হুমায়ুন আহমেদ এর জন্মদিনে আজ

প্রকাশিত: ২:৩৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৩, ২০২১

” কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক
হুমায়ূন আহমেদ ” – হারুণ-অর-রশীদ

  বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ। নন্দিত লেখক, জনপ্রিয় নাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা, হিমু ও মিসির আলীর স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদের ৭৩তম জন্মদিন আজ।

তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বলে গণ্য করা হয়। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। অন্য দিকে তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে তাঁর মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তার নাম ছিলো শামসুর রহমান কাজল। চট্টগ্রামে থাকাকালে তাকে বাচ্চু নামে ডাকা হতো। তারপর নাম পাল্টে হলেন হুমায়ুন আহমেদ। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। তার পিতা পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফয়জুর রহমান পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং কর্তব্যরত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হুমায়ুন আহমেদকেও আটক করে এবং নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালায়। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। সঙ্গত কারণেই হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত ছিলেন।

জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার। বাংলাদেশে তার মতো জনপ্রিয় লেখক কমই এসেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো আগমন ঘটে তার। মধ্যবিত্ত ঘরে তিনি লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান। ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাস দুটি দিয়ে তার যাত্রা শুরু সাহিত্য জগতে। উপন্যাস দুটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে যায় দ্রুত। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামে মুক্তিযুদ্ধের বড় ক্যানভাসের উপন্যাস রয়েছে হুমায়ূনের। এটি দিয়েছে ব্যাপক খ্যাতি।

দুই শতাধিক উপন্যাস লিখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার নতুন উপন্যাস মানেই ছিলো বিক্রির তালিকায় সেরা অবস্থানে। হিমুবিষয়ক বই মানেই পাঠকের হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো অবস্থা। মিসির আলী ছিলো তার সৃষ্ট আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র। ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কবি’, ‘বাদশা নামদার’ ইত্যাদি কতো কতো উপন্যাস, যা পাঠকদের মনকে ছুঁয়ে গেছে।

তাকে বলা হয় কথার জাদুকর। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ নাট্যকার হিসেবেও ছিলেন প্রবল জনপ্রিয়। এদেশে কেবলমাত্র হুমায়ূন আহমেদের লেখা নাটকের জন্যই রাজপথে মিছিল হয়েছে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইকে যখন ফাঁসি দেওয়া হবে তখনই ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় মিছিল হয়েছিলো বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যেনো না দেওয়া হয়।

টেলিভিশনে মানুষকে নাটকমুখি করার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের তুলনা তিনি নিজেই। একইভাবে দেশি লেখকের বইয়ের পাঠক সৃষ্টিতেও বিশাল অবদান রয়েছে তার। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সফল। প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে জয় করে নেন সিনেমাপ্রেমীদের মন। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমাটিও এদেশের সফল সিনেমার একটি। সবশেষ পরিচালনা করেন ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।

তার নির্মিত সমাদৃত চলচ্চিত্রগুলো হলো আগুনের পরশমণি (১৯৯৪), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), দুই দুয়ারী (২০০০), শ্যামল ছায়া (২০০৪), ও ঘেটু পুত্র কমলা (২০১২)। শ্যামল ছায়া ও ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র দুটি বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের জন্য দাখিল করা হয়েছিল। এছাড়া ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

সংখ্যায় বেশি না হলেও তার রচিত গানগুলোও জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার রচিত অন্যতম উপন্যাসসমূহ হলো মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার ইত্যাদি।

জোছনার প্রতি ছিলো হুমায়ূন আহমেদের অসম্ভব রকমের ভালোবাসা। শহরের মানুষকে তিনি জোছনার প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন নাটক ও উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। ‘জোছনা বিলাস’ নামে রয়েছে তার উপন্যাস। জোছনা ও বৃষ্টির প্রতি ছিলো তার টান। ‘বৃষ্টি বিলাস’ নামেও তার উপন্যাস রয়েছে। নুহাশপল্লীতে একটি ঘরের নাম তিনি রেখেছিলেন বৃষ্টি বিলাস।

নন্দিত লেখক-নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের রয়েছে আলোচিত কিছু চরিত্র। সেসব চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তারা স্মৃতিচারণ করেছেন তাকে। ‘বাকের ভাই’ চরিত্রে অভিনয় করে তারকাখ্যাতি পান আসাদুজ্জামান নূর। আসাদুজ্জামান নূর এ বিষয়ে বলেন, “আমার অভিনয় জীবনের সেরা একটি কাজ ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি। হুমায়ূন আহমেদ নিখুঁতভাবে বাকের ভাই চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন।”

হুমায়ূন আহমেদ তার মিসির আলীকে নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন। মিসির আলী চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক- মিসির আলী যুক্তি দিয়ে যেকোনো বিষয়ের সমাধান করেন।

এখনো হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে হিমুর অবস্থান প্রথমে। হিমুর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। হিমুকে অনুসরণ করে এখনো একুশে বই মেলার সময়ে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়ান অনেকে। এখনো বিভিন্ন সময় শহরে কখনো কখনো হিমুর দেখা মেলে। হিমুকে নিয়ে প্রথম লেখা উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’।

ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন এবং নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিমার রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।

সত্তর দশকের শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত।

বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।

নন্দিত এই বাংলাদেশী লেখক, কবি, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ ১৯ জুলাই ২০১২ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করেন।

হুমায়ুন আহমেদ এর জন্মদিনে গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাই।