শেখ কামাল আমার বন্ধু——— র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

প্রকাশিত: ৪:৪৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৪, ২০২২

জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যৈষ্ঠপুত্র শহীদ শেখ কামালউদ্দিন ( শেখ কামাল হিসাবেই যার পরিচিতি সমধিক ) ১৯৪৯ সনের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের কালোরাত্রিতে জাতির জনক তাঁর পরিবারের অন্যান্যের সাথে বিশ্বাসঘাতক কুচক্রীদের হাতে শাহাদৎবরণ করেন । ১৯৭৫- এর নির্মম হত্যাকাণ্ড মাত্র ২৬ বছর বয়সে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক সম্ভাবনাময় তরুণের জীবন হরণ করে নিয়েছে ।

ষাট ও সত্তর দশকের শেষার্ধ ও প্রথমার্ধের ছাত্র-আন্দোলনের একজন সফল কর্মী ,সংগঠক ও নেতা শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের অন্যতম দিশারী , একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার , ক্রীড়া সংগঠক , নাট্যকর্মী , অভিনেতা ও প্রতিভাবান সেতারাবাদক । আবাহনী ক্রীড়াচক্র, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র প্রভৃতি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শেখ কামাল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা ও সংস্কৃতি সপ্তাহের প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় সেতারবাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে একজন উদীয়মান তরুণ সেতারাবাদক হিসাবে আপন প্রতিভার উপযুক্ত স্বাক্ষর রেখেছিলেন । আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলেছেন এবং নাট্যচক্রের অনেকগুলো নাটকে করেছেন অভিনয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসাবে তিনি ছিলেন শিক্ষক-ছাত্রমহলের মধ্যে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।

বন্ধু হিসাবে , কর্মী হিসাবে , সহপাঠি হিসাবে , সহকর্মী হিসাবে এবং কনিষ্ঠদের বড় ভাই হিসাবে শেখ কামাল ছিলেন এক অতুলনীয় ব্যত্তিত্বের অধিকারী মানস । নিরহঙ্কার , অমায়িক, সদাপ্রফুল্ল এবং পাঠক্রম ও পাঠবহির্ভূত বিভিন্ন ক্রীড়া , সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সংগঠনের সদা কর্মতৎপর শেখ কামাল পরিচিত সকলের কাছে এক প্রিয় মানুষ । প্রখ্যাত সাহিত্যিক , লেখক , বুদ্ধিজীবী ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের এক লেখায় তিনি শেখ কামালের নিরহঙ্কারী চরিত্র ও অমায়িক ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং এ প্রশংসা যথার্থই তাঁর প্রাপ্য । শেখ কামাল তাঁর জীবদ্দশায় যেমনি তাঁর শিক্ষকবৃন্দ,সহপাঠি ও সহকর্মীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন , আজও তাঁর তিরোধানের প্রায় চার যুগ পরেও তাঁর পরিচিতজনদের কাছে উজ্জ্বল । তাঁর কথা যতই মনে পড়ে , স্মৃতি ততই পীড়া দেয় । তাঁর শাহাদৎবরণ বাংলাদেশের ক্রীড়া , সংস্কৃতি তথা সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে ।

১৯৬৯ সনে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া , ঢাকা থেকে ফাজিল পরিক্ষা পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে এসেছিলাম। আর যেদিন ঢাকা কলেজে প্রথম প্রবেশ করি সেদিনই তাঁর সাথে হয়েছিল পরিচয় ও আলাপ । ইতিপূর্বে সভা আর মিছিলে সক্রিয় শেখ কামালকে দূর থেকে দেখেছি কিন্তু পরিচয় ও আলাপ হয়নি । দিন তারিখ মনে নেই , তবে স্মরণে আছে আমরা কয় বন্ধু মিলে মাদ্রাসা থেকে ভর্তি হতে কলেজে এসেছি । কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকে প্রথমই গেলাম ছাত্রলীগের কর্মীদের টেবিলে যেখানে তাঁরা সাহায্য করছিলেন নতুন ছাত্রদেরকে ভর্তির ব্যাপারে । তখন ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রদেরকে সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক ছাত্রসংগঠন থেকে ছাত্রকর্মীগণ টেবিল পেতে বসে ফরম পূরণ , অফিসের দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদি কাজে নবাগতদের সহায়তা করতেন ।
ঢাকা কলেজে তখন ছাত্রলীগ , ছাত্র ইউনিয়ন ( মতিয়া ও মেনন গ্রুপ ) ও ইসলামী ছাত্রসংগঠন খুবই তৎপর ছিল । সেখানে ছিলেন কলেজ থেকে সদ্য পাস করে বেরিয়ে যাওয়া শেখ কামাল , কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ জাহিদ হোসেন , সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহেদ রেজা প্রমূখ । আমার বন্ধুদের মধ্যে অন্তত দুইজনের সাথে শেখ কামালের পরিচয় ছিল । তাঁরাসহ আমরা গেলাম কামাল ভাইয়ের কাছে । তিনি আমাদেরকে সদরে গ্রহণ করলেন এবং ( আমাকে দেখিয়ে ) বললেন যে, ওর রেজাল্ট খুবই ভালো। ওকে আমরা সংসদে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দাঁড় করাব । আমি তো অবাক । তাঁর আন্তরিকতায় , তাঁর কথায় আমরা সবাই অভিভূত হয়ে গেলাম । শহিদ শেখ কামালের সাথে এমনিভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল ।

তারপর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো । যথারীতি আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম ( আমাদের সময়েই সর্বপ্রথম ছাত্রসংসদে সরাসরি নির্বাচন হয়। এর আগে ক্লাস রিপ্রেজেন্টিটিভদের দ্বারা ছাত্রসংসদ নির্বাচন হতো ) । সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা , নির্বাচন পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা প্রত্যক্ষ করলাম । সেসব অনেক কথা , অনেক কাহিনি , যা বলে শেষ করার নয় । ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগের আহবানে কোন এক হরতাল পালন করতে গিয়ে কর্মীদের নিয়ে কাজ করার সময় আমি গ্রেপ্তার হয়ে যাই টহলরত সামরিক বাহিনীর হাতে । পরে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় । সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমার বিচার হবে । অপেক্ষায় আছি । এমনি সময় ঈদ-উল-ফিতরের দিন হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবেই দুপুরের সময় একটি বড় tiffin carrier এ আমার জন্য বাইরে থেকে খাবার গেল । জেল কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে কামাল ভাই গেটে এসে খাবার দিয়ে গেছেন আমার জন্য । আনন্দে , কৃতজ্ঞতায় আমার দু- চোখ ভের পানি নেমে এলো ।

কামাল ভাই তাঁর একজন রাজনৈতিক সহকর্মীর কথা ভোলেননি ( তখনকার সময়ে খুব বেশি রাজনৈতিক কর্মী জেলে ছিল না । গণ-আন্দোলনের পর অধিকাংশ নেতা-কর্মীই জেলের বাইরে )। নেতা হিসাবে , বন্ধু হিসাবে , সহকর্মী হিসাবে এবং সর্বোপরি মানুষ হিসাবে শেখ কামাল কত বড় মাপের ছিলেন এ ঘটনা তাঁর উজ্জ্বলতম উদাহরণ ।

আজও কামাল ভাইয়ের কথা মনে হলে চোখদুটি পানিতে ভরে আসে । সত্তরের নির্বাচন , মুক্তিযুদ্ধ,মুক্তিযুদ্ধের পরে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে ছাড়িয়ে এনে পুনরায় ছাত্ররীজনীতিতে সম্পৃক্তিকরণ ,তেয়াত্তরের ডাকসু নির্বাচন, হঠকারী রাজনীতির অনুসারীদের দ্বারা ছাত্রলীগের বিভক্তির পর মূলধারা ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ( ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অঙ্গন ব্যতিত—কেননা , এ দুটি ক্ষেত্রে আমার উৎসাহ ছিল খুবই কম ) তাঁর সাথে একযোগ হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল । ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্টের কালোরাত্রিতে সর্বশেষ তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছিল টেলিফোনে মধ্যরাত্রিতে —পরদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে —-সে – বিষয়ে ছাত্রদের প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে । তারপরের ইতিহাস , সে অন্য সময় , অন্যদিন, যদি কখনো বলার সুযোগ পাই বলব ।

আজ শুধু ঋজু সুঠাম দেহের অধিকারী সদাপ্রফুল্ল শেখ কামালের স্মিত হাসির চেহারা বারবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাসমাপ্তিতে বেরিয়ে আসার আগপর্যন্ত সক্রিয় ছিলাম ছাত্রলীগের সংগঠনের সাথে ।শহীদ শেখ কামালের কণিষ্ঠ সহকর্মী হিসাবে , ভাই হিসাবে , বন্ধু হিসাবে কখনো একদিনের জন্য তাঁর কথা ভুলতে পারিনি , ভুলিনি এবং ইনশাআল্লাহ ভুলব না ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা এসেছিল ৬-দফার পর বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে । শেখ কামালের হাত ধরে হয়েছিলাম সক্রিয় কর্মী । আজ ও কর্মী হিসাবে কাজ করছি কিন্তু তাঁর ভালোবাসা,আন্তরিকতা,স্নেহ ও সহযোগিতার কথা চিরদিন আমার চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে । শহীদ শেখ কামাল আমার স্মৃতিতে , বন্ধুদের স্মৃতিতে, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে চিরজাগ্রত, চিরঅম্লান, চিরভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন । শহীদ শেখ কামালের স্মৃতি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হোক ।

শেখ কামাল : আমার বন্ধু

———— র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যৈষ্ঠপুত্র শহীদ শেখ কামালউদ্দিন ( শেখ কামাল হিসাবেই যার পরিচিতি সমধিক ) ১৯৪৯ সনের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের কালোরাত্রিতে জাতির জনক তাঁর পরিবারের অন্যান্যের সাথে বিশ্বাসঘাতক কুচক্রীদের হাতে শাহাদৎবরণ করেন । ১৯৭৫- এর নির্মম হত্যাকাণ্ড মাত্র ২৬ বছর বয়সে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক সম্ভাবনাময় তরুণের জীবন হরণ করে নিয়েছে ।

ষাট ও সত্তর দশকের শেষার্ধ ও প্রথমার্ধের ছাত্র-আন্দোলনের একজন সফল কর্মী ,সংগঠক ও নেতা শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের অন্যতম দিশারী , একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার , ক্রীড়া সংগঠক , নাট্যকর্মী , অভিনেতা ও প্রতিভাবান সেতারাবাদক । আবাহনী ক্রীড়াচক্র, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র প্রভৃতি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শেখ কামাল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা ও সংস্কৃতি সপ্তাহের প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় সেতারবাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে একজন উদীয়মান তরুণ সেতারাবাদক হিসাবে আপন প্রতিভার উপযুক্ত স্বাক্ষর রেখেছিলেন । আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলেছেন এবং নাট্যচক্রের অনেকগুলো নাটকে করেছেন অভিনয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসাবে তিনি ছিলেন শিক্ষক-ছাত্রমহলের মধ্যে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।

বন্ধু হিসাবে , কর্মী হিসাবে , সহপাঠি হিসাবে , সহকর্মী হিসাবে এবং কনিষ্ঠদের বড় ভাই হিসাবে শেখ কামাল ছিলেন এক অতুলনীয় ব্যত্তিত্বের অধিকারী মানস । নিরহঙ্কার , অমায়িক, সদাপ্রফুল্ল এবং পাঠক্রম ও পাঠবহির্ভূত বিভিন্ন ক্রীড়া , সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সংগঠনের সদা কর্মতৎপর শেখ কামাল পরিচিত সকলের কাছে এক প্রিয় মানুষ । প্রখ্যাত সাহিত্যিক , লেখক , বুদ্ধিজীবী ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের এক লেখায় তিনি শেখ কামালের নিরহঙ্কারী চরিত্র ও অমায়িক ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং এ প্রশংসা যথার্থই তাঁর প্রাপ্য । শেখ কামাল তাঁর জীবদ্দশায় যেমনি তাঁর শিক্ষকবৃন্দ,সহপাঠি ও সহকর্মীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন , আজও তাঁর তিরোধানের প্রায় চার যুগ পরেও তাঁর পরিচিতজনদের কাছে উজ্জ্বল । তাঁর কথা যতই মনে পড়ে , স্মৃতি ততই পীড়া দেয় । তাঁর শাহাদৎবরণ বাংলাদেশের ক্রীড়া , সংস্কৃতি তথা সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে ।

১৯৬৯ সনে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া , ঢাকা থেকে ফাজিল পরিক্ষা পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে এসেছিলাম। আর যেদিন ঢাকা কলেজে প্রথম প্রবেশ করি সেদিনই তাঁর সাথে হয়েছিল পরিচয় ও আলাপ । ইতিপূর্বে সভা আর মিছিলে সক্রিয় শেখ কামালকে দূর থেকে দেখেছি কিন্তু পরিচয় ও আলাপ হয়নি । দিন তারিখ মনে নেই , তবে স্মরণে আছে আমরা কয় বন্ধু মিলে মাদ্রাসা থেকে ভর্তি হতে কলেজে এসেছি । কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকে প্রথমই গেলাম ছাত্রলীগের কর্মীদের টেবিলে যেখানে তাঁরা সাহায্য করছিলেন নতুন ছাত্রদেরকে ভর্তির ব্যাপারে । তখন ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রদেরকে সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক ছাত্রসংগঠন থেকে ছাত্রকর্মীগণ টেবিল পেতে বসে ফরম পূরণ , অফিসের দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদি কাজে নবাগতদের সহায়তা করতেন ।
ঢাকা কলেজে তখন ছাত্রলীগ , ছাত্র ইউনিয়ন ( মতিয়া ও মেনন গ্রুপ ) ও ইসলামী ছাত্রসংগঠন খুবই তৎপর ছিল । সেখানে ছিলেন কলেজ থেকে সদ্য পাস করে বেরিয়ে যাওয়া শেখ কামাল , কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ জাহিদ হোসেন , সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহেদ রেজা প্রমূখ । আমার বন্ধুদের মধ্যে অন্তত দুইজনের সাথে শেখ কামালের পরিচয় ছিল । তাঁরাসহ আমরা গেলাম কামাল ভাইয়ের কাছে । তিনি আমাদেরকে সদরে গ্রহণ করলেন এবং ( আমাকে দেখিয়ে ) বললেন যে, ওর রেজাল্ট খুবই ভালো। ওকে আমরা সংসদে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দাঁড় করাব । আমি তো অবাক । তাঁর আন্তরিকতায় , তাঁর কথায় আমরা সবাই অভিভূত হয়ে গেলাম । শহিদ শেখ কামালের সাথে এমনিভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল ।

তারপর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো । যথারীতি আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম ( আমাদের সময়েই সর্বপ্রথম ছাত্রসংসদে সরাসরি নির্বাচন হয়। এর আগে ক্লাস রিপ্রেজেন্টিটিভদের দ্বারা ছাত্রসংসদ নির্বাচন হতো ) । সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা , নির্বাচন পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা প্রত্যক্ষ করলাম । সেসব অনেক কথা , অনেক কাহিনি , যা বলে শেষ করার নয় । ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগের আহবানে কোন এক হরতাল পালন করতে গিয়ে কর্মীদের নিয়ে কাজ করার সময় আমি গ্রেপ্তার হয়ে যাই টহলরত সামরিক বাহিনীর হাতে । পরে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় । সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমার বিচার হবে । অপেক্ষায় আছি । এমনি সময় ঈদ-উল-ফিতরের দিন হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবেই দুপুরের সময় একটি বড় tiffin carrier এ আমার জন্য বাইরে থেকে খাবার গেল । জেল কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে কামাল ভাই গেটে এসে খাবার দিয়ে গেছেন আমার জন্য । আনন্দে , কৃতজ্ঞতায় আমার দু- চোখ ভের পানি নেমে এলো ।

কামাল ভাই তাঁর একজন রাজনৈতিক সহকর্মীর কথা ভোলেননি ( তখনকার সময়ে খুব বেশি রাজনৈতিক কর্মী জেলে ছিল না । গণ-আন্দোলনের পর অধিকাংশ নেতা-কর্মীই জেলের বাইরে )। নেতা হিসাবে , বন্ধু হিসাবে , সহকর্মী হিসাবে এবং সর্বোপরি মানুষ হিসাবে শেখ কামাল কত বড় মাপের ছিলেন এ ঘটনা তাঁর উজ্জ্বলতম উদাহরণ ।

আজও কামাল ভাইয়ের কথা মনে হলে চোখদুটি পানিতে ভরে আসে । সত্তরের নির্বাচন , মুক্তিযুদ্ধ,মুক্তিযুদ্ধের পরে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে ছাড়িয়ে এনে পুনরায় ছাত্ররীজনীতিতে সম্পৃক্তিকরণ ,তেয়াত্তরের ডাকসু নির্বাচন, হঠকারী রাজনীতির অনুসারীদের দ্বারা ছাত্রলীগের বিভক্তির পর মূলধারা ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ( ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অঙ্গন ব্যতিত—কেননা , এ দুটি ক্ষেত্রে আমার উৎসাহ ছিল খুবই কম ) তাঁর সাথে একযোগ হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল । ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্টের কালোরাত্রিতে সর্বশেষ তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছিল টেলিফোনে মধ্যরাত্রিতে —পরদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে —-সে – বিষয়ে ছাত্রদের প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে । তারপরের ইতিহাস , সে অন্য সময় , অন্যদিন, যদি কখনো বলার সুযোগ পাই বলব ।

আজ শুধু ঋজু সুঠাম দেহের অধিকারী সদাপ্রফুল্ল শেখ কামালের স্মিত হাসির চেহারা বারবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাসমাপ্তিতে বেরিয়ে আসার আগপর্যন্ত সক্রিয় ছিলাম ছাত্রলীগের সংগঠনের সাথে ।শহীদ শেখ কামালের কণিষ্ঠ সহকর্মী হিসাবে , ভাই হিসাবে , বন্ধু হিসাবে কখনো একদিনের জন্য তাঁর কথা ভুলতে পারিনি , ভুলিনি এবং ইনশাআল্লাহ ভুলব না ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা এসেছিল ৬-দফার পর বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে । শেখ কামালের হাত ধরে হয়েছিলাম সক্রিয় কর্মী । আজ ও কর্মী হিসাবে কাজ করছি কিন্তু তাঁর ভালোবাসা,আন্তরিকতা,স্নেহ ও সহযোগিতার কথা চিরদিন আমার চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে । শহীদ শেখ কামাল আমার স্মৃতিতে , বন্ধুদের স্মৃতিতে, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে চিরজাগ্রত, চিরঅম্লান, চিরভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন । শহীদ শেখ কামালের স্মৃতি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হোক ।