক। আমাদের এলাকার কমান্ডার রসু এসে মতিউরকে বলল, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আইসে পড়ছে। যুদ্ধে যাইতে হইব।’ এই কথা শুইনা আমার বুকের ভেতরডায় মোচড় দিয়া উঠল। কন কী! বইনের একমাত্র ছেলে। যুদ্ধ করতে গিয়া যদি মইরা যায়! তখন কী হইব! আমরা বাঁচমু কেমনে! এইডা ভাবতে ভাবতে আমার মনের মইধ্যে কেমন য্যান দিশাহারা দিশাহারা লাগতাছিল। কী করমু ভাইবা পাইতাছি না। কিছু না ভাইবাই আমি কমান্ডাররে গিয়া কইলাম, মতি না, আমি যুদ্ধে যামু। তিনি বললেন, ‘তুমি মাইয়া মানুষ, যুদ্ধে গিয়া কী করবা!’ আমি কইলাম, আপনারা যা কন তা-ই করমু। নইলে গোয়েন্দাগিরি করমু। কমান্ডার বললেন, ‘তুমি পারবা?’ আমার চোখের মইধ্যে মতির মুকডা ভাইসা উঠল। মতিরে বাঁচাইতে হইব। আমি কইলাম, পারমু না ক্যান! না পারার তো কিছু নাই। এইভাবে জড়াইলাম মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর আদান-প্রদান করতাম। কখনো পাট ক্ষেতের ভেতর দিয়ে নিকলীর বিলোবিয়া বাজার হয়ে যাইতাম পুবদা। কখনো করগাঁও, গাগলাই, কিশোরগঞ্জের দানা পাটনি, কইরাইল; কখনো সুগার মিল, ছড়ারচর হাইস্কুল। এভাবেই একাত্তরে গোয়েন্দাগিরির কাজ করতাম। একদিন ছড়ারচর হাইস্কুলের কাছে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়লাম। জানটা তখন হাতের মধ্যে চইলে আইল! মনে তবু সাহস হারাইনি। ওরা আমাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল আর বলল, ‘তুম ঠেরউ।’ তখন আমি দাঁড়াইলাম। ওরা বলল, ‘তুম কিদার যাইগা খাটো খাটো বাঙালি?’ তখন আমি বললাম, আমি মুকাম যাই। ওরা বলল, ‘তুম উর্দু জানো?’ আমি বললাম, কুচ কুচ জানি। ওরা বলল, ‘আপ তোমারা বন্ধু হ্যায়’ এসব বলতে বলতে ওরা আমাকে স্কুলের কাছে নিয়ে গেল এবং বলল, ‘কী খাবে?’ আমি বললাম, গেলাসি খাব। ওরা বলল, ‘গেলাসি কাহা মিলেগা?’ আমি চুপ করে রইলাম। মাথাডা আউলা হইয়া গেছিলগা। তারপর… আমাকে ওরা মাংস আর রুটি খেতে দিল। তখন ওরা ওদের ভাষায় কী কী বলছিল, সব বুঝতে পারিনি। খাওয়ার পর কী করে পালাব, চিন্তা করতে লাগলাম। মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বললাম, পেট ব্যথা করছে। ওরা বলল, যাও। বাথরুম ছিল দূরে। আমি সুযোগ বুঝে জান নিয়ে পালিয়ে এলাম। ওই সময় আমার বয়স ছিল ৪৫ বছর। আমার স্বামী-সংসার নাই। আমার স্বামীর ‘অভ্যাস’ ভালো ছিল না। তাই আমি তাকে নিজ থেকে তালাক দিছি। পরে আমি আর বিয়েথা করিনি। ঘৃণা ধরে গেছে পুরুষ মানুষের ওপর। তার কথা বলতে মন চাইছে না। আমার জীবনের কথা বলি। আমি বেঁচে আছি কোনোমতে। এইটা জীবন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টার্মে ক্ষমতায় আসার পর মাসে এক হাজার ৫০০ টাকা করে পেইছি। বিএনপি আইসা ৩০০ টাকা করে দিছে। প্রশিকা থাইক্কা এক হাজার টাকা করে পাইছি কিছুদিন। এসব দিয়ে কী আর জীবন চলে! কোনো রকমে চলছে। না চললে কী করমু? আমার বয়স হইয়া গেছে। মাঝে মাঝে অসুস্থ হইয়া পড়ি। আমার দেখাশোনার জন্য একটা বুয়া রাখছি। তাকে টাকা দিতে হয়। ১৫ দিনে সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এ জন্য সরকারের কাছে সম্মানীর টাকা আরেকটু বেশি করে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটা খড়ের ঘর তুলে দিছে। এর আগে হাসিনা সরকার জমির জন্য অর্ডার দিছিল। এরপর খালেদা সরকার এসে নিকলীতে একখণ্ড জমি দিছিল। কিন্তু সেটা অন্য লোকে গণ্ডগোল করে কেড়ে নিছে। আমি গরিব মানুষ। বয়সও হইছে। এই বয়সে আমি কী আর করতে পারি! তাই সরকারের কাছে আমার একটা জিনিস চাওয়ার আছে। আমি পানির বড় কষ্টে আছি। আমার একটা টিউবয়েল দরকার। আর বাড়ির চারপাশে একটা বাউন্ডারি ওয়াল করে দিলে ভালো হয়। আমার আর কিছুই লাগবো না। তবে আরেকটা বড় দাবি আছে। আমি শেখের বেটি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধে বোনের একমাত্র ছেলে মতিউর রহমানকে হারানোর দুঃখের কথা তার কাছে একটু খুলে বলতে চাই। তার কাছে গিয়ে মন খুলে একটু কাঁদতে চাই। যাকে হারানোর ভয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছিলাম, সম্মান হারিয়েছি। আমার সেই বুকের ধন মতিউর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। ছেলেটার কোনো স্মৃতিফলক হইলো না! এইটা আমার বুকের মধ্যে একটা ভারী বোঝা