একজন বীর মুক্তিযুদ্ধার কথা

প্রকাশিত: ৬:৫৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৬, ২০২১

বাংলাদেশ। উদযাপন করছে সুবর্ণজয়ন্তী। একটি রাষ্ট্রের জীবনপরিক্রমায় এই অর্ধশত বছর বড় কোনো অতিক্রমণ নয়। কিন্তু ৫০ বছরে এই জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে, তা একবার বিচার করে দেখার সুযোগ তো রয়েছে। যে আদর্শিক অবস্থান নিয়ে এ দেশের জন্য লড়েছেন মানুষ, আত্মাহুতি দিয়েছেন ৩০ লাখ বীর বাঙালি আর নিগ্রহের শিকার হয়েছেন লাখো নারী, ৫০ বছরে সেটির অবস্থা কী, তা তো একবার ভেবে দেখা দরকার। সরকার আসে সরকার যায়, রাষ্ট্র তো স্থায়ী অস্তিত্ব। তো রাষ্ট্রের অর্জন কী? ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এই এগোনো হচ্ছে বৈষয়িক। আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোর দিক থেকে আমরা অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছি ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০২১ পর্যন্ত সময়ে। মাঝের ২৮ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এক বিশ্বাসঘাতক মোশতাক ও তাদের দোসররা মিলে রাষ্ট্রপিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা ও তার সরকার উত্খাত করে বাংলাদেশের উল্টো যাত্রার সূচনা করে। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাই শুধু নয়, আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ভাবাদর্শ আর বঙ্গবন্ধু মুজিবের আদর্শের উল্টো পথে দেশকে নিয়ে গিয়েছিল। সে কারণে আমরা বৈষয়িক উন্নয়নে প্রায় ৫০ বছর আর মতাদর্শগতভাবে প্রায় শত বছর পিছিয়ে গিয়েছি।মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সরকার গঠনে এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে আমাদের অর্জন ক্রমে পশ্চাত্মুখী। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আমাদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে প্রত্যর্পণ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি উল্টো পথে হাঁটছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ফিরুন।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছি। এ সময়ে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে তা ভেবে দেখতে হবে।’ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও একই কথা বলতে চাই। বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষায় রচিত বাংলাদেশে ২২ হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া এবং লুটেরাদের পক্ষে অর্থনীতিকে দাঁড় করানো কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে, ভেবে দেখা দরকার। লুটেরাতন্ত্র আর বৈষম্যহীন অর্থনীতি কি সমার্থক? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুজিবের সংগ্রাম একই সুতোয় গাঁথা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ রাজনীতি, বৈষম্যহীন সুষম বণ্টনের অর্থনীতি সব মিলিয়ে ইতিবাচকতার জাতীয়তাবাদী বাঙালি-বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এই ৫০ বছরে আমরা কতটা সক্ষম হয়েছি? নাসিরনগর, গাইবান্ধা, সুনামগঞ্জের শাল্লা, কক্সবাজারের রামু, ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত প্রশ্নে সীমাহীন ধৃষ্টতা নিয়ে আমরা কতটা এগোতে পেরেছি? ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কওমি হাফেজি মাদ্রাসা, মানহীন কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অরাজকতার জন্ম দিয়েছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের অগ্রযাত্রা ও স্থায়ী উন্নয়নের পথযাত্রা ব্যাহত করতে বাধ্য।৷৷

আমরা জানি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নজরে আসার জন্য, নেতৃত্বকে পরিতুষ্ট করতে নানাভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের সাফল্যগাথা গাওয়া হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে উত্তরণ নিঃসন্দেহে বড় ব্যাপার। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা, যা এ উন্নয়নকে ধারণ করে অগ্রযাত্রাকে সুগম করতে পারে। সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ কী পরিদৃষ্ট হয়? রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আর অর্থনীতির পরিচালনায় যে পথে অনুসরণ করা হচ্ছে, তা কি আদৌ আমাদের দীর্ঘস্থায়ী অগ্রযাত্রার স্বস্তি দেবে? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আজ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা দেশপ্রেমিক সব নাগরিকের দায়িত্ব। কতিপয় চাটুকার আর তল্পিবাহকের মধুমিশ্রিত কথায় বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। লুটেরাতন্ত্রের অবসান একান্তভাবেই কাম্য। নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে দাঁড় করানো আবশ্যক। আমলাতান্ত্রিকতা নয়, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং জনপ্রশাসনে। সর্বোপরি আইনের শাসন ও জবাবদিহিতামূলক জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সুশাসনের পক্ষের বিচার ব্যবস্থা

 নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী একজন প্রতিরোধ সংগ্রামী হিসেবে প্রশ্নগুলো এসে ভিড় জমায় মনের গহিনে। যখন দেখি বাংলা ভাষাবিদ্বেষীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিচ্ছে, চিহ্নিত লুটেরারা অর্থনীতির নেপথ্যের চালক, মুক্তিযুদ্ধে তথাকথিত নিরপেক্ষবাদীরা  বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, মুজিব হত্যায় যারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদে এগিয়ে আসেনি, তারাই যখন মুজিব আদর্শে পতাকাবাহী তখন সামগ্রিকভাবেই আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না এবং এ শঙ্কার অবসান হওয়া দরকার। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলেই এ শঙ্কা দূর করা সম্ভব। রাষ্ট্রপতি যেমনটি বলেছেন, আসুন, সবাই মিলে মুজিব আদর্শে ফিরে যাই। তাহলেই আমাদের সহযোদ্ধাদের আত্মাহুতি, মা-বোনদের ত্যাগ আর লাখো কোটি মানুষের সংগ্রামে অর্জিত বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে দৃপ্ত পদভারে।

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সংসদ সদস্য