জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ শহীদ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব – শফী আহমে

প্রকাশিত: ১০:২০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৭, ২০২০

মানুষের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সৃষ্টি হয়, মানুষই সৃষ্টি করে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের সামনে কখনও কখনও কিংবদন্তিতুল্য নেতা ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালীর শত বছরের মুক্তি সংগ্রামে হিমালয়তুল্য যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, ইতিহাসের এক মহানায়ক, যাঁর জীবনাবসান হয় সপরিবারে স্বাধীনতার পরাজিত ঘাতকদের বুক বিদীর্ণ করা বুলেটের আঘাতে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মধুমতির নদীর তীরে অজপাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা দুরন্ত কিশোর শেখ মুজিব আমৃত্যু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কালজয়ী নেতার আসনে। যতদিন বাঙালী থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে ততদিন থাকবেন শেখ মুজিবুর রহমান।শেখ মুজিবের শৈশব-কৈশোর তথা সমগ্রজীবন পর্যালোচনা করলে একজন মহানায়কের আবির্ভাবের পেছনে ছায়া ও কায়ার মতো একজন মহীয়সী নারীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সেই মহীয়সী নারী আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু পত্নী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গর্ভধারিণী মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম মুজিবের যখন বিয়ে হয় তখন বেগম ফজিলাতুন্নেছার বয়স ৩ আর শেখ মুজিবের বয়স ছিল ১০ বছর। পৃথিবী তখনও বর্তমান সভ্যতার আলোকিত পর্বে উদ্ভাসিত হয়নি, তবুও শৈশব থেকে এই সংগ্রামী মানুষটিকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি আগলে রেখেছিলেন তিনি হচ্ছেন বেগম মুজিব। যাঁর ছিল না কোন লোভ, মোহ।জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাঙালীর প্রতিটি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু নিজেকে আপোসহীনভাবে সম্পৃক্ত করেছেন, নিজেকে নিয়ে এসেছেন নেতৃত্বের কাতারে। ঠিক তারই পেছনে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান নিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আজ ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৯তম জন্মদিন। বেগম মুজিবের জন্মদিন পালিত হবে অনাড়ম্বর পরিবেশে। বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামের পাতায় পাতায় তাঁর যে অনস্বীকার্য অবদান তা হয়ত নতুন প্রজন্ম এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠী সেভাবে অবগত নয়। বেগম মুজিব একদিকে যেমন সামলিয়েছেন কারাবন্দী স্বামীর রেখে যাওয়া সংসার, অন্যদিকে কারাবন্দী মুজিব সংগ্রামের কঠিন দিনগুলোতে নেতা ও কর্মী বাহিনীর প্রতি যে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন তা সময় মতো এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে তীক্ষè নজরদারি করেছেন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সংগ্রামের যে নবধারা সূচিত হয় সেই থেকে শুরু করে ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অবধি বেগম মুজিব এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। সেই ঘটনাবলীর দিকে কিছুটা আলোকপাত করছি।বাঙালী জাতির একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের মূল বাহন ছিল বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস ঘটিত হয়েছিল সেটার যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে সংগঠন, আন্দোলন এবং সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই ছাত্র ও তরুণ সমাজের প্রধান এবং সর্বাত্মক প্রেরণার উৎসস্থল ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, নেতৃত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে যখনই কোন সঙ্কটের কালোছায়া পড়েছে বেগম মুজিব তা দূর করার জন্য পর্দার অন্তরালে দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। এ আমার কথা নয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাদের ঘরোয়া আলাপচারিতায় এই সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ কথাগুলো বার বার উঠে আসে। কিন্তু ইতিহাস তা লিপিবদ্ধ করেনি। উত্তরাধিকার সূত্রে বেগম মুজিব যতটুকু অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছেন নিঃশর্তভাবে সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পেছনে। তিনি একদিকে কিছু টাকা জমিয়ে বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য যে প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেয়া হতো সেখান থেকে ঋণ নিয়ে পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু ভবনখ্যাত ৩২ নম্বরের বাড়িটির কাজ সুসম্পন্ন করেন। পুত্রসম শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি, নিজ পুত্র শহীদ শেখ কামাল, কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, শেখ জামাল এবং কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ রাসেলের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার সমস্ত দায়িত্ব সূচারুভাবে পালন করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের পেছনে যতটুকু আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল তাও তিনি করেছেন। ছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে কখনও কখনও বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই বিভেদও তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ও নেতা যেমনভাবে সমাধান করেন ঠিক তেমনিভাবে সমাধান করেছিলেন। ইতিহাসের এ এক অনুল্লিখিত পর্যায়।১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা আইযুব খানের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন শুরু হয় তার কিছুদিন পরেই বন্ধবন্ধু গ্রেফতার হয়ে যান। সেই সময় আন্দোলন পরিছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে কখনও কখনও বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই বিভেদও তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ও নেতা যেমনভাবে সমাধান করেন ঠিক তেমনিভাবে সমাধান করেছিলেন। ইতিহাসের এ এক অনুল্লিখিত পর্যায়।১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা আইযুব খানের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন শুরু হয় তার কিছুদিন পরেই বন্ধবন্ধু গ্রেফতার হয়ে যান। সেই সময় আন্দোলন পরিচালনার নির্দেশনা দিতেন ধানম-ির ৩২ নম্বর থেকে বেগম মুজিবের মাধ্যমে। ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন সেই ৬ দফার আলোকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যে সমস্ত ছাত্র, যুবক ও আওয়ামী নেতা ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের পাশেও ছায়ার মতো ছিলেন বেগম মুজিব। ৬ দফাকেন্দ্রিক আন্দোলন প্রচারের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালী জনগোষ্ঠীকে এক লৌহ কঠিন ঐক্যের কাতারে নিয়ে আসে। ছাত্রনেতারা ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিক ও শিল্পাঞ্চলে। সেখানেও শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। সেই আন্দোলনেও বেগম মুজিবের সুচিন্তিত মায়াময়, মাতৃতুল্য, ভগ্নিতুল্য ¯েœহের পরশ ছিল। আন্দোলন দমন করতে না পেরে আইয়ুব শাহী বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতার নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) দায়ের করে। ফলে বঙ্গবন্ধু আবারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামের এই কঠিন পর্যায়ে দলের মধ্যে আপোসহীন ও আপোসকামী ধারা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেগম মুজিবের অনুপ্রেরণায় কিছুসংখ্যক ছাত্র আপোসকামী ধারাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করে সেই আন্দোলনকে এক দফার আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে আইয়ুব শাহী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। জান্তার গুলিতে শহীদ হন সার্জেন্ট জহুরুল হক, শিক্ষক শামসুজ্জোহা, আসাদ, মতিউর। সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থান। জনরোষে ভেসে যায় আগরতলা মামলা, এর বিচারক এবং পাকিস্তানী জান্তার দোসরদের সর্বশেষ ঠিকানা। ইতিহাসের এই পর্যায়ে বেগম মুজিব এক দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন। সামরিক জান্তা আইয়ুবের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিলে বসার জন্য। সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন নেতৃত্ব ও ছাত্র-তরুণদের দৃঢ়তার মুখে বেগম মুজিব এক কঠিন অবস্থান গ্রহণ করেন। সেই সময় আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে যান প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব মেনে নিতে। কিন্তু বেগম মুজিব অনমনীয় ভাব প্রদর্শন করেন। পরবর্তী সময় বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার বিষয়ে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সামরিক জান্তা রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তি পাচ্ছেন এবং আলোচনায় যোগ দিচ্ছেন। প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পাকিস্তানের সমস্ত পরিকল্পনা ল-ভ- হয়ে যায়। এমনিভাবে ২৫ মার্চের কালরাতে গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব সমস্ত গোপনীয় বিষয় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেখভাল করেন।দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি আমাদের স্বাধীনতা এবং বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের যে কালরাত অর্থাৎ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব ছিলেন ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হিসেবে। বাঙালী জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বেগম মুজিবের অবদান বঙ্গবন্ধুপত্নী হিসেবে নয়, একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম মহানায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছেন। ইতিহাসবিদদের উচিত বেগম মুজিবের এই অবদানকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করা। সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ