শুভ্রতায় আবৃত কামাল লোহানী

প্রকাশিত: ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, জুন ২১, ২০২০

শুভ্রতায় আবৃত কামাল লোহানী

হারুন হাবীব

উনিশ’ আশি সালের কথা । জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রবল প্রতাবে দেশ শাসন করছেন। স্বাধীনতা বিরোধীরা রাতারাতি পুনর্বাসিত হতে শুরু করেছে তার নতুন রাজনীতির কল্যাণে। সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের সবকিছু পাল্টে যেতে শুরু করেছে। রাজাকাররা প্রবল প্রতাবে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। রাজনীতিতে কেনাবেঁচা শুরু হয়েছে। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পরাজিতেরা ছাড়া সে পাল্টে যাওয়া কেউই আশা করে নি। কিন্তু এরপরও জীবন থেমে থাকেনি। অফিস-আদালত চলেছে। যানবাহন চলছে। সরকারি আদেশ-নির্দেশের বাইরে কিছু লিখতে না পারলেও পত্রপত্রিকা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা সেদিনের নবীন সাংবাদিকরাও কাজ করছি। প্রতিরাতে কারফিউর মধ্যে রিকসায় বাড়ি ফেরার সময় রাইফেল উঁচিয়ে পুলিশ-মিলিটারি থামিয়ে দিচ্ছে, পরিচয় জানাতে হচ্ছে। আমরা না হয় উৎড়ে গেছি ‘কারফিউ পাস’ আছে বলে, বিপন্ন হয়েছেন সাধারণ মানুষ। বলাই বাহুল্য, জেনারেল জিয়ার আমলের ‘নৈশ কারফিউ’ যেন শেষ হবার ছিলো না ! বছরের পর বছর চলেছে ! আমি তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রায়-নবীন রিপোর্টার। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফিরে যোগ দিয়েছিলাম ‘বিপিআই’ বা বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের ছোট্ট একটি বার্তা সংস্থায়। ১৯৭৫ সালে যোগ দিয়েছি বাসস-এ। প্রথাগত ভাবেই বাসস থেকে দুজন রিপোর্টারকে প্রেসিডেন্ট ভবনের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। একজন আমার বয়োজেষ্ঠ সৈয়দ মোজাম্মেল হক, অন্যজন আমি। সামরিক শাসক- তথা প্রেসিডেন্ট জিয়া মাঝে মধ্যেই বিদেশ সফর করেন। বেশির ভাগ সময়েই মোজাম্মেল ভাই বা আমার অন্য সব জেষ্ঠরা, হয়তো যোগ্যতার কারণেই, রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গি হন। বিদেশ যেতে আমার যে লোভ হয় না তা নয়, কিন্তু পেরে উঠিনা। সেবার ভাগ্যে ছিকে ছিড়বে বলে মনে হল। প্রেসিডেন্ট হাউস সফরসঙ্গিদের তালিকা তৈরি করেছে। শুনলাম, জেষ্ঠ সাংবাদিকের এবারকার তালিকায় আছেন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী, ফজলে রশিদ এবং কনিষ্ঠদের মধ্যে আমিসহ বিভিন্ন পত্রিকার কয়েকজন। কিন্তু আমার বেলায় ভালোকিছু সহজে হয় না, হলোও না। শুনলাম, ‘ড্রেস রিহারসেল’ দিতে হবে, এবং পরীক্ষা নেবেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। প্রেস সেক্রেটারি কাফি খান ফোনে জানালেন, মনে রেখ, যেনতেন পোশাক পরে রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গি হওয়া যায়না। সুট-টাই চাই। ভাবলাম হয়তো তাই । কিন্তু মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরার জোগাড়। গরমকালে আমি হাফ শার্ট ও সেন্ডেল পরি। কনকনে শীতের সময়, খুব বিপদে পড়লে, সুয়েটার-জুতা পরি । কিন্তু এখন শুনছি, বিদেশ যেতে হলে স্যুট-টাই লাগবেই। ওটা ছাড়া নাকি চলবে না। স্যুট-টাই যে একেবারে ছিলোনা – তা নয়। কয়েক বছর আগেই বিয়ে করেছি, কাজেই আছে একটা বাক্সবন্দি হয়ে। মাস কয়েক আগে দৈনিক সংবাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি মোনাজাতউদ্দিন গভীর রাতে হন্তদন্ত হয়ে আমার সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে এসে হাজির হল। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে তারও থাইল্যান্ডে যাবার ডাক এসেছে । সে খুব খুসি। খবর পেয়েই রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছে । কিন্তু দুদিনের মধ্যে স্যুট-টাই বানাবে কিভাবে ? টাকাই বা কোথায় ? লম্বায় আমরা প্রায় সমান বলে আমার দ্বারস্থ হয়েছে বিপন্ন বন্ধুবর ! বাক্সপেটারায় বেশ খোঁজাখুজির পর দুমরানো-মোচরানো স্যুট-টাই পাওয়া গেল। বন্ধুবর ভাবলো, বাঁচা গেল। অতি-যতনে সেই স্যুট-টাই সে গায়ে চাপালো এবং আয়নার সামনে দাঁড়ালো। বলা বাহুল্য, পোশাকটা যে না পরলেই ভাল হতো, মোনাজাতের দিকে তাকালেই তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু মোনাজাত সেই স্যুট-টাই নিয়ে সানন্দে বেরিয়ে গেল। যাই হোক, যথা সময়ে বঙ্গভবনে সফরসঙ্গিদের ‘ড্রেস রিহারসেল’ শুরু হল। আমি ছিলাম ১১ নম্বর সেক্টর-এর একজন গেরিলা যোদ্ধা, বাড়তি দায়িত্ব ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা ও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ এর রণাঙ্গন সংবাদদাতার। সেই সুবাদেই নিজ অঞ্চল ছেড়ে অনেক জায়গায় যাবার সুযোগ হয় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। আসামের মানকারচরের কাছে তেলঢালার পাহাড়েও গিয়েছি বার কয়েক, সেখানে ছিল মেজর জিয়ার ‘জেড ফোর্স’ । এরপর, সম্ভবত সেপ্টেম্বর কি অক্টোবরের দিকে, নানা সন্দেহজনক কাজকর্মের অভিযোগ এবং যুদ্ধের বিশেষ কৌশলগত প্রয়োজনে ‘জেড ফোর্স’কে সিলেটের দিকে পাঠিয়ে দিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার। অনুমান করি, হয়তো সেদিনকার মুখ চেনার সুবাদেই তেমন কিছু প্রশ্ন না করলেন না ক্ষমতাশীন জেনারেল। বললেন, স্যুট-টাই পরতে হবে, ওসব ছাড়া চলবে না, যলদি বানিয়ে ফেলুন, যান। কিন্তু আমি উৎড়ে গেলেও বড় সংকট বাধলো কামাল লোহানীকে নিয়ে। তিনি কিছুতেই তাঁর চিরায়ত সাদা পাজামাপাঞ্জাবি ছাড়বেন না, স্যুট টাই পরবেন না। যেতে হলে ওভাবেই যাবেন। বলতে গেলে খানিকটা তর্কই হল জেনারেল জিয়ার সাথে লোহানী ভাইয়ের । কিন্তু তাঁর এক কথা, পাজামাপাঞ্জাবি ছাড়বেন না, সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। অন্যদিকে মিলিটারি প্রেসিড যেতে হলে ওভাবেই যাবেন। বলতে গেলে খানিকটা তর্কই হল জেনারেল জিয়ার সাথে লোহানী ভাইয়ের। কিন্তু তাঁর এক কথা, পাজামা পাঞ্জাবি ছাড়বেন না, সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। অন্যদিকে মিলিটারি প্রেসিডেন্টও জানিয়ে দিলেন তার সফরসঙ্গি হতে হলে পাজামাপাঞ্জাবি পরা চলবেনা, স্যুট-টাই পরতে হবে। কিন্তু যে কামাল লোহানী নিজের পোশাক ও জীবনধর্ম নিজেই নির্বাচন করেন, তিনি একজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরের কথায় মত বদলাবেন কোন্ দু:খে ? শেষ পর্যন্ত লোহানী ভাই জেনারেল জিয়ার সফরসঙ্গি হন নি, তাঁকে নেয়া যায়নি। কাহিনীটা মনে পড়ল যখন লোহানী ভাইয়ের পঁচাশিতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে এই লেখাটা লিখছি। কারও রাজনৈতিক বিশ্বাস ও জীবনচর্চা সবাই সমান ভাবে সম সময় মেনে নিতে পারে বা মানবে – এমনটা নয়। গণতান্ত্রিক জীবনধারায় এই বৈপরিত্ব থাকবেই। কিন্তু একজন মানুষ তার নিজের বিশ্বাস ও পছন্দ-অপছন্দের সাথে কতটা সৎ থাকতে পারেন, কতটা দৃঢ থাকতে পারেন, কীর্তিমান সাংবাদিক ও বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী তার বড় প্রমাণ। লোহানী ভাইয়ের সাথে আমার বয়সের ফারাক অনেক। দেখা-সাক্ষাতও হয়না খুব একটা। আমার নিজের একটা ছোট্ট, বলা চলে, একেবারেই অতি-সাধারণ বলয় আছে, সেখানেই আমি নিজের মত করে থাকি। রাষ্ট্রের কাছে, ক্ষমতাধরদের কাছে, নিজের জন্যে তেমন প্রত্যাশা নেই; যদি থাকে তা এতটুকুনই যে তারা যেন গণতান্ত্রিক হন, সুবিবেচক হন, তারা যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হন, গণমানুষের মঙ্গল সম্পাদন করেন। দুর্ভ্যাগ্য, ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকন্ডের পর পর অনেককাল সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তের দামে কেনা, সেই বাংলাদেশকে সামরিক ও আধা সামরিক শাসকেরা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, যা লাখো শহীদের রক্তের সাথে বিশ্বসঘাতকতা।

এরপরও বলি, লোহানী ভাইয়ের সাথে দেখা যে একেবারেই হয়না তাও সত্যি নয়। দেখা হয় কখনো কোনো আলোচনা সভায়, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিকাশ আন্দোলনের সাথে যুক্ত কোনো অনুষ্ঠানে। আমাদের জেনারেশনের অনেকের জীবনটা এভাবেই নির্ধারিত। মনে পড়ে, ২০০১ সালে লোহানী ভাই, আমি এবং আরও কিছু বন্ধুর সাথে মিলে মুক্তিযুদ্ধের পর আগরতলায় প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছিলাম ‘মুক্তিযুদ্ধ উৎসব’, যেখানে এক ঐতিহাসিক মিলনমেলা ঘটেছিল দুই ভূখন্ডের মানুষদের। ত্রিপুরার সরকার এবং গণমানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ, আবারও নতুন করে ১৯৭১ সালের পর। আমি জানি, লোহানী ভাইয়ের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ থাক না থাক মনের দেখাসাক্ষাৎ আছে। এই মানুষটির প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা । দৃঢ়তা সমৃদ্ধ মানুষ তিনি, আদর্শের গৌরবে আজও, এই বয়সেও, দৃঢ়পায়ে দাঁিড়য়ে থাকেন। পঁচাশি বছরে পা রেখেও কর্ম ও মননে আজও তরুণ কামাল লোহানী। কাশফুলের মতো সাদা চুল । তাঁর এই সাদা চুল যে কবে দেখা শুরু করেছিলাম, মনে পড়েনা! ঢাকায় যখন প্রথম আসি সেই তখন থেকেই দেখে চলেছি সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও জয়বাংলা সাপ্তাহিকের অফিসে আসাযাওয়া করতেন এই পোশাকেই। বলাই বাহুল্য, শুভ্রতায় আবৃত কামাল লোহানী; প্রগতিশীল জাতীয় আন্দোলনে, এক সময়ের লড়াকু সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতা-কোথায় তিনি নেই ? রাজপথে, মিছিলে, বৈঠকে, সভাসমিতিসহ সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে -সব জায়গাতেই লড়াকু সৈনিক লোহানী ভাই। এমন আত্মনিবেদিত, এমন দৃঢ়,সাহসী মানুষ খুব কি মেলে ?

ক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখেন লোহানী ভাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও ঐতিহাসিক ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক তিনি। শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল, সন্তোস গুপ্ত, সিকান্দার আবু জাফর, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহমদ, আমিনুল হক বাদশা, সলিমুল্লাহসহ আরও কিছু নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে আমি দেখেছি কলকাতার বালুহক্কাক লেনের অফিসে দিনরাত কাজ করতে। মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় এঁদের কারও অবদান খাটো করে দেখবার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের এই দুই গণমাধ্যমের সঙ্গে রণাঙ্গন থেকে যুক্ত থাকার সুবাদে এঁদের সকলকে বেশি করে জানার সুযোগ ঘটেছিল আমার। স্বাধীনতা-উত্তর কালের সাংবাদিকতারও একনিষ্ঠ মানুষ লোহানী ভাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তিকালের সামরিক শাসন কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহন ছিল অবধারিত। কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আজও,এই পঁচাশি বছরেও নিজের চিন্তা ও চেতনাকে প্রকাশ করেন তাঁর খুরধার কলমে। কয়েক বছর আগে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ সহ মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি কালজয়ী গানের রচয়িতা পশ্চিমবঙ্গের কবি গোবিন্দ হালদারের একটি অপ্রকাশিত ডায়েরি হাতে আসে আমার কবিকণ্যা গোপার সহযোগিতায় । আমি তখন ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত’ নামে তিনখন্ডের একটি বৃহৎ গবেষণা গ্রন্থ রচনায় যুক্ত। চারদিক থেকে সম্ভাব্য সকল তথ্য সংগ্রহ করে চলেছি। গোবিন্দ হালদারের সেই ডায়েরিতে কামাল লোহানীর কথা বহুবার উল্লেখ আছে। কারণ তাঁর গানগুলি থেকে বাছাই করে উল্লেখযোগ্য গানগুলিতে সুরারোপ করিয়ে তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন লোহানী ভাই। একটি গান সম্পর্কে গোবিন্দ হালদার লিখেছেন:“ প্রথম রচনাকালে গানটির যে ভাষারূপ ছিল, পরবর্তীকালে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী সাহেবের অনুরোধে গানটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অন্তরা পরিবর্তন করে বর্তমান রূপ গৃহীত হয়।” গানগুলির রচনা ও সুরারোপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গোবিন্দ হালদার লেখেন : “ যতদূর মনে পড়ছে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই কামাল ভাই (অন্য জন) আমাকে প্রথম জানালেন যে, আমার গানের খাতাটি তিনি ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে’ পৌঁছে দিয়েছেন। আমার কয়েকটি গানে সুর হচ্ছে । দু’জন সুর করেছেন। তখন আর বিস্তারিত কিছু বল্লেন না। কেননা, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের ’ তৎকালীন অবস্থান এবং তার কার্য্যপ্রণালী সম্পর্কে বাইরের কেউ যাতে কোনরূপ কিছু জানতে না পারে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপর কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ ছিল। — মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ গোপন কেন্দ্র একরকম পাকাপাকিভাবে স্থাপিত হয়ে যায় কলকাতায়। কর্মকর্তাদের অন্যতম প্রধান এবং বেতারের সংবাদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী সাহেব ছিলেন কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ট বন্ধু। ফলে, লোহানী সাহেব কলকাতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই কামাল ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ গোপন কেন্দ্রে নানা কর্মসূত্রে তাঁর যাতায়াত শুরু হয়। অনুষ্ঠান প্রচারের প্রথম যুগে ভাল গানের অভাবের কথা শুনে, তিনি আমার গানের খাতাটি লোহানী সাহেবের হাতে তুলে দেন। লোহানী সাহেব তখন খাতাটি বেতারের সংশ্লিষ্ট সুরকারদের দেন খাতা থেকে গান বাছাই করে সুর করার এবং তা’ প্রচার করার জন্য । খাতার ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি ’ গানটির ‘কথা’ লোহানী সাহেবেরও বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল। গানটির যাতে ভাল সুর হয় এজন্য দুই বন্ধুতে পরামর্শ করে লোহানী সাহেব প্রথম আমার গানের খাতাটি বেতারের বর্ষীয়ান,অভিজ্ঞ সুরকার ও সংগীত স্রষ্টা শ্রীসমর দাস মহাশয়কে দেন। কিন্তু আপেল মাহমুদ নামে বেতারের একজন তরুণ সংগীতশিল্পী খাতা থেকে ঐ গানটি পছন্দ করে বেছে নিয়ে সুর করতে আরম্ভ করেন। আপেল মাহমুদ অভিজ্ঞ সুরকার না হওয়ায় তাঁর দেওয়া সুর কেমন হবে এ বিষয়ে লোহানী সাহেব ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু তা’ সত্ত্বেও গানটিতে ইচ্ছামত সুর করার জন্য তাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়

আমার যতদূর স্মরণে আসছে, তাতে ১৯৭১ এর জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ার দিকে গানটি প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। কারণ, নির্দিষ্ট দিন ও তারিখ মনে না থাকলেও , এটুকু মনে আছে যে, জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আমি গানটি প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে শুনেছিলাম। কেননা, স্বাধীন বাংলা বেতারের দেশাত্মবোধক সংগীতের অনুষ্ঠান সে সময় আমি নিয়মিত দু’বেলাই শুনতাম। বিশেষ করে, আমার গানগুলি স্বাধীন বাংলা বেতারে দেওয়া হয়েছে এবং কয়েকটি গানে সুর হচ্ছে কামাল ভাইয়ের মুখে একথা শোনার পর আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে বেতারের অনুষ্ঠান শুনতাম। — লোহানী সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটি আজও বেশ মনে পড়ে। কারণ সেই প্রথম পরিচয়েই লোহানী সাহেবের ব্যক্তিত্ব এবং স্বভাব মাধুর্য্য আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষন করেছিল। তারিখটা ঠিক মনে নেই। অফিস পালিয়ে কামাল ভাইয়ের ডেরায় গিয়ে হাজির হয়েছি। বেলা বোধহয় তখন ৩টা/৩.৩০ টা হবে। ঘরে ঢুকেই দেখি কামাল ভাই সমনে বসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে গল্প করছেন।ভদ্রলোকের গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবী, পরনে সাদা ধবধবে পাজামা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ন।মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ। প্রথম দৃষ্টিতেই আকর্ষন করার মত চেহারা । কামাল ভাই লোহানী সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। লোহানী সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করে’ শুভেচ্ছা জানালেন্ তারপর ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটির রচনার জন্য আমাকে সবিশেষ অভিনন্দন জানালেন। কথা প্রসঙ্গে বল্লেন, ‘আপনার লেখা গানটি বাংলাদেশে দারুন ঝড় তুলেছে। লোহানী সাহেবের কথা শুনে খুব আনন্দ হল। তারপর বল্লেন ‘আপনার খাতা থেকে আরও কয়েকটি গান সুর করা হয়ে গেছে, শিগগিরই প্রচার করা শুরু হবে।” ২০১৮ তে বরেণ্য কামাল লোহানী পা রাখলেন পঁচাশিতে। তাঁর প্রতি একজন বয়োকনিষ্ঠের বিনম্র শ্রদ্ধা। আরও দীর্ঘদিন থাকুন লোহানী ভাই ; যে তারুণ্য ধারণ করে আপনি আজ পঁচাশি বছরে, সে তারুণ্যের প্রতি আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসা। দ্রষ্টব্য: লেখাটি শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীর ৮৫তম জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত সম্মিলন উৎসব স্মরণীকায় প্রকাশিত। দুই বছর পর, আজকের এই বেদনাবিধুর দিনে, লেখাটি আবারও তাঁকে সমর্পণ করছি। হারুন হাবীব ২০/৬/২০২০। লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা