সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন এদেশের সংবিধান প্রনেতাদের অন্যতম

প্রকাশিত: ৫:৫২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯

সাবেক সরাইল পরগনা বর্তমানে-সরাইল উপজেলার প্রসিদ্ধ গ্রাম কুট্টাপাড়ায় সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম ৯ জুন ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ জম্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম সৈয়দ বদিউর রহমান, মাতার নাম মরহুমা মোছাম্মত মুর্শেদা খাতুন এবং স্ত্রীর নাম মরহুমা মেহের আফজান চৌধুরী। তিনি সরাইল অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৫৪ সনে এসএসসি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ হতে ১৯৫৪ সনে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এল.এল.বি ডিগ্রী লাভ করে ১৯৬৪ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারে আইন পেশায় যোগদান করেন। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের সনদ প্রাপ্ত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থেকে সেই সময়ের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন। পেশাগত জীবনের শুরুতেই আওয়ামীলীগে যোগদান করে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন কুমিল্লা-২ (বর্তমানে ব্রাহ্মনবাড়িয়া-২) অঞ্চলের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এম-পিএ) নির্বাচন হন।
প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসাবে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে গণপরিষদ সদস্য হিসাবে পূর্বাঞ্চলীয় “লিবারেশন কাউন্সিলের” অন্যতম সদস্য নিযুক্ত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন বলিষ্ঠ সংগঠক হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে আত্মনিয়োগ করেন। তাছাড়া তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি সরাইল থানা প্রশাসক হিসাবে বাংলাদেশ সরকারের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭২-এ গণপরিষদের সদস্য হিসাবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ (ব্রাহ্মনবাড়িয়া মহকুমা হতে জেলা আওয়ামীলীগ) এর সাংগঠনিক একাদিক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ ১৯৯৬ খ্রিঃ হতে ২০০৪খ্রিঃ পর্যন্ত অত্যন্ত যোগ্যতা এবং সফলতার সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সকল প্রকার কলাকানুন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে হুলিয়ার সম্মুখীন হন।
উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন সরাইল উপজেলা ভারত উপমহাদেশে সরাইল পরগণা হিসাবে বিখ্যাত ছিল। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে অব্যহতি পূর্বে সরাইল অঞ্চলটি পরগণা হিসাবে অবহিত হয়। তখন সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, বিজয়নগর, আশুগঞ্জ এবং নবীনগর উপজেলার অনেক এলাকা সরাইল পরগণার অন্তর্ভূক্ত ছিল। মেঘনা-তিতাস পরিবেষ্টিত সরাইল পরগণা তদানিন্তন ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ পরগণা ছিল। ব্রিটিশ অধিকারের আরম্ভে সরাইল পরগণা ময়মনসিংহ জেলাভুক্ত হয়েছিল। ১৮৩১ খ্রিস্ট্রাব্দে সরাইল পরগণা ত্রিপুরা জেলাভুক্ত হয়। ১৮৩৪ খ্রিস্ট্রাব্দে সরাইল সদর থেকে বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে সরাইল পরগণার কাচারি স্থানান্তর কারা হয় এবং সেখানে পৌরসভা ও মহকুমা সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অগ্রগামিতা বেড়ে যায় এবং প্রায় পাঁচশত বছর ধরে এগিয়ে থাকা বিশাল ঐতিহ্যের অধিকারী সরাইলের গুরুত্ব এবং মর্যাদা কমে যায়। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীদের হাতে ১৭৫৭ খ্রিস্ট্রাব্দে বাঙলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতন ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীরা ১৮৫৮ খ্রিস্ট্রাব্দে সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীরা তখন থেকে ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং সরাইল অঞ্চলে কালীকচ্ছ, চুল্টা, শাহবাজপুর, সরাইল সদর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার ধনী ও অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইউরোপীয় বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, সাহিত্যসহ অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে থাকে। তারা পরবর্তীকালে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক, লেখক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, আধ্যাত্মিক পুরুষ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ব্রিটিশ শাসন আমলে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন, কৈলাশ সিংহ (ঐতিহাসিক), আনন্দ চন্দ্রস্বামী (আধ্যাত্মিক পুরুষ ও সর্বধর্ম সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠাতা), ড. দ্বিজ দাস দত্ত (ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের লেখক), মোহিনী মোহন বর্ধন (আজ থেকে ১৫০ বছর পূর্বে কুমিল্লা জজ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে পথিকৃত), দ্বারিক দাসগুপ্ত (কালীকচ্ছের এই কৃতি আইনবিদ বাংলায় প্রথম আইন বই লিখে প্রসিদ্ধ লাভ করেছেন), উল্লাসকর দত্ত (বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা), আবদুর নূর লস্কর (শিক্ষক ও স্বদেশী আন্দোলন কর্মী), কৈলাশ চন্দ্র নন্দী (পত্রিকা সম্পাদক), ড. অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (পত্রিকা সম্পাদক ও শিক্ষাবিদ), গুরু দয়াল সিংহ (পত্রিকা সম্পাদক), প্রবোধ চন্দ্র সেন (অধ্যাপাক ও ছন্দ বিজ্ঞানী), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নন্দী (সাহিত্যিক) এবং দেওয়ান মুস্তফা আলী (রাজনৈতিক নেতা)। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীদের শাসন শেষে ভারতবর্ষে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়ল
পাকিস্তান ছিল একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানের লোকসংখ্যা শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি জাতিকে পুঙ্গু করার উদ্দেশ্যে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র উর্দু ভাষাকে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। প্রতিক্রীয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে ঐ সময় সরাইল থানার প্রাথমিক শিক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের একুশে ডিসেম্বর তারিখে সভা করে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবী উপস্থাপন করা হয়। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ব্যাপারে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। সরাইল এলাকার দেওয়ান মাহবুব আলী কুতুব মিয়া (বামবপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক), শেখ আবু হামেদ (সরাইল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ), এড. আবদুস সামাদ (প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা), আহমেদুর রহমান মজনু (দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক)সহ অসংখ্য রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক জনতা বাংলা ভাষা দাবী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ পাকিস্তান জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করার পরেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা পাকিস্তানের সংখ্যালগিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের কুচক্রী নেতা ভুট্টোর সহযোগিতায় আওয়ামীলীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখ দিবাগত রাত্রে বাঙালি জাতির উপর জঘন্যতম গণহত্যাসহ সকল ধরনের অত্যাচার আরম্ভ করে। শুরু হয় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা বাঙালি জাতির সার্বিক জনযুদ্ধ। সরাইল এলাকার অসংখ্য কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র/জনতা, আওয়ামীলীগসহ সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ইই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ৮ই ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী হতে সরাইল অঞ্চল মুক্তিবাহিনী কর্তৃক মুক্ত হয়।
এককালে সরাইল এলকার সুনাম সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী বিস্তৃত ছিল। বর্তমানেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পপতি, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন।
এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলামের মানস গঠনে সরাইলের আলোকিত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালে ২৭ জুলাই সিলেট যাওয়ার পথে ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও সরাইল এলাকায় তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ঐ সময় বঙ্গবন্ধু স্বয়ং সরাইল প্রাতঃ বাজারে আওয়ামীলীগের অফিস উদ্বোধন করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালের ৫ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রাহ্মনবাড়িয়া শহরে আগমন করেন এবং বিশাল জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। উক্ত সভায় এ্যাডভোকেট জনাব সিরাজুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের দালাল বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোস্তাক আহমদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা-বিরোধী চক্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। মোস্তাক চক্রের নির্দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের লোকদের গ্রেফতার ও নির্যাতন। ঐ সময় এ্যাডভোকেট সৈয়দ সিরাজুল ইসলামকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া গ্রেফতার করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। তখন কুমিল্লা কারাগারে আটক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জিল্লুর রহমান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি) এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক আব্দুর রাজ্জাকসহ অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী।
আজীবন আওয়ামীলীগের সংগ্রামী কর্মী এবং বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারি এ্যাডভোকেট সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম ২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর প্রতি ব্রাহ্মনবাড়িয়া তথা বৃহত্তর কুমিল্লাবাসীর বিন¤্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র ঃ রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস-কৈলাশ চন্দ্র সিংহ। সরাইল পরগণার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের কথা-ড. শাহজাহান ঠাকুর। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন-কলকাতার সংবাদপত্র, সংগ্রহ সম্পাদনা-ড. সুকুমার বিশ্বাস, বাংলা একাডেমী, ঢাকা। কলিকাতায় অনুষ্ঠিত কালীকচ্ছ সম্মিলনী’র সিডি। মুক্তিযুদ্ধে সরাইল থানা-শাহ মুহাম্মদ মুতাসিম বিল্লাহ, কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু-আবুল কাশেম হৃদয়, “স্মারণে তুমি রবে অমলিন”-প্রকাশনায়: সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
লেখক: সাংস্কৃতিক কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত রিডার, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, কুমিল্লা-চাঁদপুর-লক্ষীপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া।