একজন শহীদ-কন্যার বাবার স্মৃতি

প্রকাশিত: ১:১৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১

নুসরাত জাহান ইব্রাহিম ওরফে ডরোথি। নামটি অনেকের কাছে অচেনা। এই বাংলাদেশেরই মেয়ে তিনি। কিন্তু তাঁর একটি বিশেষ পরিচয় আছে। তিনি একজন শহীদ-কন্যা। ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার এরশাদ সরকার ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে সেলিম-দেলোয়ার নামের যে দুই ছাত্রনেতাকে খুন করেছিল, ডরোথি তাঁদেরই একজন ইব্রাহিম সেলিমের সন্তান। আমরা গতানুগতিক আরও অনেক দিবসের মতো সেলিম-দেলোয়ার দিবসও পালন করি; কিন্তু তাঁদের স্বজনেরা কেমন আছেন, সেই খোঁজ রাখি না।
বাবা ইব্রাহিম সেলিম যখন মারা যান বা তাঁকে হত্যা করা হয়, তখন ডরোথির বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। বাবার স্মৃতি কিংবা চেহারা তাঁর মনে থাকার কথা নয়। মা, নানি ও অন্যান্য স্বজনের কাছে তিনি বাবার কথা শুনেছেন। পরে বড় হয়ে তাঁর আত্মদানের বীরত্বগাথা জেনেছেন। মনে মনে গর্ববোধ করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের জীবন যে দুঃখে ভরা। সেলিমের মৃত্যুর সময় তাঁর স্ত্রী ও ডরোথির মা নাসিমা জাহান জেসমিন বরিশাল বিএম কলেজের স্নাতক সম্মান শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও জীবনের অনিশ্চয়তার কারণে তিনি আর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলেন। এখন অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। কন্যা ডরোথিই ভরসা। তিনি জানিয়েছেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর পক্ষে শ্বশুরবাড়িতে থাকা সম্ভব হয়নি। সেখান থেকে কোনো সহায়তাও পাননি। নিজে বাড়িভাড়া করে থাকবেন, সেই সামর্থ্য তাঁর নেই। তাই মেয়েকে নিয়ে বরিশালে বাবার বাড়িতেই থাকছেন।
মায়ের সঙ্গে ডরোথির জীবনসংগ্রাম শুরু হয় বাবার মৃত্যুর পর থেকেই। আর্থিক কারণে নবম শ্রেণিতে থাকতে একবার তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছোট্ট চাকরির পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন ডরোথি। এভাবেই কষ্টেসৃষ্টে চলছে মা ও মেয়ের সংসার। অথচ বাবা বেঁচে থাকলে ডরোথির জীবনটা অন্য রকম হতো। আর দশটি মেয়ের মতো তিনিও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে পারতেন। মাকেও মাঝপথে লেখাপড়ায় ইতি ঘটিয়ে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নিতে হতো না।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা এক আরজিতে ডরোথি নিজের বেদনা ও কষ্টের কথা জানিয়েছেন। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করেছেন। তাঁর স্নেহ-সহানুভূতিও পেয়েছেন। কিন্তু ডরোথির জীবনসংগ্রাম শেষ হয়নি। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা তাঁর আরজিটি পড়লে যেকোনো মানুষের চোখে পানি আসবে। এখানে কিছু অংশ তুলে ধরছি। ‘বিনীত নিবেদন এই যে, ১৯৮৪ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের ট্রাকচাপায় নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা শহীদ ইব্রাহিম সেলিমের একমাত্র মেয়ে আমি নুসরাত জাহান ইব্রাহিম। বাবার মৃত্যুর সময় আমি ছয় মাসের শিশু ছিলাম। এই অসহায় অবস্থায় আমার পিতার বাড়িতে স্থান না পেয়ে মা আমাকে নিয়ে বরিশালে আমার নানাবাড়িতে আশ্রয় নেন। তারপর থেকে মা আমাকে নিয়ে কঠিন জীবনসংগ্রাম শুরু করেন। আমি অনেক সংগ্রাম করে আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে যোগদান করি। আমি বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি কোর্সে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার পিতৃকুলের আত্মীয়রা আমাকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে।…অতএব, সবিনয় নিবেদন এই যে, আপনার কাছে আমার আকুল আবেদন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক শহীদ ইব্রাহিম সেলিমের একমাত্র সন্তানকে তার পৈতৃক সম্পত্তির যথাযথ অংশ যাতে সে বুঝে পেতে পারে, তার ব্যবস্থা করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’
এই আবেদনপত্রে বর্ণিত বিষয়ের সত্যাসত্য জানতে প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমানকে টেলিফোন করলে তিনি জানান, ডরোথির অভিযোগ অসত্য নয়। তিনিও তাঁদের পারিবারিক সমস্যা জানেন। মিজানুরের কাছে কথা বলে আরও জানা গেল, শহীদ ইব্রাহিম সেলিমের বাড়ি তাঁর এলাকাতেই। ১৯৫৪ সালের ১০ অক্টোবর পটুয়াখালীর বাউফলের নাজিরপুর গ্রামে সেলিমের জন্ম। তাঁর বাবা আবদুল করিম ছিলেন থানা (বর্তমানে উপজেলা) স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান সেলিম পটুয়াখালীর সরকারি জুবিলী বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। বরিশাল বিএম কলেজে থাকতেও তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এইচএসসি পাস করার পর বাবার সঙ্গে কিছুটা মতবিরোধ হয়। বাবা চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়বে। কিন্তু সেলিম বাবার কথা না শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। থাকতেন সূর্যসেন হলের ৩২৮ নম্বর কক্ষে। ১৯৭৯ সালের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে হল শাখায় সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরপর ছাত্রলীগে যোগ দেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃত্বে আসেন। ১৯৮২ সালের ২৪ অক্টোবর বিয়ে হয় নাসিমা জাহান
সঙ্গে। জেসমিনের বাবা ছিলেন চিকিৎসক এবং তখন তাঁর কর্মস্থল ছিল বাউফল।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সহমর্মিতা আছে। তিনি নানাভাবে তাঁদের সহায়তা করছেন। ডরোথির প্রতিও তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার কমতি নেই। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন, কেন তিনি পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন? আমাদের সমাজ-সংসার কেন এত নিষ্ঠুর হবে?
ডরোথি মাকে নিয়ে এতটা পথ একা হেঁটে এসেছেন। নিজেকে তৈরি করছেন। শত ঝড়–ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করেছেন। ডরোথির মতো আরও যাঁরা বাবাকে হারিয়েছেন, স্বজনের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের জন্য কিছু করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মানবিক কর্তব্য। ডরোথির অভিযোগটি গুরুতর। আশা করি, সরকার এই অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে। ডরোথি বাড়তি কিছু চান না, তিনি চান তাঁর বাবার সম্পত্তির ন্যায্য হিস্যা। সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে তাঁর এই চাওয়া কি অন্যায়?
কয়েক দিন আগে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ শহীদ সেলিমের কন্যা নুসরাত জাহান ডরোথির সাক্ষাৎকারটি পড়ে নিজেকে অপরাধী মনে হলো। আমরা কোথায় আছি? অন্যান্য মেয়ের মতো বাবার স্নেহ পাওয়ার অধিকার তাঁরও ছিল। সেলিম, দেলোয়ার ও তাজুলদের আত্মত্যাগের পথ ধরে দীর্ঘ নয় বছরের আন্দোলনের মাধ্যমে নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটে। রাজনৈতিক দলগুলো সেদিন তিন জোটের রূপরেখা দিয়ে গণতন্ত্রকে সংহত এবং স্বৈরাচারকে চিরতরে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বৈরাচার আজ একের পর এক মামলা থেকে খালাস পেলেও সেলিম-দেলোয়ার হত্যার বিচার হয় না। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।
আমাদের দেশে শহীদরা এখন আর স্মরণীয় মানুষ নন, ক্ষমতার সিঁড়ি। শহীদ সেলিমের কন্যা ডরোথি আক্ষেপ করে বলেছেন, সমাজ তাঁর বাবাকে ভুলে গেছে। তিনি চান তরুণ প্রজন্ম জানুক, কেন তাঁর বাবা এবং তাঁর সহযাত্রীরা জীবন দিয়েছেন। শহীদ সেলিম কেবল ভালো ছাত্র ছিলেন না, একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন। ডরোথি বরিশালের বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে ধরনা দিয়েছেন তাঁর বাবার আত্মত্যাগের কথা দেশবাসীকে জানাতে। এটি দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও সরকারের জন্যও লজ্জাজনক।
আমরা আর কত দিন শহীদদের ভুলে থাকব আর স্বৈরাচারের সঙ্গে সখ্য গড়ব? শহীদ সেলিম-দেলোয়ার-নূর হোসেন-তাজুল-মিলনদের যারা হত্যা করেছে, তাদের বক্র হাসি আর কত দিন দেখতে হবে? আর কত দিন শহীদের স্বজনদের আহাজারি শুনতে হবে?
ডরোথির আরেকটি ছোট্ট আরজি আছে। ঢাকার একটি সড়কের নাম ডরোথির বাবা ইব্রাহিম সেলিম ও তাঁর সহযাত্রী দেলোয়ারের নামে করার। ঢাকা (দক্ষিণ) সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে লেখা আবেদনপত্রে তিনি লিখেছেন: ‘১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় আমার বাবা ইব্রাহিম সেলিম এবং দেলোয়ারকে নির্মমভাবে ট্রাকচাপায় হত্যা করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে “শহীদ সেলিম-দেলোয়ার দিবস” হিসেবে পালিত হচ্ছে। দেশ আজ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ আজ স্বৈরাচারমুক্ত, তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দুই শহীদ ছাত্রনেতা যে স্থানে (ফুলবাড়িয়া) নিহত হয়েছিলেন, সেই সড়ক তাঁদের দুজনের নামে নামকরণ করা হলে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাঁদের আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অমর হয়ে থাকবে।…শহীদ ছাত্রনেতা সেলিম ও দেলোয়ারের নামে ফুলবাড়িয়ার সড়কটির নামকরণ করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করলে মহোদয়ের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকব।’
তাঁর এই চিঠি গত জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে লেখা। এরপর তিন মাস চলে গেলেও ডরোথি মেয়রের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি। এমনকি তিনি মেয়রের অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সহযোগিতা করেননি।
মেয়রের দেখা না পেলেও ডরোথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ ঠিকই পেয়েছেন। তাঁর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি ও সহৃদয়তা বরাবরই ছিল এবং আছে। কিন্তু ডরোথির বক্তব্য: প্রধানমন্ত্রী এত ব্যস্ত মানুষ, চাইলেই দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই লিখিতভাবে তাঁর আশৈশব কষ্ট ও বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন।
শহীদ-কন্যা ডরোথির কান্না কি আমাদের স্পর্শ করবে না? আমরা এতটাই বিবেকহীন? সুএ ঃ
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।