অগ্নিযুগের বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার ” এর জন্মদিন

প্রকাশিত: ৩:৪১ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০২১

” অগ্নিযুগের বিপ্লবী
পূর্ণেন্দু দস্তিদার “

       চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহে মাস্টার দা সূর্যসেনের অন্যতম সহযোগী, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পূর্ণেন্দু দস্তিদার আজীবন কাটিয়েছেন বিপ্লব আর মানব মুক্তির সংগ্রামে। সমাজ মনস্ক লেখক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। আজ এই বিপ্লবীর জন্মদিন। 

      পূর্ণেন্দু দস্তিদার ১৯০৯ সালের ২০শে জুন চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা চন্দ্রকুমার দস্তিদার ছিলেন চট্টগ্রাম আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী। তাঁর মা কুমুদিনী দস্তিদার ছিলেন একজন দেশপ্রেমী নারী। তাঁর উদারতা ও দেশপ্রেম প্রতিটি সন্তানের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি কলকাতার যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন।

       পূর্ণেন্দু দস্তিদার ছিলেন সাত ভাইয়ের মধ্যে বড়। দ্বিতীয় অর্ধেন্দু দস্তিদার, তিনি জালালাবাদ পাহাড়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সময় শহীদ হন। তৃতীয় সূখেন্দু দস্তিদার, যাঁর ছদ্মনাম বশীর ভাই। তিনি আজীবন বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। চতুর্থ অমলেন্দু (হেমেন্দু দস্তিদার) জালালাবাদ যুদ্ধের অগ্রসেনানী, দেশভাগের সময় চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যান। তিনি ডিব্রুগড়ে রেলে কাজ করতেন। পঞ্চম বিমলেন্দু দস্তিদার, তিনি ছিলেন শিক্ষক। ষষ্ঠ শুভেন্দু দস্তিদার ও সপ্তম কৃষ্ণেন্দু দস্তিদার উভয়ে আসামে রেলে কাজ করতেন।

     ১৯২১-২৪ সাল পর্যন্ত অসযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে মাস্টারদা চট্টগ্রামের প্রায় সকল ছাত্রদের কাছে প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেন। এই অসংখ্য ছাত্রদের মধ্যে আবার হাতে গোনা কয়েকজন তাঁর বিপ্লবী দলের সাথে পরিচিত ছিলেন। এদের মধ্যে পূর্ণেন্দু দস্তিদার ছিলেন অন্যতম। ১৯২৩ সালে তিনি মাস্টারদার সংস্পর্শে এসে বিপ্লববাদী দলে যুক্ত হন। দেশের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়চিত্তে শুরু করেন বিপ্লবী দলের কর্মকান্ড। অল্পবয়সে তিনি হয়ে উঠেন বিপ্লবী দলের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এক সদস্য।

     ১৯২৫ সালে পুলিশ সূর্যসেনকে ধরার জন্য দেওয়ান বাজারে তাঁর শ্বশুর বাড়ি ঘেরাও করে। সূর্যসেন পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বাসায় ওঠেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছিলেন। এখানে পড়ার সময়ই তিনি শহরের ছাত্র-যুব বিপ্লবীচক্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। তিনি বিপ্লবী নেতা সূর্যসেনের পলাতক জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেন। বিপ্লবী দলের ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, কানাইলাল, দেশের কথা, ও সরকারী রাউলাট কমিশন ইত্যাদি যেসব গোপন বই-পত্র ছিল তা রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। তিনি এসব গোপন বই তাঁর খুড়তুতো বোন প্রীতিলতার কাছে রেখে দেন।

      ১৯২৬ সালে সূর্যসেনকে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। সূর্যসেন গ্রেফতার হওয়ার পর বিপ্লবী কাজের দায়িত্ব পড়ে তরুণ নেতৃত্বের উপর। তরুণদের মধ্যে পূর্ণেন্দু দস্তিদার বিপ্লবী দলে নতুন সদস্য অন্তর্ভূক্ত করার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ।

       ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে সক্রিয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার নানা কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর কাজ ছিল যুবক ও ছাত্রদেরকে বিপ্লবী দলে এনে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করা। বিপ্লবী দলে তিনি কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতাসহ আরো অনেক নারীকে সংগঠিত করেন। সূর্যসেন প্রথম দিকে বিপ্লবী দলে নারীদের অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারে বাধা দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কথা মেনে নেন।

     ১৯২৮ সালে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা মুক্তি পান। এসময় পূর্ণেন্দু দস্তিদার কলকাতায় চলে আসেন। এখানে তিনি বিপ্লবী দলের সাথে অস্ত্র তৈরী করাসহ তা বিভিন্ন স্থানে পৌছে দেয়ার কাজ করতেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি কলকাতাস্থ চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের একজন প্রধান সদস্যে পরিণত হন।

      ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাকে ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করার পূর্ব প্রস্তুতি পর্বের সকল কাজের সাথে পূর্ণেন্দু দস্তিদার যুক্ত ছিলেন। সূর্যসেন তাঁকে কলকাতা থেকে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিতেন। সূর্যসেনের পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তিনি কলকাতার খ্যাতিমান সাহিত্যিক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাসায় আত্মগোপন করেন। 

      ১৯৩০ সালে মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কলকাতায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ দশ বছর বন্দি থাকার ফলে মেধাবী পূর্ণেন্দুর প্রকৌশল বিদ্যায় লেখাপড়া শেষ হয়ে যায়। তবে জেল থেকেই তিনি ডিস্টিঙ্কশন সহ বি.এ এবং বি.এল ডিগ্রি অর্জন করেন।

      ১৯৪০ সালে মুক্তি মেলে পূর্ণেন্দুর। যোগ দেন চট্টগ্রাম আদালতে। সেই সাথে রক্তে প্রবহমান রাজনীতির নেশাও তাড়িয়ে বেড়ায়। যুক্ত হয়ে পড়েন বাম রাজনীতির সঙ্গে। 

এই বছর তিনি চাচাতো বোন শান্তি দস্তিদারকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর শান্তি দস্তিদার সংসারের হাল ধরতে স্কুলে চাকুরী নেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার দুই পুত্র ও এক কন্যার পিতা হয়েছিলেন।

      ১৯৪৩ সালে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। এ সময় কমিউনিষ্ট পার্টি সারা দেশব্যাপী লঙ্গরখানা খুলে বুভুক্ষু মানুষকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে। এই দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পূর্ণেন্দু দস্তিদার অমানুষিক পরিশ্রম করেন। ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সমায় তিনি জীবনবাজী রেখে অসীম সাহসিকতার সাথে দাঙ্গা মোকাবেলা করেন। 

      ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জেলে আটক থাকা অবস্থাতেই তিনি চট্টগ্রাম জেলার একটি আসন থেকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন।

      দেশের মানুষের মুক্তি আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ পূর্ণেন্দুর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে কারাগারে। ব্যক্তিগত জীবনাদর্শ ও অভিজ্ঞতা থেকে কারাগারে থেকেও বেশ কিছু সৃজনশীল গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। এসবের মধ্যে রয়েছে: ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, ‘কবিয়াল রমেশ শীল’, ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ প্রভৃতি। অনুবাদ করেছেন চেখভ ও মোপাঁসার গল্প।

      ১৯৭১-এর ৯ই মে তিনি প্রয়াত হন। আজীবন ত্যাগী, দেশব্রতী ও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর পূর্ণেন্দু দস্তিদার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেমাগিরি বর্ডার দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত পার হবার সময় তিনি অজ্ঞাত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী, অগ্নিযুগের বিপ্লবী এবং সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। 


(Source – স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম: পূর্ণেন্দু দস্তিদার, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, প্রকাশকাল ১৯৯০ সাল, কলকাতা, gnews24, gunijon- Rafiqul Islam)