হেফাজত তান্ডব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশিত: ৬:৪৭ অপরাহ্ণ, মে ৬, ২০২১

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

আমাদের জানতে হবে এ ‘হেফাজতে ইসলাম’ পরিচিতির লোকেরা কারা? ২০১০ সালের দিকে এ দলটি গঠিত হয়েছিল মুখ্যত কয়েকটি বড় মাদরাসার শিক্ষক (মোদাররেস), ছাত্র (তালেবুল এলম) এবং এদের ওপর নির্ভরশীল কওমি ধারার লোকদের নিয়ে। চরমোনাইর পীর, বাহাদুরপুরের পীরদের সংগঠনগুলোও এদের সঙ্গে যুক্ত হয়। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আহমদ শফী সাহেব (যাঁকে যাতনা দিয়ে তাঁরই শিষ্যরা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে)। তাদের সবাই তথাকথিত ইসলামী ধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এদের বাইরেও আরও ইসলামী ধারা রয়েছে, যারা সন্ত্রাসী অবস্থান নেয় না বলে শক্তি অর্জন করে সরকারের নজরে আসতে পারছে না, যেমন তাবলিগ জামাতের মূলধারা, পীর-মাশায়েখদের অন্যান্য ধারা। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এদের নিয়ন্ত্রিত মাদরাসাসমূহে

১. জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না (এবং এরা জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন চায়)

২. এরা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে না
৩. এরা জাতীয় দিবসসমূহ পালন করে না

৪. এরা বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে

৫. এরা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে গ্রহণ করে না

৬. এরা শাসনতন্ত্র (সংবিধান) মানে না

৭. এরা সর্বোপরি বাংলাদেশের রাষ্ট্র মানে না (কেননা এদের প্রধান স্লোগান হচ্ছে ‘হাইয়া আলাল জিহাদ’- জিহাদের জন্য এগিয়ে আস এবং

৮. এদের বাইরে যারা আছে তারা কাফির, মুশরিক, মুরতাদ, নাস্তিক ইত্যাদি বিধায় তাদের হত্যা করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, অগ্রগতির বিপক্ষের সব ডান-বাম তাদের বন্ধু। ইসলামে তাদের আবির্ভাব হজরত আলী (রা.)-এর সময় থেকেই। উত্তরাধিকারসূত্রে এরা খারেজি (পথভ্রষ্ট ইসলামী একটি গোষ্ঠী যারা হজরত আলী ও আমর ইবনুল আসকে হত্যা করেছিল। মুয়াবিয়াকে হত্যাচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিল। এরা এ তিনজন খ্যাতিমান সাহাবিকে হত্যা করা বৈধ বলে ঘোষণা করেছিল, যেমন করে হেফাজতিরা অন্য মুসলমানদের হত্যা করা বৈধ বলে ডিক্রি (ফতোয়া) দিয়ে থাকে।

হেফাজতিদের এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পরপরই আমরা ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ, ২০২১-এর ঘটনাবলিতে যেতে চাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন কিন্তু এতটা গুরুতর কিছু ঘটেনি। তাহলে এবার কেন ঘটল? বস্তুত মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কোনোটাই হেফাজতপন্থিরা মেনে নেয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখুন এরা মুজিব জন্মশতবর্ষ প্রতিপালন থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল। এক মুহূর্তের জন্য তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি শতবর্ষ পালনের। অনুরূপ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও ওরা প্রতিপালনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মোদির বাংলাদেশে আগমন তাদের হাতে সুযোগ এনে দেয়। ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার। মসজিদগুলোর (বিশেষত বায়তুল মোকাররম মসজিদ) জুমার নামাজের সমাবেশের সুযোগ নিয়ে, বিভিন্ন মিথ্যাচার ও ভন্ডামির আশ্রয় নিয়ে তারা এক তান্ডব চালায়। সেকেন্ডে এ তান্ডবের সঙ্গে মিলে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তার অনুবৃত্তি ঘটায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও এক ব্যাপক তান্ডবকর্ম পরিচালনা করে। বস্তুত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ছিল ওদের টার্গেট। ওরা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় (কখনো স্বাধীনতা দিবস পালন করেছে এমন উদাহরণ কেউ খুঁজে পাবে না)। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ওরা সহ্য করতে পারেনি। তাই যেখানে যেখানে সম্ভব ওরা ‘হাইয়া আলাল জিহাদ’ স্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতায় লিপ্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হচ্ছে তাদের প্রধানতম কেন্দ্র। কেন?

রেলস্টেশন
হেফাজতের আগুনে পুড়ে ছাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন। ফাইল ছবি

২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ যে নারকীয় তান্ডব ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘটিত হয় তার প্রতিক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার আলোকে বিচার করতে হবে, কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া?

২৬ মার্চ, ২০২১ শুক্রবার

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয় তার প্রাথমিক সমাপ্তি ঘটে জুমার আগে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়া ছিল অন্যতম অনুষ্ঠান। দুপুর ১২:৩০-১৩:০০টার সময় অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় ‘মলয়া সংগীতের’ আসর বসবে। স্বাধীনতাপ্রেমী সব মানুষই জুমা ও খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম ইত্যাদি কারণে মাঠে অনুপস্থিত। এমনই সময় বেরিয়ে আসে হেফাজতি দানবরা। প্রত্যেকের হাতে লাঠিসোঁটা এবং ভোঁতা অস্ত্রাদি। আগ্নেয়াস্ত্র ছিল কি না পুলিশ বলতে পারবে। তাদের নেতৃত্বে বড় মাদরাসার বড় বড় (!) মানুষ। মাওলানা সাজিদুর রহমান (হেফাজতের নায়েবে আমির), মাওলানা মোবারকউল্লাহ (জেলা হেফাজতের নেতা) প্রমুখ (ভিডিও ফুটেজ পুলিশকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে)। প্রথমে ওরা হামলা করল রেলস্টেশনে (কেন রেলস্টেশন। আমাকে একজন বলেছেন যে এতে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ হয় সহজে)। পুরো রেলওয়ে স্টেশন পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। সিগন্যাল সিস্টেম, কম্পিউটারাইজড টিকিটিং সিস্টেমসহ পুরো স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া হলো (২০১৬ সালে ওরা এমনটি করেছিল। এজন্য তাদের আইনের আওতায় আসতে হয়নি। কেন?)। তারা শহরের কেন্দ্রস্থলে থানা ও বড় মাদরাসা বলে পরিচিত জামিয়া ইউনুছিয়ার নিকটবর্তী বঙ্গবন্ধু স্কোয়ারে আক্রমণ চালায়। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল ও অন্য আরেকটি বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিনষ্ট করা হয়। পৌরসভায় আক্রমণ চালানো হয়। আরেকদল এসপি অফিস, ২ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ি, ফাঁড়িতে কর্মরত একজন ইন্সপেক্টরকে প্রাণঘাতী আক্রমণ করে আহত করে, জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, সিভিল সার্জনের অফিস, সার্কিট হাউসে সমবেত মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদের ওপর, সার্কিট হাউসের গাড়ির ওপর, পাশের জেলা পরিষদ ডাকবাংলো ডিজিএফআইর কয়েকজন কর্মকর্তার মোটরসাইকেলে আক্রমণ করে। পরপরই তারা জেলা জজ, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বাসভবনে আক্রমণ করে। এ বাসভবনগুলোর পাশেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের জেলা স্মৃতিসৌধ। ভোরে সরকারি-বেসরকারি সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেছিল, উচ্ছৃঙ্খল হেফাজতিরা সব পুষ্পস্তবক মাড়িয়ে তছনছ করে দেয় (ওরা যে স্বাধীনতাবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী তার কি আরও প্রমাণ প্রয়োজন?)। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি যেখানে পাওয়া যায় সবই ভেঙে ফেলা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অসহায় দর্শকের মতো শুধুই দেখে গেছে। কোথাও প্রতিহত করার চেষ্টা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এরই মধ্যে হেফাজতি দুষ্কৃতকারীরা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় গুলিতে মিথ্যা মৃত্যুর গুজব। জনগণের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় এগুলিতে মিথ্যা মৃত্যুর গুজব। জনগণের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত মসজিদগুলোয় ‘হাইয়া আলাল জিহাদ’ ধ্বনি হতে থাকে। ইতিমধ্যে এদের সঙ্গে যুক্ত হয় বিএনপি কর্মী, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল এবং জামায়াতে ইসলামীর লোকজন। ২৬ তারিখ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হেফাজতি দুষ্কৃতকারী গুন্ডা-বদমাইশদের এক অবর্ণনীয় দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক তান্ডব। গ্রাম থেকে শহরে প্রবেশের কোনো রাস্তা খোলা না থাকায় (প্রশাসন ও দলের বন্ধুদের পরামর্শে) আমি শহরে আসতে সক্ষম হইনি।

২৭ মার্চ ২০২১, শনিবার

২৭ মার্চ সরকারি কর্মসূচিতে অংশ নিতে আমি শহরে গমন করি। সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচিতে অংশ নিই। এখানেও ২৬ মার্চ হামলা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙার ব্যর্থ চেষ্টা হয়। ফুলের বাগান বিনষ্ট করা হয়। ভিতরে ভাঙচুরের অপপ্রয়াস হয়। তার পরও আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান করি। পরপরই সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষাচত্বরে যাই। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, মেয়র, সরকারি কর্মকর্তা, জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। উন্নয়ন মেলার উদ্বোধন করা হয়। বিকাল ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগের আলোচনা সভার আয়োজন ছিল আগে থেকেই।

পৌর মিলনায়তনে আমরা সমবেত হই ৪টায়। আলোচনা সভাকে প্রতিবাদ সভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখানে আমাদের জেলা নেতাদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ঘোষণা করা হয় যে সবার পরে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হবে। যথারীতি সভা হয় এবং প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। একেবারেই শান্তিপূর্ণ মিছিল। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিয়ে মিছিলটি দক্ষিণ কালীবাড়ি মোড়ে পৌঁছলে আমি মিছিল থেকে বের হয়ে যাই। মিছিলটি সিদ্ধান্ত মোতাবেক রেলক্রসিংয়ে গিয়ে শেষ হয়। আমরা যখন দক্ষিণ কালীবাড়ি মোড়ে তখন আমাদের থেকে অনেক দূরে মাদরাসা রোডের মোড়ে কিছু ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। যার সঙ্গে আমাদের মিছিলের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ নিয়ে ২০১৬ সালের মতোই মাদরাসাওয়ালারা মিথ্যাচার করা শুরু করে এবং আজগুবি সব কথাবার্তা বলে। এখানেও তারা ‘হাইয়া আলাল জিহাদ’ ঘোষণা দেয় মাদরাসা মসজিদ থেকে বড় বড় মাওলানার উপস্থিতিতেই। মাদরাসার পাশের এলাকা বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত। মাদরাসাওয়ালা ও বিএনপি মিলে মাদরাসা আক্রমণের মিথ্যা প্রচার চালাতে থাকে এবং মুরতাদ ছাত্রলীগ-যুবলীগদের হত্যা করার জন্য এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাতে থাকে মসজিদের মাইকে।

আমাদের মিছিল কিন্তু বেশ আগেই শেষ হয়ে গেছে। তার পরও আমাদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করা হয়। ডাহা মিথ্যাচার যেহেতু পার পেয়ে যায় না সেহেতু তারাও মিথ্যাচারে দাঁড়াতে পারেনি। একই সময়ে মূল শহর থেকে অনেক দূরে কুমিল্লা-সিলেট-ঢাকা সড়কের সংযোগস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল হেফাজতি, ছাত্রদল-যুবদল গুন্ডাদের সংঘর্ষ হয়। সে সংঘর্ষে চার ব্যক্তি নিহত হন। এদের কেউ মাদরাসাপড়ুয়া নন। এ অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়রা বসে সিদ্ধান্ত নিই যে ২৮ তারিখ হরতালের দিন আমরা প্রতিরোধ করব না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের ওপর সবকিছু নির্ভর করবে। সিদ্ধান্তের পর আমি গ্রামে চলে যাই। আমাদের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার সরকারের লোকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে সরকারি পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে হরতাল আহ্বানকারী হেফাজতিরা ধ্বংসাত্মক কিছু করবে না। আমাদেরও কোনো সমাবেশ না করতে অনুরোধ করা হয়। সেমতে আমাদের সাংগঠনিক কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই হরতালের মুখোমুখি হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

২৮ মার্চ, রোববার, হরতাল

এটা সত্যিই এক নারকীয় দিন। মৃত্যুর মিথ্যা হিসাব ছড়িয়ে মাদরাসা ও হেফাজতওয়ালারা স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়। ছাত্রদল, যুবদল, দলত্যাগী দুষ্কৃতকারী দল, হেফাজতি দানব মিলে সারা শহরে এক বাধাহীন নারকীয় তান্ডব চালায়। ১৪৪ ধারা বা কারফিউ কোনো কিছুরই আশ্রয় নেওয়া হলো না। ওদের আশ্বাসের ওপর (সাজিদুর রহমান, মোবারকউল্লাহর আশ্বাসের ওপর) ভরসা করা হয়। দুষ্কৃতকারীরা পৌরসভায় আগুন দিল, জেলা ক্রীড়া সংস্থায় আগুন দিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কেউ সহায়তায় আসেনি। অদূরেই ফায়ার সার্ভিস। এক ফোঁটা পানিও তারা ছিটায়নি। সাহায্য চাওয়া সত্ত্বেও তারা সাহায্য করতে অপারগতা জানায়। ফায়ার সার্ভিস কী জবাব দেবে? পুড়িয়ে দেওয়া হলো উন্নয়ন মেলা, শিল্পকলা একাডেমি, আল মামুন সরকারের অফিস ছাই হয়ে গেছে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষাচত্বরে ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে। অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিস ভাঙচুর হয়েছে। পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের পৈতৃক বাড়ি, ছাত্রলীগ সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেলের ভাড়া বাসা, সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন সুমনের পৈতৃক নিবাস। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, সরকারি গণগ্রন্থাগার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস, মেয়রের বাসভবন, আনন্দময়ী কালীবাড়ি, বিজিসিএলের ১ নম্বর লোকেশন ও সেখানে রাখা গাড়ি, জেলা আওয়ামী লীগের তথা সংসদ সদস্যের অফিস ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। যাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়েছে তারা সাহায্য চেয়েও কোনো সাহায্য পাননি। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ফায়ার সার্ভিসের মতো সবই অপারগতার কৈফিয়ত।

শোনা যায় (এবং সত্য) যে থানার মসজিদের মাইক থেকে হেফাজতিদের আশ্বাস দেওয়া হয় তারা কোনো অ্যাকশনে যাবে না। বিনিময় হেফাজতিরা যেন থানা আক্রমণ না করে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো প্রশাসনের কারও কাছ থেকে কোনো কার্যকর সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। বরং তাদের কোনো কোনো মহল ২৭ তারিখের মিছিলের জন্য আমাকে দায়ী করে এটাকে উসকানিমূলক বলতে চেয়েছে বা চাচ্ছে। যদি তর্কের খাতিরে এটা মেনে নেওয়া হয় তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সহযোগিতা আক্রান্তরা কেন পেলেন না? প্রশাসনের পরামর্শ মেনে নিয়েই মামুন সরকার প্রতিরোধে এগিয়ে যাননি। এসবের কারণ কী? তাদের দায়িত্বটা কী? ১৪৪ ধারা বা কারফিউ কেন জারি করা হলো না? ২৮ তারিখ তাদের ভূমিকা কী ছিল? ২৬ তারিখের তান্ডবে তাহলে কাদের ইন্ধন ছিল? ২৬ তারিখের দুষ্কর্ম, ২৭ তারিখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চারজন নিহত হওয়ার পরও ২৮ তারিখে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণ কী?

এতসব ঘটনার পরও দুষ্কৃতকারীদের পালের গোদা সাজিদুর রহমান, মোবারকউল্লাহ বা অন্যান্য মিথ্যাবাদী গুজব সৃষ্টিকারীকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় কেন আনা হচ্ছে না?

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আমরা নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করছি- ১. ২৬ তারিখ রেলস্টেশনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার দায় কার? বঙ্গবন্ধু স্কোয়ারে হামলা ও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুরের দায় কার? মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও পৌর মার্কেটের সামনের বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল ভাঙচুর ও পৌরসভায় ভাঙচুরের জন্য দায় কার? স্মৃতিসৌধে অর্পণ করা পুষ্পস্তবক পায়ে মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দায় কার? এসপির অফিস, ২ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ি, সার্কিট হাউস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা মৎস্য অফিস, সিভিল সার্জন অফিস, জেলা জজের বাসভবন, ডিসি-এসপির বাসভবন ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের মোটরসাইকেল ও সার্কিট হাউসের নারী সমাবেশে হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের জন্য দায় কার? এ দিনও ভাঙচুরের সময় হেফাজত নেতা মোবারকউল্লাহ, সাজিদুর রহমানসহ অন্যদের ভূমিকা কী ছিল? ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত ও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ত্যাগকারীদের ভূমিকা ইত্যাদি যাচাই হওয়া দরকার। মাদরাসা ও হেফাজত নিয়ন্ত্রিত মসজিদ থেকে ‘হাইয়া আলাল জিহাদ’ এবং হাটহাজারী ও ঢাকায় পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর অপপ্রচার কেন চালানো হয়েছিল, কারা চালিয়েছিল তা বের হওয়া দরকার।

২. ২৭ তারিখে পুলিশের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় ২০ কিমি) খাটিহাতা ও ন›রূপুরে যে সংঘর্ষ হয় তার কার্যকারণ খুঁটিয়ে দেখা দরকার। আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভা ও প্রতিবাদ মিছিল আদৌ কোনো বিরূপতার কারণ হয়েছিল নাকি ছাত্রদল, যুবদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ, জামায়াত-বিএনপির পূর্বপরিকল্পনার কারণে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং এ সময়ে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল তা খতিয়ে দেখা দরকার।

৩. ২৮ তারিখ যে সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত হয় শহরব্যাপী এর দায় কার? পৌরসভা পুড়িয়ে দেওয়া, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষাচত্বর পুড়িয়ে দেওয়া ও ব্যাপক ভাঙচুর, আওয়ামী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদকের সামাজিক কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া, জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুড়িয়ে দেওয়া, আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয় ভাঙচুর, আনন্দময়ী কালীবাড়িতে দেবীর স্বর্ণালঙ্কার লুট, উপজেলা চেয়ারম্যান নাসিমা মুকাই আলীর বাড়িতে হামলা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন পুড়িয়ে দেওয়া, উপজেলা ভূমি অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ভাঙচুর এবং মেয়র নায়ার কবিরের বাসায় ভাঙচুরের দায় কার?

হরতালের ইতিহাসে যা কখনো হয়নি, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকারের বাসভবন সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া, তাঁর শ্বশুরবাড়িতে ভাঙচুর, ছাত্রলীগ সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেলের বাসভবন পুড়িয়ে দেওয়া, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন শোভনের পৈতৃক বাসভবন পুড়িয়ে দেওয়া, জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া, আওয়ামী লীগ যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারি মন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুল হক খোকনের বাসভবনে আক্রমণ, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা নেসার চৌধুরীর বাসভবনে আক্রমণ, মোকতাদির চৌধুরী মহিলা কলেজে ভাঙচুর ইত্যাদির জন্য দায় কার? যখন পুরো শহর পুড়ছিল তখন দমকল বাহিনীর কাছ থেকে এক ফোঁটা পানিও বের হয়নি এজন্য দায় কার? আক্রান্তরা চেষ্টা করেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য সহায়তা পাননি। কেন? দায় কার? দেশের বৃহত্তম গ্যাস ফিল্ড বিজিএফসিএলে হামলার দায় কার? বাখরাবাদ গ্যাসের সাপ্লাই বন্ধ করার মতো নাশকতার দায় কার?

৪. আমরা মনে করি উত্থাপিত প্রশ্নসমূহের উত্তর খুঁজতে ও ভবিষ্যৎ নিরাপদ অবস্থান সৃষ্টি করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন। এ দাবি আমরা উত্থাপনও করেছি জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। অধিকন্তু ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হেফাজতের যে তান্ডব হয়েছিল তাও বিচারের আওতায় আনা দরকার।

৫. জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা এবং ‘হাইয়া আলাল জিহাদ’ ইত্যাদি প্রশ্নে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। হেফাজতিরা কেন এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের করণীয় কী হওয়া উচিত তাও নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন।

৬. বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও জাতীয় কমিশনের পাশাপাশি চলমান ফৌজদারি কার্যক্রমও অব্যাহত রাখতে হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বৃহৎ মাদরাসাগুলোকে পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি হেফাজতবিরোধী ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানের আলোকে সচেতন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং শর্ষের মধ্যে ভূত খুঁজে বের করা আবশ্যক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্ষেত্রে তথাকথিত আলেমদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক: সংসদ সদস্য,সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং সম্পাদক, মত ও পথ।