ছাএ রাজনীতির হারানো ঐহিজ্য মৃনাল চৌধুরী লিটন

প্রকাশিত: ৩:৪১ অপরাহ্ণ, মে ২৩, ২০২১

আজ ১০ ই অক্টোবর শহীদ জেহাদ দিবস ১৯৯০ আন্দোলনে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী  ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটে সামিল অবস্থান ধর্মঘটে  সরকার বাধা দিলে তুমুল সংঘর্ষ হয় সেই সংঘর্ষে যে জেহাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয় তখন ছাত্রসমাজ শহীদ জিহাদের লাশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলাদেশ সামনে নিয়ে আসে তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ হাজার হাজার  ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে   জেহাদ এর লাশ পর্শ করে শপথ নেয় এবং এরশাদবিরোধী হয় সর্বদলীয় ছাত্র গঠিত হয়

ছাত্র রাজনীতির সামাজিক, ধর্মীয় তথা পারিপার্শ্বিক জটিলতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিষয়ে বর্তমানে ছাত্র সমাজের যে কঠোর অবস্থান, উপমহাদেশে তার সূচনালগ্ন ১৮৩০ সালে, সেটা অনেকটা অনুমেয়। হিন্দু কলেজের রক্ষণশীল শিক্ষকদের বিরোধিতায় ভেঙ্গে যাওয়া প্রথম ছাত্র রাজনীতি চর্চার সংগঠন ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন’ হেনরি লুই ডিভিয়েল ডিরোজিও কর্তৃক তার বাড়িতে গঠিত হয়েছিল। বিলুপ্ত হওয়া এই সংগঠনের ছাত্ররাই ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ প্রতিষ্ঠানের নামে তাদের আদর্শিক চর্চা করে যাচ্ছিল। ১৮৩৮ সালের ১২ মার্চ তৎকালীন তরুণ সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রামতনু লাহিড়ী,দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারিদাস মিত্র প্রমুখ সংগঠকগণের ‘সাধারণ জ্ঞানোপর্জিকা সভা’, ১৮৪১ সালে ‘দেশ হিতৈষনী সভা’ সহ নানা সংগঠনের মাধ্যমে ছাত্ররা আবির্ভূত হচ্ছিলো। ১৮৪৩ সালের ২৫ এপ্রিলে বাঙালী ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ‘বেঙ্গল বিট্রিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি’ আত্মপ্রকাশ করলেও ; এর পরিক্রমায় ১৮৫১ সালে অধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে ‘বিট্রিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ‘ বেশ কার্যকর হয়ে উঠে। ১৮৭৫ সালের দিকে আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সমন্বয়ে রাজনৈতিক চর্চায় স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বদেশপ্রেম, সাম্রাজ্যবাদ, সমাজতান্ত্রিক বিষয়গুলো ছাত্রদের মনে দারুণভাবে প্রভাব পড়তে লাগল। ছাত্র তথা তরুণদের দুর্বার স্বাধীনচেতা মনোভাব সম্পর্কে একটি উক্তি বেশ বাস্তবিক মনে হয়। তা হলঃ তরুণদের প্রেমে পড়া আর রাজনীতি করার মধ্যে মেটাফোরিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। “তারুণ্যে প্রেমে পড়ে সুন্দর মুখ দেখে,তরুণোত্তীর্ণ শরীর দেখে; তেমনি তরুণ বয়সে রাজনীতি করে আদর্শ দেখে আর বার্ধক্যে এসে মন্ত্রীত্ব দেখে।” স্বাধীন চেতনাবোধ তথা অধিকারের প্রশ্নে ছাত্র তথা তরুণদের আবেগ, বিবেক দুটোর মিশ্রণই বেশ প্রবল হয়। আঠারো শতকের রাজনীতি চর্চার ধারাবাহিকতায় ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ গান গেয়ে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ছাত্রদের স্বতস্ফুর্ত বিস্ফোরণে উপমহাদেশে সর্বপ্রথম বৈপ্লবিক চেতনা পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাসের যেকোন কালেই ছাত্রদের জন্য সর্বোচ্চ প্রাধান্য তাদের ছাত্রত্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক।তৎকালীন ইংরেজ সরকারের শিক্ষা সচিব কার্লাইলের স্বদেশী আন্দোলনে যোগদানকারী ছাত্রদের সরকারি স্কুল কলেজ থেকে লাগাতার বহিষ্কারকে পরোয়া না করে, ১৯০৫ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে তিন হাজার ছাত্র সমাবেশে উপস্থিত হয়ে ‘এন্টি সার্কুলার সোসাইটি ‘ গড়ে তোলে।

ব্যাপক ছাত্রের সমর্থনপুষ্ট এই সংগঠন, ছাত্রসমাজের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবকে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে রূপ দিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ, এটা সহজেই অনুমেয়, উপমহাদেশে ছাত্ররা তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ে বার বার একত্রিত হয়ে সংগঠনে রুপ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত কোন সংগঠনের আদলে, তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বোধের চর্চা করেন নি। উনিশ শতকের সকল সংকটেই সময়ের প্রয়োজনে ছাত্ররা সপ্রতিভ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ব্রিটিশরাজ ভারতবর্ষকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ঘটিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। প্রতিবাদে বিক্ষোভ তীব্রতর হয়ে উঠলে ১৯২০’র ডিসেম্বরে নাগপুর অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘অহিংস গণঅসহযোগ আন্দোলন’ এর কর্মসূচীতে ব্রিটিশ বিরোধী তীব্র ঘৃণা নিয়ে কলকাতার বিদ্যাসাগর, রিপন, সিটি কলেজের ছাত্ররা দলে দলে কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। রচিত হয় ছাত্রআন্দোলনের এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। তৃতীয় দশকের শেষভাগে ১৯২৮ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী সাইমন কমিশন বোম্বাইয়ে এসে পৌঁছালে কলকাতার সমস্ত স্কুল কলেজে ধর্মঘট পালন করা হয়। অংশগ্রহণ করে বেথুন কলেজের ছাত্রীরাও। এই পর্যায়ের ছাত্র আন্দোলনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি এই সময় থেকেই, বিভিন্ন কলেজে নির্বাচিত ছাত্রসংসদ গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯১৯ সালে রিপন (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ) কলেজে গঠিত ছাত্রসংসদই সম্ভবত ভারতবর্ষের প্রথম নির্বাচিত ছাত্রসংসদ। ছাত্রদের কেন্দ্রীয় সংগঠনের অনুপস্থিতিতে একদিকে এই সংসদগুলিই আন্দোলন পরিচালনার মঞ্চ রূপে গড়ে ওঠে, অন্তবর্তীকালীন আধার হিসাবে ভবিষ্যত-কেন্দ্রীয় সংগঠন গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকে ত্বরানিত করে; অন্যদিকে, ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ ছাত্রকে আন্দোলনের সাধারণ কর্মসূচীতে শামিল করতেও সমর্থ হয়। আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই রাজরোষ এবং দমনপীড়ন– উভয়ই বাড়তে থাকে। পৃথকভাবে বিভিন্ন কলেজের আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর নেমে আসা সরকারী দমননীতি প্রতিহত করতে একটি সারা বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগঠনের প্রয়োজন যে অবশ্যম্ভাবী, অচিরেই ছাত্রআন্দোলনের অগ্রণী সংগঠকরা সেই উপলব্ধিতে পৌঁছান। ১৯২৬ সাল থেকে প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণের পর ১৯২৮ সালে গঠিত হয় ‘অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ‘ বাংলার সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে যা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন।১৯৩১ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জনক মানবেন্দ্রনাথ রায় করাচী কংগ্রেসে যোগদান করায়, সেখানে তার কিছু অনুসারী ছাত্র কলকাতার রজনী মুখার্জীকে কেন্দ্র করে একটি নতুন মার্কসবাদী সংগঠন ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্রলীগ ‘ গড়ে তোলেন। ১৯৩৫ সালের ৯ ডিসেম্বর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র প্রতিনিধির সমন্বয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্রলীগ এবং ১৯৩৬ সালে সারা ভারতবর্ষে ছাত্র সম্মেলনে মাধ্যমে জন্ম নেয় ‘নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন’। পরবর্তীতে বামপন্থীদের নেতৃত্বে থাকা সংগঠনটি এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দিলে দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

১৯০৬ সালেই জন্ম নেয়া মুসলিম লীগের মুসলমান ছাত্রদের প্রগতিশীল অংশ বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্র ফেডারেশনেই কাজ করেছিল। তবে তৎকালীন মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাবে ১৯৩৭ সালে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন ‘এবং ১৯৩৮ সালে কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস অরগানাইজেশন’ গড়ে উঠে।সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ নয়,বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের উত্তরসূরী নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ইতিহাস একই। পাকিস্তান জাতীয়তাবাদই পশ্চিমা জাতীয়তাবাদী উগ্রতা থেকে মুক্ত করতে পারে, এমন উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৪১ সালে পাকিস্তান ছাত্র সংঘ এবং ছাত্র এসোসিয়েশন নামে দুটো ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিত।তাছাড়া, ১৯৪৭- ৫১ সাল পর্যন্ত ‘মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন ‘ পূর্ব বাংলার শিক্ষার মাধ্যম ও আদালতের ভাষারুপে বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান নিয়ে কাজ করে।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে সামসুল হক আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম জোরালোভাবে শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি অগ্রাহ্য হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” পুনর্গঠিত হয় এবং ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এই কর্মসূচি পালনে বিশিষ্ট ভুমিকা পালন করে। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলামসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের নেতা ও পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এবং তার তিন দিন পরে ২৪ মার্চ ঢাকা ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষা এবং আন্দোলনকে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়ে ভাষণ দেন এবং সেখানেই ছাত্রদের ‘না না’ সমস্বরে তার সমুচিত জবাব মেলে।

১৯৪৮- ৫৪ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, ১৯৫৪ সালের ৭ মে রাষ্ট্রভাষা বাংলা মুসলিম লীগের সমর্থনে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধানে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলন পুরোটাই ছাত্রদের প্রত্যক্ষ, স্বতঃস্ফূর্ত ত্যাগের ফলাফল। এর উপর ভিত্তি করেই শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিপুল জয়লাভে সমর্থ হন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন নেমে আসলে, তীব্র রোষের দরুণ আইউব খান ১৯৬২ সালে আবার রাজনীতির দ্বার উন্মুক্ত করে মুসলিম লীগের একটি অংশ নিজ দল গঠন করেন। ন্যাশনাল ছাত্র ফেডারেশন (এম.এস.এফ) ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইয়ুব সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। এরাই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস কায়েম করে। ধর্মভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের গোড়াপত্তন পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই। ষাটের দশকে মোট তিনটি ছাত্র সংগঠন ধর্মভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করতোঃ ১) পাকিস্তান ছাত্র শক্তি ২) জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এন.এস.এফ) ৩) ইসলামী ছাত্র সংঘ। প্রচলিত ছাত্র আন্দোলনের ধারার বাহিরে মূলত মাদ্রাসা ছাত্রদের সংগঠন ছিল ‘তালাবায়ে আরাবিয়া’। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সাথে এসব ধর্ম ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন কার্যকর ছিল। কিন্তু ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানে যে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা স্বীকৃতি অর্জনে যে উদ্যম সাহস অর্জন করেছিলেন, তা পরবর্তীতে ছাত্রনেতা মুজিব থেকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আওয়ামীলীগের যুবক শেখ মুজিব দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্রদের মনের ভাষাকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।১৯৪৮- ৫৪ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, ১৯৫৪ সালের ৭ মে রাষ্ট্রভাষা বাংলা মুসলিম লীগের সমর্থনে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধানে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলন পুরোটাই ছাত্রদের প্রত্যক্ষ, স্বতঃস্ফূর্ত ত্যাগের ফলাফল। এর উপর ভিত্তি করেই শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিপুল জয়লাভে সমর্থ হন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন নেমে আসলে, তীব্র রোষের দরুণ আইউব খান ১৯৬২ সালে আবার রাজনীতির দ্বার উন্মুক্ত করে মুসলিম লীগের একটি অংশ নিজ দল গঠন করেন। ন্যাশনাল ছাত্র ফেডারেশন (এম.এস.এফ) ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইয়ুব সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। এরাই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস কায়েম করে। ধর্মভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের গোড়াপত্তন পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই। ষাটের দশকে মোট তিনটি ছাত্র সংগঠন ধর্মভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করতোঃ ১) পাকিস্তান ছাত্র শক্তি ২) জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এন.এস.এফ) ৩) ইসলামী ছাত্র সংঘ। প্রচলিত ছাত্র আন্দোলনের ধারার বাহিরে মূলত মাদ্রাসা ছাত্রদের সংগঠন ছিল ‘তালাবায়ে আরাবিয়া’। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সাথে এসব ধর্ম ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন কার্যকর ছিল। কিন্তু ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানে যে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা স্বীকৃতি অর্জনে যে উদ্যম সাহস অর্জন করেছিলেন, তা পরবর্তীতে ছাত্রনেতা মুজিব থেকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আওয়ামীলীগের যুবক শেখ মুজিব দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্রদের মনের ভাষাকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব বাঙালির ম্যাগনাকার্টা মুক্তির সনদ স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা দাবি উত্থাপন করে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়লেও, পূর্ব পাকিস্তানের উপর চরম বৈষম্যের প্রতিরোধে বাঙালিদের মনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। ধারাবাহিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র অসন্তোষ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত গভর্নর হাউস ঘেরাও ও পরবর্তী দিনগুলোর কর্মসূচির মাধ্যমে গণআন্দোলনে রুপান্তরিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর নেতৃবৃন্দ ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে এবং তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ দফার মধ্যে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ৬ দফার সাথে ছাত্র সমস্যাকেন্দ্রিক দাবি দাওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংক্রান্ত দাবিসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বস্ত্তত ১১ দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে ছাত্র নেতৃবৃন্দ যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি আন্দোলনগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া এসময় থেকেই শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-সহ ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পূর্ব বাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ঊনসত্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভা ও প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এ মিছিলে পুলিশের গুলিতে মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম নেতা আসাদউজ্জামান নিহত হলে গণজাগরণ রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানের।২৪ জানুয়ারি গুলিতে নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে রুস্তম নিহত হলে ঢাকার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শহরের নিয়ন্ত্রণভার সেনাবাহিনীর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়। পরদিন সেনাবাহিনী ও ই.পি.আর-এর বেপরোয়া গুলিতে ঢাকার নাখালপাড়ায় আনোয়ারা বেগম ঘরের ভেতর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে তার প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দি অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলিতে নিহত হন। তার মৃত্যু সংবাদে পরিস্থিতি এমন উত্তেজনাপূর্ণ চলবে ১