ভাস্কর্য একটি দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ইতিহাসের অংশ মৃনাল চৌধুরী লিটন

প্রকাশিত: ৫:৫৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০

বাংলাদেশে এখন ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে যারা মাঠ গরম করতে চাইছে, তারা ওই কলোনিয়াল মৌলবাদের দালাল। বিশে^র নানা দেশে ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্য শিল্প একটি দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কৃত নানা ভাস্কর্য থেকে বোঝা যায়, সুদূর অতীতকাল থেকেই পৃথিবীতে ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভাস্কর্য পৃথিবীর ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরব বহন করে চলেছে। আজও দেশে দেশে ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে নিপুণ সৃষ্টিশীলতায়। এর মাধ্যমে ফুটে উঠছে নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি। মুসলিম বিশ^ও ভাস্কর্য শিল্প থেকে পৃথক নয়। সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, মিসর, তুরস্ক, ইরান, ইরাকসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশেই রয়েছে ভাস্কর্য। সবচেয়ে বেশি মুসলিমের বাস যে দেশে, সেই ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শৈশবের ভাস্কর্য?

ভাস্কর্য নিয়ে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ রয়েছে, পুরো পৃথিবী এমনকি যদি ইসলামী দেশগুলোর দিকেই তাকাই, তাহলেও আমরা দেখতে পাই, ইরানে যেখানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ভাস্কর্য আছে। ইরাকেও রাস্তায় রাস্তায় ভাস্কর্য আছে। তুরস্কে সেখানে ইসলামী ডানপন্থী দলই ক্ষমতায়, সেখানে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ভাস্কর্য আছে। পৃথিবীর অন্যান্য ইসলামী দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নানা ভাস্কর্য এমনকি সেখানকার শাসকদের ছবি সম্বলিত ভাস্কর্যও রাস্তায় রাস্তায় আছে।

, সৌদি আরবে আমাদের মক্কা শরীফ, মসজিদে নববী অবস্থিত, সেখানে জেদ্দাসহ বিভিন্ন শহরে ঘোড়া, উট এমনকি সৌদি প্রশাসকদের ছবি সম্বলিত ভাস্কর্য আছে। এছাড়া জেদ্দায় পৃথিবীর বিখ্যাত ভাস্করদের দিয়ে ভাস্কর্য বানিয়ে তৈরি করা হয়েছে স্কাল্পচার মিউজিয়াম, যার আরবীয় নাম হচ্ছে আল-হামরা। নারী-পুরুষ, জীবজন্তুসহ বহু কিছুর ভাস্কর্য সেখানে আছে।

তুরস্কে কবি ফেরদৌসি, সেখ সাদী, হযরত জালাল উদ্দীন রুমী’র ভাস্কর্য আছে, এমনকি সেখানে মসজিদের সামনেও ভাস্কর্য আছে

ভাস্কর্য একটি দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ইতিহাসের অংশ উl এ নিয়ে সৌদি আরবেও কেউ প্রশ্ন তোলেনি। আর যারা পাকিস্তানী ভাবধারায় এ নিয়ে প্রশ্ন করছেন, তাদের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবো, তাদের পূর্বপুরুষরা বা তারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছিলেন কিম্বা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। তাদের সেই সাধের পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলীর জিন্নাহ’র ভাস্কর্য আছে, কবি ইকবালের ভাস্কর্য আছে, লিয়াকত আলী খানসহ আরো বহুজনের ভাস্কর্য আছে। সেখানেও কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি।

পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা শাসন ক্ষমতা নেবার আগে উপমহাদেশে সরকারি ভাষা ছিল ফার্সি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে উর্দু ভাষা চালু করা হয়েছিল। ইংরেজ শাসনের শুরুতে তারা ইংরেজি চালু করলো, সরকারি ভাষা হয়ে গেল ইংরেজি। আজকে যারা ভাস্কর্য নিয়ে কথা বলছে তাদের মতো অনেকেই তখন ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এবং এই ফতোয়া দেয়ার কারণে কিন্তু বহু বছর অনেক মুসলিম ইংরেজি শেখেনি, সে কারণে উপমহাদেশে মুসলিমরা চাকুরিতে পিছিয়ে গিয়েছিল।
কাতারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো ‘হারনেসিং দ্য ওয়ার্ল্ড’, মানে হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ। কাতারের রাজধানী দোহায় কাতার সংস্কৃতি কেন্দ্রে কাতারা আম্পি থিয়েটারের সামনে স্থাপিত হয় পুরো পৃথিবীকে সংযোগ স্থাপন করা নারী প্রতিমূর্তির অবয়বের এই ভাস্কর্য।
নব্বইয়ের দশকে ‘আমরা সবাই তালেবান- বাংলা হবে আফগান’ এই স্লোগানগুলো যারা দিয়েছিল তাদের চেহারা তো ভিডিও ফুটেজে বাংলাদেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে থাকার কথা।

বেশ শঙ্কার কথা, হায়েনারা তাদের সেই দানবীয় চেহারা দেখার জন্য বেশ তৎপর হয়েছে। এর শিকড় উৎপাটনে দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার। নজর রাখতে হবে সেসব নাটের গুরুদের প্রতিও, যারা এই চক্রকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। হাইকোর্ট ইতোমধ্যে বলেছেন, রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে, তাদের আইনের মুখোমুখি করা হোক। এদের বিচার করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তা না হলে এদের এমন আশকারা দেশের ভবিষ্যতকে ক্রমেই অনিশ্চয়তার দিকেই ঠেলে দেবে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত এ ভূখ- কোনো মৌলবাদী-দানবতন্ত্রের লীলাক্ষেত্র হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই সব সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশাবাদী এদেশের মানুষ। একই সঙ্গে প্রজন্মকে দাঁড়াতে হবে এদের বিরুদ্ধে। যারা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য আজ জাতির পিতার ভাস্কর্যে হাত দিতে পারে, তাদের কারণে আমাদের বিজয় অরক্ষিত থাকতে পারে না। কথাটি আমরা যেন ভুলে না যাই।

লেখক।মৃনাল চোধুরী লিটন

সম্পাদক সাপ্তাহিক তিতাস বানী