ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস : এইদিনে শহর হানাদার মুক্ত হয়। শহরটি পরিণত হয়েছিল ধ্বংস্তুপে

প্রকাশিত: ১২:২৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৮, ২০১৯

একাত্তরের এইদিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হানাদার মুক্ত হয়। শহরটি পরিণত হয়েছিল ধ্বংস্তুপে। বিভিন্নস্থানে পড়েছিল লাশ আর লাশ। ৬ ডিসেম্বর আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিন দিক থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ৭ ডিসেম্বর মধ্যে পাক বাহিনী বিনা যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ত্যাগ করে। একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে। সকালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরাতন কাচারী ভবন সংলগ্ন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার প্রায় ১০ লাখ মানুষই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধ এখানে মূলত জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বে কসবা, গঙ্গাসাগর ও আখাউড়া থেকে পশ্চিমে ভৈরব বাজার রেললাইন পর্যন্ত ছিল ২নং সেক্টরে এবং পূর্বে সিঙ্গারবিল থেকে উত্তরে হবিগঞ্জ পর্যন্ত ছিল ৩নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। এই সেক্টরের গেরিলা উপদেষ্টা ছিলেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মরহুম লৎফুল হাই সাচ্চু। ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশারফ। তিনি তার সেক্টরকে ৬টি সাব সেক্টরে বিভক্ত করেন। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ কসবা-আখউড়া গঙ্গাসাগর সাব সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইন উদ্দিন। এই এলাকায় চতুর্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানী এবং ইপিআরের দুটি কোম্পানী ছিল। এই সাব সেক্টর কসবা, আখাউড়া, সৈয়দাবাদ, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লার মুরাদনগর পর্যন্ত অপারেশন চালাতো। ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত করতে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে জেলার আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় মিত্র বাহিনী পাক বাহিনীর উপর বেপরোয়া আক্রমণ চালাতে থাকে। ১ ডিসেম্বর আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধে ২০ হানাদার নিহত হয়। ৩ ডিসেম্বর আখাউড়ার আজমপুরে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এখানে ১১ হানাদার নিহত হয়। শহীদ হন তিন মুক্তিযোদ্ধা। এরই মাঝে বর্তমান বিজয়নগর উপজেলার মেরাশানী, সিঙ্গারবিল, মুকুন্দপুর, হরষপুর, আখাউড়া উপজেলার আজমপুর, রাজাপুর এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর পাক হানাদাররা পিছু হটতে থাকলে আখাউড়া অনেকটাই শত্রুমুক্ত হয়ে পড়ে। এখানে রেলওয়ে স্টেশনের যুদ্ধে পাক বাহিনীর দুই শতাধিক সেনা হতাহত হয়। ৬ ডিসেম্বর আখাউড়া সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়। এরপর থেকে চলতে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করার প্রস্তুতি। মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণ দিক থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে এবং মিত্র বাহিনীর ৫৭তম মাউন্টের ডিভিশন আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেললাইন ও উজানীসার সড়ক দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। শহরের চতুর্দিকে মুক্তিবাহিনী অবস্থান নিতে থাকায় পাক সেনারা পালিয়ে যাবার সময় ৬ ডিসেম্বর রাজাকারদের সহায়তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক কেএম লুৎফুর রহমানসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে আটক থাকা অর্ধশত বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে চোখ বেঁধে শহরের দক্ষিণাংশের কুরুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ৭ ডিসেম্বর রাতের আধারে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে আশুগঞ্জের দিকে পালাতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর বিনা বাঁধায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উত্তোলন করে। মুক্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।ঐদিন ৯ মাসের যুদ্ধশেষে তদানীন্তন মহকুমা প্রশাসক অফিস সংলগ্ন চত্বরে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার এক সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আজ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করছে