কিংবদন্তি বিপ্লবী, লেখক-সংগঠক উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন প্রয়ান দিবস বিজয়নগর বিজয়নগর নিউজ প্রকাশিত: ৫:১৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৫, ২০২২ ” কিংবদন্তি বিপ্লবী, লেখক-সংগঠকউদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন “ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী, সাহিত্যিক এবং শ্রমিক-সংগঠক সত্যেন সেন। উপমহাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাঙালি চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিলেন যারা; সত্যেন সেন তাদের মধ্যে অন্যতম। শোষণের বেড়াজাল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একটার পর একটা দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে, এক অনন্য ও অসামান্য অবদান রেখে গেছেন; আজকের প্রজন্মের কাছে তা প্রায় অজানা। সত্যেন সেনের গোটা জীবনের কর্মকাণ্ডের প্রায় সবটাই ব্যাপ্ত ছিল বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। বহুধাবিভক্ত তার কর্মকাণ্ড। একদিকে রাজনৈতিক অভিধা, অপরদিকে বাংলা ভাষায় ধ্রুপদী ধারার উপন্যাস এবং চরিত্রের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে যে এক অনবদ্য অবদান সত্যেন সেন রেখে গিয়েছেন, তার প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী পরিবারের সত্যেন সেন জন্মেছিলেন। পদ্মা, ধলেশ্বরীর বিপুল জলধারার এক রসসিক্ত ভূমি ছিল সত্যেন সেনের মানসলোক গঠনের প্রধান বিষয়। সোনারং গ্রামের সেন পরিবার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এক অনন্য উদাহরণ। সত্যেনের কাকা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তার আরেক কাকা মনোমোহন সেন ছিলেন শিশুসাহিত্যিক। সত্যেন সেনের পরিবারেই তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। দীর্ঘ সাত বছর জেলবন্দী অন্তরীণ জীবন তাকে দিয়েছে- জীবন সম্বন্ধে বেদনার বেড়াজালে এক চরম অভিজ্ঞতা। কারাবাস থেকে মুক্তির পর, কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত হন। এসময় কমিউনিস্ট পার্টির একজন তুখোড় সংগঠক হিসেবে কৃষক সমিতির ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গের গ্রাম-গ্রামান্তরে জীবন-জীবিকার লড়াইকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন সত্যেন সেন। সমাজতন্ত্রের শেকড়কে মাটির একদম গভীরে পৌঁছে দেওয়ার যে তাগিদ- এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের খুব কমই আছে। কৃষক- শ্রমিক সমাজের মধ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে, সত্যেন সেনের সহযোগী সোমেন চন্দের অভিজ্ঞতা ছিল একদম প্রত্যক্ষভাবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করার ভেতর দিয়ে, তেমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-গোপাল হালদার, পরে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিছুটা হলেও সমরেশ বসু। জেলজীবন কালেই সত্যেন সেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জীবনকে সম্পৃক্ত করে, মানব মুক্তির লক্ষ্যে নিজের জীবনকে পরিচালিত করার তাগিদে, তিনি পারিবারিক দারিদ্র সত্ত্বেও শিক্ষকতার পেশাকে গ্রহণ করেননি। সে যুগে কৃষক সমিতির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে এভাবে রাজনৈতিক জীবন বেছে নেওয়ার ঘটনা কিন্তু খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে-র মত মানুষজন, এরাও কিন্তু সেই সময় কখনই রাজনীতির সর্বক্ষণের কর্মী হননি। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এই দিক থেকে সত্যেন সেন, গোপাল হালদার, সোমেন চন্দ ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে সত্যেন সেনের একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের জেরেই তিনি নিজেকে গণসংগীত রচনায় সম্পৃক্ত করেন। সেই গণসংগীতকে তিনি কৃষকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করেন। এ সময়ে কলকাতার কৃষক সমিতির বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সত্যেন সেনের লেখা গণসঙ্গীত পরিবেশিত হতো। দেশভাগের পর, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা আন্দোলনের যে ব্যাপ্তি, তাকে সাধারণভাবে আমরা নাচোলের কৃষক আন্দোলন এবং ইলা মিত্রের কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইলা মিত্রের উপর নাচোল থানায় পাকিস্তানি পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণ এবং ইলা মিত্রের আদালতে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক জবানবন্দি- সেগুলি একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেলেও, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের একটা চরম পরিণতি হিসেবে তেভাগা কর্মকাণ্ডকে ব্যক্ত করা হয়। বস্তুত:পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা আন্দোলনের যে কর্মকাণ্ড মনসুর হাবিবুল্লাহ এবং সত্যেন সেন ও তাদের সহযোগিরা মিলে ব্যপ্ত করতে পেরেছিলেন, সেই গোটা পটভূমি কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনার সামাজিক ভিত্তিভূমির একটি অঙ্কুরোদগম হিসেবে দেখা দিয়েছিল। যা পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রচনা করেছিল। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে, কমিউনিস্টদের সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে ৪৭ এর পরে সত্যেন সেনের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলনকে একটা সুসংবদ্ধ রূপ দিয়েছিল। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ নেতৃত্বে একটা ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রম চলেছিল। তেমনি ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে, সমাজতন্ত্রের চিন্তায় নিজের জীবনকে উৎসর্গীকৃত করে- কমিউনিস্ট পার্টিকে কেন্দ্র করে থাকা, কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজনদের সঙ্ঘবদ্ধ করা, গোপন সংগঠন পরিচালনা করা , আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ৪৭ এর পরের সময়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন সত্যেন সেন। এ সময়ে আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের ত্রিমুখী আক্রমণে কমিউনিস্টদের একটা ভয়ঙ্কর রকমের কোণঠাসা অবস্থা ছিল। সদ্য গঠিত পূর্বপাকিস্তানে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেনের কর্মকাণ্ড, সেটি অবশ্য তিনি খুব বেশিদিন চালাতে সক্ষম হননি। কারণ ১৯৪৯ সালে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। ১৯৫৩ সালে মুক্তিলাভ করেন এবং থেকে যান ঢাকা পূর্বপাকিস্তানেই। ১৯৫৩-৫৪ সালে অবিভক্ত পাকিস্থানের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হওয়ার প্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি হয়, সেটাকে কাজে লাগিয়ে সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে আবার কমিউনিস্টদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড শুরু হয় । তবে পাকিস্তানের শাসকেরা আধা সামরিক শাসন জারি করে । যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভাকে অপসারিত করে এবং মুক্তবুদ্ধির পক্ষের সমস্ত ধরনের মানুষজনদের উপরে নামিয়ে আনে অত্যাচারের স্টিমরোলার। এ সময় আবার জেলে যেতে হয় সত্যেন সেনকে। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিন বছর ‘সংবাদ’ এ তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সংবাদ পত্রিকায় শহীদুল্লাহ কায়সারের মত মানুষজনদের সহকর্মী হিসেবে সত্যেন সেন পেয়েছিলেন। এই সময়কালে তেভাগা আন্দোলন এবং হাজং আন্দোলনের উৎস সন্ধানে পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে ধরনের ক্ষেত্রসমীক্ষা সত্যেন সেন করেছিলেন, তাকে এককথায় আন্তর্জাতিক স্তরের ক্ষেত্রসমীক্ষা বলে উল্লেখ করতে হয়। সেসব ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং ব্যক্তিগত নানা অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি রচনা করেছিলেন, ‘গ্রাম বাংলার পথে পথে’ নামক এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ। পূর্ব পাকিস্তানের গোটা বাঙালি সমাজের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে সত্যেন সেনের লেখা ‘গ্রাম বাংলার পথে পথে’ গ্রন্থখানি একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে। কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি, মেহনতি জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি- যার মূল লক্ষ্য ছিল- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। এ দাবি পরিচালনার লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উৎপাটন করে, একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা, যা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পরিচালিত হবে- সত্যেন সেনের এই গ্রন্থটি জনতার অভিষ্পার একটি জ্বলন্ত স্বাক্ষর। এ সময়েই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে ‘মহা বিদ্রোহের কাহিনী ‘ নামক সত্যেন সেন যে গ্রন্থটি রচনা করেন সেটিও বাংলা ভাষায় লেখা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল। গণ আন্দোলনকে সাহিত্যের অঙ্গনে একটি ধ্রুপদী ধারাতে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের দুটি নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। একজন হলেন- শহিদুল্লাহ কায়সার এবং আরেকজন সত্যেন সেন। শহীদুল্লাহ কায়সার জেলে বসে ‘সংশপ্তক’ নামক যে অসামান্য গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, গণআন্দোলনকে প্রেক্ষিত হিসেবে উপস্থাপিত করে, এমন ধ্রুপদী অঙ্গের সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ঠ অবকাশ আছে। ‘গণদেবতা’ ইত্যাদি উপন্যাসের ভেতর দিয়ে গণ-আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠা করার একটা চেষ্টা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু গণআন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে শহীদুল্লাহ কায়সার, সোমেন চন্দ, সত্যেন সেনদের মতো কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তার ছিলনা। ১৯৬৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ঢাকা কেন্দ্রিক কিছু প্রগতিশীল তরুণ-তরুণীকে নিয়ে, বিশেষ করে কলিম শরাফীকে সঙ্গী করে ‘উদীচী’-র প্রতিষ্ঠা করেন সত্যেন সেন। সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে এই ‘উদীচী’-র ভেতর দিয়ে শ্রেণি সচেতনতা সৃষ্টি এবং গণমানুষের জীবন সংস্কৃতি জাগ্রত করবার রাস্তাটিকে সত্যেন সেন প্রসারিত করেছিলেন। ‘উদীচী’ তৈরির সময়েই জেলে পাকিস্থানি পুলিশের অত্যাচারের দরুণ তার দৃষ্টিশক্তি প্রায় ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক শক্তির দিক থেকে, প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছ থেকে যখন উদীচী-কে- দধিচী, ব্যাঙাচি- ইত্যাদি বিদূষণ বাক্যে জর্জরিত করা হয়, তখন কলিম শরাফীকে সঙ্গে নিয়ে যে লড়াই সত্যেন সেন করেছিলেন বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা একটি অধ্যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মূলত শহিদুল্লাহ কায়সারের ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত কৌশলে ঢাকা শহর থেকে বের করে বুড়িগঙ্গা অতিক্রম করে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ভারতে পৌঁছে দেন। কলকাতায় তার বামপন্থি বন্ধুদের ব্যবস্থাপনাতে এই সময়েই চোখের চিকিৎসার জন্যে সত্যেন সেন মস্কোতে যান। মস্কোর হাসপাতালে তার সাথে নিবিড়ভাবে পরিচয় হয় ভারতের হাজেরা বেগম, আফগানিস্তানের বিপ্লবী নেত্রী আনাহিতা, দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট নেতা মোজেস বোটেন প্রমুখের সঙ্গে। লাওসের এক মুক্তিযোদ্ধা এবং মেক্সিকোর এক বিপ্লবী দম্পতিও তখন সেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এদের সাহচার্য্য, কথাসাহিত্যে এই ঘটনাক্রম; একটা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আবর্তে উত্তরীত হয়ে, বৈপ্লবিক সংহতির পরিপূর্ণতায় উপনীত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ফিরে এসে উদীচী-কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতর দিয়ে; রাজনীতি সচেতন নাগরিক তৈরির কাজের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখতে শুরু করেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়। মস্কোতে সত্যেন সেনের চিকিৎসায় সেভাবে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এ চোখের সমস্যা থেকেই তার শারীরিক সমস্যা এতোটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, বায়াত্তর সালের শেষ দিকে সত্যেন সেন চলে আসেন শান্তিনিকেতনে তার দিদির বাড়িতে। শান্তিনিকেতনেও তার শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। এই সময়েও সেবিকাদের সাহায্য নিয়ে সত্যেন সেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যে মানুষটির চিন্তাচতনার সামগ্রিকতাকে একটা চরম পরিপূর্ণতা দিয়েছিল, সেই সত্যেন সেনই ওল্ড টেস্টামেন্টের মত একটি ভাববাদী ধারাভাষ্য করে নামিয়ে আনেন পুরুষের আবেগাপ্লুত অবস্থান আর নারীর দ্বন্দ্বের ভেতরে তার ‘অভিশপ্ত নগরী’ আর ‘পাপের সন্তান’ আখ্যান দুটির ভেতরে। তখন এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে- একজন যথার্থ বস্তুবাদী, ভাববাদের সমাজতত্ত্বের ভেতরেও শ্রেণি সংগ্রামের শেকড়কে কতোখানি সফলভাবে অনুসন্ধান করতে পারেন- সেই বৈজ্ঞানিক সত্যটি। প্রাচীন যুগের বিশ্বাস আর সাফল্যহীনতার দোলাচালে সমাজবীক্ষণে সেইসময়ের ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব- এমনভাবে সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বাংলাতে সত্যেন সেনের আগে কেউ দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। সত্যেন সেনের লেখা- পুরুষমেধ, কুমারজীব, আলবেরুণী, মসলার যুদ্ধ, অভিযাত্রী, অপরাজেয়, মেহনতি মানুষ, বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম, ভোরের বিহঙ্গী, পদচিহ্ন, উত্তরণ, মনোরমা মাসীমা, সীমান্ত সূর্য গফফার খান, এগুলো বাংলা সাহিত্যের এক চিরকালীন সম্পদ। তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক লাভ করেছেন। কৈশোর কাল থেকেই বিপ্লবী জীবনে যেন প্রতি পরতে তিনি কখনো এগিয়েছেন ঝঞ্ঝার বেগে, কখনো এগিয়েছেন শান্ত ধীর পদক্ষেপে। এমন দীর্ঘপথ চলার পর একদম জীবন সায়াহ্নে, যখন তিনি দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন, শারীরিক শক্তিও প্রায় নি:শেষিত- এরকম একটা সময়ে তারুণ্যের, যৌবনের দিনগুলিকে ধরতে ছুটে গিয়েছিলেন কোপাই নদীকে দেখতে। অথচ কোপাই তখন জলহীন, শীর্ণ। কোপাইকে দেখে যেন সত্যেন সেন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাঁর জীবনের অস্তমিত সূর্যের আলোতে বাঙালি মনীষার এক চরম ক্রান্তিকাল। ১৯৭৩ সালে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ফলে আবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। চিকিৎসার জন্য চলে যান ভারতে। আশ্রয় নেন শান্তি নিকেতনের মেজদিদি প্রতিভা সেনের কাছে। সাহিত্য চর্চা ও অসুস্থতার মাঝে চলে যায় ৮টি বছর। শান্তি নিকেতনের গুরুপল্লীতে ১৯৮১ সালে ৫ জানুয়ারি তিনি মারা যান। প্রয়াণ দিবসে এই বিপ্লবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। ©সুএ হারুন-অর-রশীদ খান।(Source – bdnews 24, Wikipedia) Related posts:ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে সংখ্যালঘু মৎসজীবি সমিতির কাছে লাখ টাকা চাঁদা দাবী : আতঙ্কে জেলেরাব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো পিঠা উৎসবব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত মর্টার শেল উদ্ধার Post Views: ২৬৯ SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: